ক্রিকেট দর্শনের গ্রামশি

ভিক্টর রিচার্ডসন যেন অস্ট্রেলিয়ার চুনী গোস্বামী। সবকিছু খেলেছেন; অস্ট্রেলিয়ার হয়েই টেস্ট ক্রিকেট, রুলস ফুটবল (অস্ট্রেলিয়ান রাগবি) খেলেছেন। সঙ্গে প্রভিনশিয়াল স্তরের টেনিস, বেসবল, সাঁতার, বাস্কেটবল। উপরের ঠোঁট পাতলা আর ঠোঁটকাটা হিসেবে বদনাম।

তা, তাঁর তিন নাতির মধ্যে মেজোটি যেন ভিক্টর রিচার্ডসনের ক্লোন। শুধুমাত্র ট্যালেন্টটা ক্রিকেটেই। বড়টি বেশ ডাকাবুকো। কিন্তু মাঝেরটি যেন অন্য জিনিস। বলতে গেলে অদ্ভুত এক ক্রিকেটদর্শন নিয়ে ইয়ান চ্যাপেলের মেজো ভাইটি ক্রিকেট খেলতে এসেছেন। ট্রেভর তখন খুবই ছোটো, তাই দুই ভাইয়ের ক্রিকেটে কখনোই পাঁচ বছরের বড় দাদা মেজো গ্রেগকে অস্ট্রেলিয়া বা পছন্দের টিম নিতে দেয় না। সবসময় ইংল্যান্ড, বা আলতু ফালতু নিউজিল্যান্ড চাপিয়ে দেয়। অনেক বেশি ধূর্ত, বলিয়ে কইয়ে দাদা। তা বলে কি ভালোবাসে না? বাসে হয়তো, বোঝার উপায় নেই।

এই যেমন ৬৬-তে টেস্ট ক্রিকেটে সুযোগ পেলে, গ্রেগ যাতে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া টিমে সুযোগ পান, তা নিশ্চিত করে গেলেন ইয়ান। গলায় সংক্রমণ নিয়ে গ্রেগ দু-ইনিংসেই ৫০ করলেন। তখন ১৮ বছর বয়স। তবু কোথাও ঘণ্টা বাজল না, ফুল-চন্দনের বর্ষণ হল না। ইয়ান অনেক ডাকাবুকো, লড়ে নেবে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া। বেনোর পর তাকেই সবাই ক্যাপ্টেন ভাবতে শুরু করেছে। গ্রেগ অনেক বেশি চুপচাপ। ক্রিকেটের ইতিহাস, বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ পাঠক।

পরের দু-বছরে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার নিয়মিত হয়ে উঠলেন গ্রেগ। ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে দেখা হল হঠাৎ, পার্থে। ব্র্যাডম্যান সমস্ত দেখে শুনে গ্রিপ পাল্টাতে বললেন, সব বল লেগসাইডে খেলার অভ্যাস, ব্যাট ব্যাঁকা নামছে। উপরের হাতটা একটু সোজা করে, নিচের হাত লুজ করা। তারপর দুবছর কাউন্টি। ব্র্যাডম্যান-উত্তর যুগের অস্ট্রেলিয়ার শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান তখন ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরছেন।

ইংল্যান্ডের আবহাওয়ায় গ্রেগ হাত ঘোরাতে শুরু করলেন। আসলে বোলারের দৃষ্টিকোণও তো জানা উচিত। আর সবার জুতোয় পা গলালে যদি ম্যাজিক জানি? ফিট করে যেতেই পারে। বোলিংটাও চলে এল। তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ওয়াকার সবুজ ঘাসের উইকেটে সাত নম্বরে ব্যাট করতে নেমে প্রথম টেস্টেই সেঞ্চুরি। ইয়ান রেডপাথের সঙ্গে জুটিতে দুশোর ওপর রান। তার কিছুদিনের মধ্যেই ত্রিনিদাদে তাঁর থেকে দশ ইঞ্চি কম লম্বা আর-একজন ফুল ফোটাচ্ছেন। তবে এখান থেকে আমাদের গল্প শুরু নয়। এ হল সলতে পাকানোর পর্ব।

