ফ্রম গালি বয় টু কাশ্মীর এক্সপ্রেস

হার্দিক পান্ডিয়া নিজে সবেমাত্র বাউন্সারের জবাব হিসেবে পুল শট সম্পর্কে চিন্তা করেছিলেন, কিন্তু বাউন্সারটি ততক্ষণে তার হেলমেট খুলে ফেলেছিলো। ঘন্টায় ১৫০ কিলোমিটার পেস হয়তো তীব্র ঝাঁকুনি দিয়েছিল পান্ডিয়ার মস্তিষ্ককে। অপর প্রান্তের ব্যাটসম্যান ম্যাথু ওয়েডকে তখন যুদ্ধে পাঠানো ব্যাঙ্ক ক্লার্কের মতো দেখতে লাগছিল। বাউন্সারে সতীর্থ ব্যাটারের এমন পরিণতি দেখে তার মনেও হয়তো এমন দুর্ধর্ষ একটি বাউন্সারের আশঙ্কা এসেছিল।

কিন্তু, এরপর ওয়েডের সমস্ত চিন্তাই বোলারের বজ্রপাতের সামনে থমকে গিয়েছিল; অপর প্রান্ত থেকে ছোঁড়া বলটি তার দিকে ছুটে এল, এক পলকের মধ্যে ওয়েডের প্যাডগুলোকে ধাক্কা দিল চামড়ার গোলকটি। বাইশগজে তখন যেন শুধুই চলছিল গতির ভেলকি, উমরান মালিককে ভেলকি।

উমরান মালিক – বর্তমানে ভারতীয় ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি আলোচিত একটি নাম। গতিময় এই ফাস্ট বোলারের পেশাদার ক্রিকেটে আগমন তার বলের গতির মতই দ্রুতই ঘটেছে। মাত্র ২০১৭ সালে উমরান মালিক তার বন্ধু আবদুল সামাদের মাধ্যমে পেশাদার ক্রিকেট সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন তিনি।

আবদুল সামাদের অনুরোধে তার কোচ রানধীর সিং মনোজ প্রথমবার টেনিস বলে বল করতে দেখেছিলাম উমরানকে। প্রথম দেখাতেই এই স্পিডস্টারের গতিময় বোলিং মুগ্ধ করেছিল জম্মু-কাশ্মীরের কোচ মনোজকে৷ আর তাই তিনি উমরানকে নিয়মিত প্র্যাকটিসে আসতে বলেন।

পেশাদার ক্রিকেট সম্পর্কে অজ্ঞ উমরান মালিক অবশ্য শুরুতে উদাসীন ছিলেন অনুশীলনে। তার বলের গতি কোচকে মুগ্ধ করলেও তার শৃঙ্খলাভঙ্গ মন:পূত হয়নি কোচ মনোজের।

তিনি বলেন, ‘সে [উমরান] এক সপ্তাহ অনুশীলনে আসতো; এরপর আবার ৩-৪ দিন অনুপস্থিত থাকতো। অবশ্য তাকে দোষারোপ করা যায় না, কারন তখনও নিজের প্রতিভা সম্পর্কে তেমন কোন ধারনা ছিল না তার। একদিন আমি তাকে বলেছিলাম, তুমি ভারতের হয়ে খেলতে পারবে।’

কোচের এমন কথায় অবশ্য শুরুতে হেসে উঠেছিলেন কাশ্মীরের এই তরুণ ফাস্ট বোলার, তবে এরপর থেকেই ধীরে ধীরে মনোযোগ দিতে থাকেন অনুশীলনে।

ধার করা বুট জুতা নিয়ে জম্মু কাশ্মীরের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ট্রায়াল দিতে গিয়ে নির্বাচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দলে থাকলেও ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি তার। ভিনো মানকাদ ট্রফিতে একটি ম্যাচে একাদশে সুযোগ পেলেও বৃষ্টির কারনে সে ম্যাচ মাঠেই গড়ায়নি।

নিজেকে প্রমান করার কোন সুযোগ না পাওয়া উমরান মালিক এরপর হারিয়ে ফেলেন খেই। অনূর্ধ্ব ২৩ রাজ্য দলে তখন আর জায়গা করতে পারেননি এই স্পিড সেনসেশন।

তবে উমরান মালিকের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) সময়ে। এসময় সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ দলের জন্য নেট বোলারের খোঁজ করেছিলেন সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার অজয় রাত্রা। ট্রায়ালের সময় উমরানের গতি আর বাউন্স দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন তিনি, পাশাপাশি এটা জেনে রীতিমতো অবাক হয়ে যান যে রাজ্য দলে উমরানের সুযোগ হয়নি।

অজয় রাত্রা বলেন, ‘আমি কিছুটা চমকে গিয়েছি যখন জানতে পেরেছিলাম সে [উমরান] জম্মু কাশ্মীর দলের সদস্য নয়। যে ধরনের বাউন্স সে আদায় করে নিচ্ছিলো তা সত্যিই চমৎকার।’

উমরানের শুরুর দিকের কোচ মনোজ এ ব্যাপারে বলেন, ‘অজয় রাত্রা উমরানের গতি এবং বাউন্স দেখে অভিভূত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তিনি জম্মু কাশ্মীর দলের অধিনায়ক এবং কোচিং স্টাফদের সাথে কথা বলেন এ ব্যাপারে।’