শুরুটা হচ্ছে ১৯৭১-৭২-এ। দক্ষিণ আফ্রিকার অস্ট্রেলিয়া সফর বাতিল হয়ে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে বর্ণবিদ্বেষের জন্য বয়কট করেছে শ্বেতাঙ্গ সমাজ। (যেন বিদ্বেষ বেসিল ডিল অলিভিয়েরার ঘটনাটা না ঘটলে বোঝাই যেত না। ইংরেজরা এমনই। ১৯৩৭-এও প্রশংসা চলছে হিটলারের। লন্ডন আক্রমণের কিছুদিন আগেও। নিজের গায়ে আঁচ না লাগলে।

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ডাক পড়ল বিশ্ব একাদশের। অধিনায়ক সোবার্স। সঙ্গে গ্রেম আর পিটার পোলক, সানি গাভাসকার, বিষেণ বেদি, ফারুক ইঞ্জিনিয়ার, ইন্তিখাব আলম, জাহির আব্বাস, নর্মান গিফোর্ড, হিলটন অ্যাকারম্যানেরা। প্রথম ম্যাচে গ্রেগ সুযোগ পাননি। দ্বিতীয় ম্যাচের আগের তাসমানিয়া একাদশের সঙ্গে বিশ্ব একাদশের খেলা। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া থেকে দুই চ্যাপেল ভাইকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আগের দিন, প্র্যাকটিসের শেষে গ্রেগ বসে আছেন ফিটফাট হয়ে, পোশাক বদলে। ইয়ান তখনও আসেননি শাওয়ার থেকে।

ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিষেকে সেঞ্চুরির পর খুবই সাধারণ ফর্মে গ্রেগ চ্যাপেল। মাঠের আর্দালি এসে একটা খাম দিয়ে গেল গ্রেগকে। খুলে দেখলেন, সিনিয়র চ্যাপেল লিখেছেন। গ্রেগ, ট্রেভর আর ইয়ানের বাবা। অবশ্য চিঠি নয়, একটা পেপারকাটিং, দু-দিন আগের। তাতে লেখা, ‘চ্যাপেল তাঁর দুরন্ত প্রতিভাকে নষ্ট করছেন আর এরকম চললে আগামী অ্যাশেজ ট্যুরে গ্রেগ ঠাঁই পাবেন না দলে।’, সঙ্গে একটা ছোট্ট নোট, ‘যা লেখা আছে, আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু ভেবে দেখাই যেতে পারে!’

ধপ করে বসে পড়লেন গ্রেগ। দাদা এলে বললেন, এখুনি ফিরে যাচ্ছেন না। তারপর অন্ধকার গ্যালারিতে বসে, মনের মধ্যে ফিরে গেলেন আজ পর্যন্ত খেলে আসা ইনিংসগুলোতে।

বেশ অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর তিনি যেটা বুঝলেন, তাতে তাঁর ক্রিকেটদর্শন তৈরি হল; যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠল এক অত্যন্ত সফল ক্রিকেটিং ক্যারিয়ার এবং সর্বোপরি ব্র্যাডম্যানের আর্ট অব ক্রিকেটের জায়গায় এক অন্য ধরনের আধুনিক ক্রিকেট-মানস নিয়ে খেলা দেখার অ্যাপ্রোচ তৈরি হল।

কীভাবে মন:সংযোগ করবেন সেই নিয়ে একটা সম্পূর্ণ চ্যাপ্টার হয়ে যায়, তবু সংক্ষেপে সেদিকটায় নজর রাখি। আসলে ২০/২০ দৃষ্টিশক্তির কম থাকা মানেই যে কম দেখছে তা তো নয়। মনঃসংযোগের তিনটি পর্যায় ব্যাটসম্যানের। প্রথমে সচেতনতা, তারপর ফাইন ফোকাস এবং ফিয়ার্স ফোকাস বা কেন্দ্রীভূত মনোসংযোগ। গ্রেগ বলছেন, ব্যাটসম্যানকে ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়, ‘ওয়াচ দ্য বল।’

কিন্তু সারাক্ষণ, উইকেটকিপারের হাত থেকে স্লিপ ফিল্ডার, সেখান থেকে কভার মিড অফ হয়ে বোলারের হাতে, তারপরে বোলারের রান আপ, লাফ এবং বল রিলিজ, বলের দিকে নজর রেখে চললেই মানসিকভাবে ক্লান্তি চলে আসবে দ্রুত। তার থেকে বল যখন উইকেটকিপারের হাত ঘুরে এদিক সেদিক হয়ে বোলারের কাছে ফিরে যাচ্ছে ততক্ষণ পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করাই যায়, ফিল্ডারের মুভমেন্ট কীরকম হচ্ছে, হাওয়া কোন দিক থেকে বইছে, আকাশে মেঘ সরে যাচ্ছে কি না ইত্যাদি।

বল বোলারের হাতে, বোলার দৌড়োতে শুরু করেছে তখন ফাইন ফোকাস। মনঃসংযোগ সম্পূর্ণভাবে বোলারের উপর, হাতের উপর নয় কিন্তু, গ্রিপ তখনই দেখছি না। বোলার রান আপের শেষ প্রান্তে, ডেলিভারি স্ট্রাইডে যাচ্ছেন, এবারে কেন্দ্রীভূত মনঃসংযোগ, ডান কাঁধের উপরে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে থাকা, এই এখুনি ডান হাতটা বল-সহ উদয় হল। হাত, গ্রিপ, বল, কবজি। পাখির চোখ আর তার ঠোঁট গলা, পুরোটা তখন অর্জুনের নজরবন্দি। বল নামছে, মাথার ঠিক উপরের আগে নামলে বল সামনের পায়ে খেলতে হবে আর তারপর নামলে পিছনের পায়ে।

ক্রমাগত অভ্যাসে এই পুরো প্রসেসটাকেই মজ্জাগত করে ফেলা। অচিরেই অস্ট্রেলিয় ক্রিকেটে গ্রেগ চ্যাপেলের যুগ শুরু হল। খাড়া ঋজু ব্যাট ধরে দাঁড়ানো, বাঁ হাতটা গ্রিপের একদম ডগায়, ডান হাত একটু নিচে। সামান্য একটু ফ্রন্ট ফুটে পা ঘোরানো আর তারপর বলের লেন্থ অনুযায়ী সামনের বা পিছনের পা নেওয়া এবং চাবুকের মতো ব্যাট নামা। নান্দনিকতার এখানেই শুরু। লেগ গ্লান্সটা তো আগেই ছিল, কভার ড্রাইভের ব্যাট-বলে ছোঁয়ার পরে মুহূর্তের মধ্যে মুখ মাটির দিকে করে নেওয়া, বাঁ হাতের কনুই তখন সরলরেখা থেকে বেরিয়ে এসে একটি চতুষ্কোণ তৈরি করছে। ডান হাতের সহসা টাইমিং আর শক্তির প্রয়োগে বল মাঠের বাইরে।

৭২-৭৩-এর অ্যাশেজ থেকে শুরু। ইংলিশ সামারের প্রথমার্ধে বল যেখানে প্রয়োজনের থেকে বেশি নড়ে, সেখানে বব ম্যাসির অভিষেকেই ১৬ উইকেট তুলে নেবার মধ্যে চ্যাপেল একটা দৃষ্টিনন্দন সেঞ্চুরি রেখে গেলেন লর্ডসে, আর-একটি ওভালে। সেই শুরু হল চ্যাপেলের জয়যাত্রা।

সামান্য ঝুঁকে ব্যাটটা মাটিতে রাখা, পিঠ সোজা। দুটো পা হাঁটু থেকে একটু সরে যাওয়া, বাঁ হাতে সপাটে ব্যাকলিফট এবং সামান্য সামনের পা খোলা তারপরে বলের লেন্থে মাথা নিয়ে যাওয়া।