মনোজ অবশ্য মনে করেন উমরান তার ক্রিকেটের পথচলায় অনেক ভাগ্যবান। তিনি বলেন, ‘অনেক মানুষ তাকে সাহায্য করেছে। তার পরিবার, যারা তার প্যাশনের প্রতি সমর্থন দিয়েছিল। আবদুল সামাদ, যে তাকে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের নেট বোলারের চুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল। এছাড়া অজয় রত্রা যিনি জম্মু-কাশ্মীর দলে উমরানের ব্যাপারে সুপারিশ করেছিলেন। এবং সবশেষে ইরফান পাঠান যিনি উমরানকে রাজ্যের সিনিয়র দলে দ্রুত সু্যোগ দিয়েছিলেন।’

২০২১ সালের আইপিএলের আসরে উমরান মালিক মূলত নেট বোলার হিসেবেই সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদে ছিলেন, তবে দলের মূল পেসার নটরাজন কোভিডে আক্রান্ত হওয়ায় সুযোগ এসে যায় মালিকের জন্য। সে সুযোগেই রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিপক্ষে ১৫২.৯৫ কিলোমিটার/ঘন্টার একটি বল করেন যা পরে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্ব্বোচ্চ গতিময় ডেলিভারি নির্বাচিত হয়েছিল।

অল্প ম্যাচ খেললেও নিজের গতির ঝলকে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন উমরান মালিক। সে বছরই ২০২১ দুবাই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের জাতীয় দলের সঙ্গে নেট বোলার হিসেবে বিশ্বকাপ যাত্রা করেন তিনি। এছাড়া ২০২২ আইপিএলের জন্য-ও মালিককে রিটেইন করেছিল তার দল সানরাইজার্স হায়াদ্রাবাদ।

উমরান মালিকের বাবা আবদুল রশীদ জম্মু’র গুজ্জার শহরে ফল বিক্রি করেন। এখন অবশ্য তাঁর দোকান ‘আবদুল রশীদের দোকান’ নয় বরং ‘উমরানের বাবার দোকান’ নামেই বেশি পরিচিত। ছেলের সাফল্যে খুশি হলেও আবদুল রশীদ এখনই নিজের কাজ ছাড়তে রাজি নন।

তিনি বলেন, ‘এই কাজের মাধ্যমে আমি আমার পরিবারের খাদ্যের ব্যবস্থা করেছি। হ্যাঁ, আমার ছেলের নাম সারাদেশে ছড়িয়েছে, কিন্তু এজন্য আমি আমার কাজ বন্ধ করবো না।’ উমরানের বাবা আবদুল রশীদ অবশ্য মনে করেন উমরান শুধু তার ছেলে নয়, বরং সে পুরো ভারতীয় জাতির প্রিয় হয়ে উঠেছে।

তবে কাজ বন্ধ না করলেও উমরান মালিকের বাবা’র সম্মান আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আর কেউ তাকে অতিরিক্ত ধনেপাতা কিংবা মরিচের জন্য জিজ্ঞেসা করে না। এমনকি দাম নিয়েও ক্রেতারা কোনরূপ আলোচনা করে না। সবমিলিয়ে উমরানের এমন উত্থান আশীর্বাদ হয়েই এসেছে আবদুল রশীদ এবং তার পরিবারের জন্য।

এখন পর্যন্ত আইপিএলের সবমিলিয়ে এগারো ম্যাচে উমরান মালিকের সংগ্রহ আঠারো উইকেট। মাত্র ১৯.৭১ বোলিং গড়ের মালিক এই ফাস্ট বোলার। ইকোনমি-ও ঈর্ষনীয় বটে, মাত্র ৭.৯৮!

এবারের মৌসুমে অবশ্য আগের চেয়ে অনেক দক্ষ হয়ে উঠেছেন উমরান। গতির পাশাপাশি নিঁখুত লাইন লেন্থ তার সাফল্যের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারন। উমরানের এমন উন্নতির হওয়াটাই অবশ্য স্বাভাবিক, বর্তমানে উমরানদের বোলিং কোচ যে আরেক পেস সেনসেশন ডেল স্টেইন।

জম্মু-কাশ্মীরের কোচ মনোজ-ও অবশ্য বলছেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘ইন্ডিয়া-এ দলের হয়ে কয়েকটি সিরিজ এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে পুরো মৌসুম খেললে উমরানের দক্ষতা আরো বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া হায়দ্রাবাদে সে এখন ডেল স্টেইনের সঙ্গে কাজ করছে। শেখার জন্য ‘গ্রেট স্টেইনের’ চেয়ে ভাল কয়জনই বা আছে।’

উমরান মালিক, ক্যারিয়ারের শুরুতেই হয়ে উঠেছেন সুবিশাল ভারতের সবচেয়ে দ্রুততম ফাস্ট বোলার। তার সামনে এখন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভবনা রয়েছে। আর এমন অপার সম্ভাবনা’কে এখন ঘষামাজা করে সম্পদে পরিনত করার মূল দায়িত্ব উমরানের নিজেরই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link