এরই মাঝে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া থেকে চলে গেলেন কুইন্সল্যান্ডে। কারণ? গ্রেগ নিজেই বলছেন, ‘আমি জানতাম আমার দাদা ক্রিকেট থেকে অবসর নিলে আমাকেই অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্বের ভার নিতে হবে। কিন্তু দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় থাকলে নিজেকে ঘষামাজার সুযোগ পাব না অধিনায়ক হিসাবে।’ তাই কুইন্সল্যান্ড। ১৯৭৩। নিউ সাউথ ওয়েলসের একটা সোনালি চুলের ছেলে ছিল। প্রচণ্ড জোরে চাকার মতো অ্যাকশনে বল করত। নাম জেফ থমসন। তাকেও নিয়ে এলেন পরের বছর।

তারপর ১৯৭৫। মোড় ঘোরানো সিরিজ। বিশ্বের ক্রিকেটটাই পাল্টে দিয়েছিল ওই ১৯৭৫-৭৬-এর সিরিজ। অস্ট্রেলিয়া তদ্দিনে বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরেছে প্রবল পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে। ইয়ান চ্যাপেল হঠাৎ অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিয়েছেন গ্রেগকে। থমসন তখন লিলির সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন। ওদিকে রবার্টস আর তরুণ হোল্ডিং। সবুজ উইকেটে ছারখার হয়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। লিলি ২৭টা আর থমসন ২৯টা উইকেট।

কিন্তু গ্রেগ? ৬টা টেস্টে ৩টে সেঞ্চুরি এবং ৩টে পঞ্চাশ সহ ৭০২ রান করলেন। ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি। যা একমাত্র বিরাট কোহলি করেছেন পরে। ফিরে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রতিজ্ঞা নিয়ে, পেসের আগুনে জ্বালিয়ে দেবে বিশ্বক্রিকেট। সেই শুরু হল ওয়েস্ট ইন্ডিজের আধিপত্য। কিন্তু তার মধ্যেও গ্রেগ স্বকীয়তায় উজ্জ্বল রইলেন।

কিন্তু এর মধ্যেই নো-ননসেন্স উগ্রতা নজরে পড়ছে। মেলবোর্ন টেস্টে একজন স্ট্রিপার হঠাৎ ছুটে এলেন জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পিচের মাঝে। গ্রেগ ব্যাট করছেন, খপ করে বাঁ হাতে ধরে দিলেন পশ্চাৎদেশে ব্যাটের বাড়ি। এভাবেই চলছিল।

এসে গেল পাজামা ক্রিকেট, প্যাকার সিরিজ। ১৯৭৭ ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার প্রথম টেস্ট খেলার ১০০ বছর উপলক্ষ্যে টস যখন করতে যাচ্ছেন, সোনার কয়েন নিয়ে মেলবোর্নে, তখনই তিনি প্যাকার সিরিজে খেলার জন্য চুক্তিপত্রে সই করে দিয়েছেন। সেই অবস্থাতেই নাটকীয় টেস্ট জিতলেন ৪৫ রানে, কিন্তু তার মধ্যে ছটফটানি ধরা পড়ে গেল। অন্তত সহখেলোয়াড়রা বলেন যে, ইংল্যান্ড যখন একটা প্রায় অসম্ভব জয়ের পিছনে ৪৬২ করতে ছুটছে, ডেরেক র্যানন্ডালের ১৭৪-এর উপর ভর করে, তখন ফিল্ড সেটিং এবং বোলারকে নির্দেশ দেওয়ার সময় বহুবার মাথা ঠিক রাখতে পারছিলেন না গ্রেগ। যেন প্রধান শিক্ষক স্কুল ছাত্রদের সামান্য অঙ্ক ভুলের জন্য তুমুল বকাবকি করছেন। লিলির অবিস্মরণীয় স্পেলে অস্ট্রেলিয়া জিতল বটে, কিন্তু লিলি আহত হলেন এবং অ্যাশেজ থেকে সরিয়ে নিলেন।

প্যাকার সিরিজে সই করার কথা তদ্দিনে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। সারা অস্ট্রেলিয়া ফেটে পড়েছে বিরোধিতায়। গ্রেগ অ্যাশেজ হারলেন ৩-০। তারপর চলে গেলেন রঙিন পোশাকের রাতক্রিকেট খেলতে। কিন্তু প্যাকার সিরিজেও ব্যাট কথা বলা বন্ধ করল না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওই পরাক্রমশালী চার পেসার আক্রমণের বিরুদ্ধেও যথেচ্ছ রান করে গেলেন গ্রেগ। রান বলতে সমগ্র প্যাকার সিরিজে ষাট গড়ে ৬৬১ রান। মনে রাখতে হবে প্যাকার সিরিজের ক্ষেত্রে সেরা মাঠ পাওয়া যেত না। মেকশিফট মাঠের মেকশিফট উইকেট, সে সব উইকেটে বল কথা বলত, আর কথা বলত গ্রেগের ব্যাট।

৭৯-৮০-তে অস্ট্রেলীয় বোর্ডের সঙ্গে কেরি প্যাকারের মিটমাট হয়ে গেলে ফিরে এলেন টিমে অধিনায়ক হিসেবে। তারপর টেলিভিশন স্বত্বের চাপে অতিরিক্ত ক্রিকেট খেলতে খেলতে বারবার প্রতিবাদ করেছেন। তবু খেলা চালিয়ে গেছেন। এরপর এল সেই অদ্ভুত বছর। ১৯৮০-৮১, এবারে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট ও ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে এসেছে ভারত ও নিউজিল্যান্ড।

সেই সিরিজে আম্পায়ার গাভাসকারকে ন্যক্কারজনক আউট দিলেন। মেলবোর্নে লিলির বল ব্যাট লেগে পায়ে লাগলেও এলবি। মাথা গরম করে মাঠ থেকে সঙ্গী চেতন চৌহানকে নিয়ে বেরিয়ে আসছিলেন গাভাসকার। কোনো মতে ম্যানেজার হনুমন্ত সিং আটকান। তারপর কর্টিজেন ইনজেকশন নিয়ে ৫ উইকেট পকেটে পুরে কপিলের সেই অস্ট্রেলিয়াকে মাত্র ৮৩ রানে শুইয়ে দেওয়া। সেই ধ্বস শুরুই হয়েছিল অবশ্য চতুর্থ দিন সন্ধ্যার‍ কাছে। কার্সেন ঘাউড়ির আউটস্যুইঙ্গিং ফুলটসে গ্রেগ পিছনের দিক দিয়ে বোল্ড হলেন।

তবে ভারতের বিরুদ্ধে সিডনিতে প্রথম টেস্টে যে ২০৪-এর ইনিংস খেললেন, সেটা এখনও ভাসে চোখে। ভুলহীন ইনিংস, একটাও ভুল পদক্ষেপ নেই, শিবলাল যাদব, দিলীপ দোশীর বিরুদ্ধে স্টেপ আউট করাই হোক বা কপিল, ঘাউড়ি, রজার বিনির বিরুদ্ধে স্কোয়ার কাট স্কোয়ার ড্রাইভ এবং লেগ গ্লান্স।

এই বছরেই সেই বিতর্ক, আন্ডারআর্ম বোলিং, গ্রেগের বিতর্কিত চরিত্রে আরও একটি পালক। গ্রেগ পরে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, অতিরিক্ত ক্রিকেটে জেরবার হয়ে ওইভাবেই প্রতিবাদ করেন। এবং, তিনি অত্যন্ত দুঃখিত যে, শেষ বলে ব্রায়ান ম্যাকেঞ্জির বিরুদ্ধে ট্রেভর চ্যাপেলকে আন্ডারআর্ম বল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে। কিন্তু প্রতিবাদের থিওরি যেন ঠিক খাটে না। যেন বোঝাই যায়, কোথাও একটা গোলমাল বেধেছে।

চ্যাপেল আসলে চাপ নিতে পারেননি। প্রথম ভুল করেন লিলিকে ৪৯তম ওভার দিয়ে। ফলে শেষ ওভারের জন্য ভাই ট্রেভর চ্যাপেলের হাতেই বল তুলে দিতে হয়। হেডলি আর স্মিথ রান তুলে ফেলছিলেন, ২ বলে ৭, এই অবস্থায় ট্রেভরের স্লোয়ার বলে বল নিচু হয়ে গিয়ে লেগ মিডল ভেঙে যায় স্মিথের। শেষ বলে ৬ করলে টাই, এই অবস্থায়, গ্রেগ মিড অন থেকে ট্রেভরকে বলেন, ‘ছেলেবেলায় যে তুমি আন্ডারআর্ম বল করতে, এখনও সেটা পারবে করতে?’ ট্রেভর চমকে যান।

তখন গ্রেগ জোর করেন। আম্পায়ারকে জানান যে, ব্রায়ান ম্যাকেঞ্জিকে জানাতে হবে যে, ট্রেভর চ্যাপেল শেষ বলে আন্ডারআর্ম করবেন। আন্ডারআর্ম? ক্রিকেটের নিয়ম? ও মা! এমসিসির এতদিনের নিয়মে কেউ এটা নিয়ে ভাবেনি। শুধু লেখা আছে, ডেলিভারি স্ট্রাইডে এসে কনুই ভাঙলে চলবে না। নিয়ম তো কেউ ভাঙেনি। কিন্তু এটা কি ভদ্রলোকের খেলা? নিয়মই কি সব? সব নয়, কিন্তু নিয়ম মেনেই কেউ অন্যায় সুবিধা নিলে তখনই নিয়মটাকে পাল্টাবার কথা ওঠে, ভুল করে মানুষ শেখে। গ্রেগ তো হাবুল নন, নিয়ম জানতেন, ভাঙেননি, কিন্তু অন্যায় সুবিধা নিয়েছেন। নিয়মের মধ্যে থেকে জিতেছেন তাই হয়তো তৎক্ষণাৎ তাঁর মনেও হয়নি অন্যায়। তবুও প্রশ্ন তো থেকেই গেল। এর পরেই এমসিসি নিয়মটাকে পাল্টালো। একদিনের ম্যাচে বল করার সময় কাঁধের নিচে হাত নামতে পারবে না, এইটাই সংশোধনী হিসাবে ব্যবহৃত হল।

ওই ঘটনার পর শুধু এমসিসি কেন, অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টেও ঝড় ওঠে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী তীব্র নিন্দা করেন।

সহখেলোয়াড়দের মধ্যে উইকেট কিপার রডনি মার্শ বুঝতে পেরে বারণ করেছিলেন। অ্যালান বর্ডার পরে বলেন, মিড উইকেট থেকে ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। কিন্তু বয়স কম, মাথা নাড়া ছাড়া কিছু করতে পারেননি। লিলি বা থমোর কথা শোনার জায়গাতেই ছিলেন না তাঁরা। গড়িয়ে দেওয়া বলে ব্যাট লাগিয়ে ম্যাকেঞ্জি ব্যাট ছুঁড়ে ফেলে দেন। রিগ্রেট! খেদ প্রকাশ করেই যদি সবকিছু মিটে যেত। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জন্য গ্রেগ আর মাঠে দাঁড়াননি।

অবশ্য অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড বা প্রতিবাদ তিনি আগেও করেছেন। ১৯৭৯-৮০র পাকিস্তান সফরের প্রথম টেস্ট স্পিনিং উইকেট ছিল। কিন্তু তারপর যেন কংক্রিক্টের স্ল্যাব। খটখটে ব্যাটিং উইকেট। ফয়সলাবাদ টেস্টে গ্রেগ নিজে করেছিলেন ২৪৫ কিন্তু এরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্রিকেটের পরিপন্থী উইকেটের জন্য পাকিস্তানের ইনিংসে মার্শ ছাড়া সবাইকে দিয়ে বল করিয়ে প্রতিবাদ রাখেন।

ক্রিকেট থেকে মাথা সরতে শুরু করেছে তদ্দিনে গ্রেগের। ১৯-৮২-৮৩ তে পরপর সাতটা শূন্য করলেন পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে যাওয়া বন্ধ করলেন। অধিনায়কত্ব গেল কিম হিউজের কাছে। ১৯৮৩-৮৪-তে পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ টেস্ট খেলতে নেমে নিজের ২৪তম টেস্ট সেঞ্চুরি করলেন সরফরাজ নওয়াজ, আজিম হাফিজ আর আব্দুল কাদিরের বিপক্ষে। তারই মাঝে ব্র্যাডম্যানকে টপকে অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। এই ইনিংসে আব্দুল কাদিরের বিরুদ্ধে কভার ড্রাইভগুলো এখনও ফটোফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো।

এর পরে আজহারউদ্দিন এবং অ্যালিস্টার কুকও নিজের প্রথম এবং শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন অবশ্য।

ব্যাটসম্যান গ্রেগের যদি মূল্যায়ন করতে বসি, তাহলে সত্তর এবং আশির দশকের সেরা ব্যাটসম্যানদের ধরে নিতে হয়। একটা জিনিস দেখা যায়, এই সময় ফাস্ট বোলিং-এর সেরা সময়। স্নো, উইলিস, বথাম, লিলি, থমসন, ওয়াকার, রবার্টস, গার্নার, হোল্ডিং, মার্শাল, ক্রফট, ড্যানিয়েল, ইমরান, সরফরাজ, হেডলি, কপিল দের সময়। স্পিনার বলতে ডেরেক আন্ডারউড, প্রসন্ন, বেদী, চন্দ্রশেখর, আব্দুল কাদিরের সময়।

এই সময় দাঁড়িয়ে সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যানের মধ্যে সেরা গড় গ্রেগের। মিয়াঁদাদ, গাভাসকার, বয়কট বা রিচার্ডসের থেকেও ভালো। প্যাকার সিরিজের আগে ধরলে যে গড়টা ছিল ৫১.২, সেটাই প্যাকার সিরিজ থেকে মূলস্রোতে ফিরে এসে ৫৪.৭৮। অথচ এই সময়েই করেছেন সাতটা শূন্য। সেই হিসেবে দেখতে গেলে ওই কালিমাটুকু বাদ রাখলে ব্যাটসম্যান গ্রেগের অফ ফর্ম আসেইনি প্রায়। ইংল্যন্ডের বিরুদ্ধে বলা হয় গ্রেগের রান কম। কিন্তু সেই কম রানের গড়ও ৪০এর কোটায়। একমাত্র উপমহাদেশের সফরে স্পিন সহায়ক পাল্টা উইকেটেও ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন গ্রেগ।

খেলা ছাড়ার পরে? ক্রিকেট ছাড়লেও গ্রেগকে ক্রিকেট ছাড়ল না। যে ক্রিকেট-বিজ্ঞান ব্যবহার করে তিনি সেই ১৯৭২ থেকে রানের পর রান করে গিয়েছেন তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। তাবড়ো তাবড়ো ব্যাটসম্যানরা তাঁর কাছে আসত টিপসের জন্য। ম্যাথু হেডেন যে খেলা শুরুর আগে উইকেটের সামনে বসে মনে মনে একটা সম্পূর্ণ ইনিংস খেলে ফেলতেন, তাও গ্রেগের টিপস। পেস বোলিং নিয়ে জেরবার আজহার বাউন্স সামলাতে ওপেন স্টান্সে দাঁড়াতে শুরু করলেন, গ্রেগের পরামর্শেই। আর সৌরভের সঙ্গে গ্রেগের সম্পর্কের ব্যাপার তো কিংবদন্তি।

২০০৪, অস্ট্রেলিয়া যাবে সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বাধীন ভারত। তার আগেই দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিজয়রথ থামিয়ে দিয়েছে কুম্বলেবিহীন ভারতীয় দল। এবার অস্ট্রেলিয়ার ওয়র্ন নেই। কিন্তু তা বলে কি বোলিং আক্রমণ ফেলনা! অস্ট্রেলিয়া বলে কথা।

সৌরভকে আবার সহজপাঠে ফেরালেন গ্রেগ। বেরিয়ে যাওয়া বল খেলার সময় আগে থেকে ওপেন হয়ে যাচ্ছেন সৌরভ। গ্রেগ বাঁ পায়ের পাতা ঘুরিয়ে নিতে বললেন, বাঁ পায়ের আঙুলগুলো ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের দিকে থাকবে, কনুই আম্পায়ারের দিকে, ফলে বল খেলার সময় সাইড অন থাকতে পারবেন। ফলস্বরূপ সিরিজের প্রথম টেস্টে স্যাঁতসেঁতে গাব্বার উইকেটে গাঙ্গুলির অপ্রতিরোধ্য ১৪৪। সেটাই বোধহয় সিরিজের নাড়া বেঁধে দিয়েছিল। দ্রাবিড়, লক্ষ্মণ, আগরকর, শেহবাগের উপর ভর করে টেস্ট সিরিজ ড্র করল ভারত, অস্ট্রেলিয়ার চোখে চোখ রেখে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই, চ্যাপেলকে পরবর্তী ভারতীয় কোচের ইন্টারভিউতে ভেটো প্রয়োগ করে ভারতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত করলেন গাঙ্গুলি। তারপর?

তারপরের ঘটনা গসিপ রচয়িতাদের কলমে হু-হু করে বেরিয়েছে। গাঙ্গুলি মুখ খুলেছেন, শেহবাগ, যুবরাজ, হরভজন, জাহির, এমনকি টেন্ডুলকারও মুখ খুলেছেন। দ্রাবিড় কিছুই বলেননি। বলেনও না বোধহয়, ক্রিকেটীয় ব্যাপারস্যাপার ছাড়া। তবু যদি একবার ফিরে দেখি ঘটনাপ্রবাহের দিকে।

একটা ব্যাপার আমাদের বুঝে নেওয়া উচিত যে, দুই সেঞ্চুরি দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেও টেস্টে গাঙ্গুলির রান করার ফল একটা সময় প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। হয় তিনি খাটছিলেন না, অথবা অধিনায়কত্ব সময় নিয়ে নিচ্ছিল। যে কারণই হোক না কেন, টেস্টে ব্যাটে রান আসছিল না। চ্যাপেল যখন ২০০৫-এ কোচ হয়ে এলেন তখন বিশ্বকাপের মাত্র দুবছর। এসে রোগটা ধরলেন, কিন্তু সঠিক ডাক্তারের মতো তার চিকিৎসা না করে সরাসরি সার্জারির চিন্তা করলেন। সময় কম, তার মধ্যে রেজাল্ট দিতে হবে।

কিন্তু, ভারতীয় স্টার সিস্টেমে কেউ কারও উপর মতামত চাপিয়ে দেয় না। আর এটা মনে করে নেওয়া হয় যে, আমি তোমার কোনও কাজ করে দিলে তুমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। সংঘাত অবশ্যম্ভাবী ছিল, জিম্বাবোয়েতে যা ঘটল তা ঘটত-ই। চ্যাপেলের ইনিয়েবিনিয়ে বলা আসে না। গাঙ্গুলি ভাবতেও পারেন না যে, যাঁকে তিনি নিজে উপযাচক হয়ে নিয়ে এলেন, তিনিই তাঁকে মার্জিনে ঠেলে দিতে চাইবেন।

আসলে ক্রিকেট মাঠে কৃতজ্ঞতা, বন্ধুত্ব এগুলো ম্যাটার করে না। যেখানে রেজাল্টনির্ভর অস্তিত্ব। কিন্তু সেটা অস্ট্রেলিয়ায়, ভারতে যে দুজন বিদেশি কোচ সফল, তাঁরা উভয়েই কূটনীতিক পদ্ধতিতে সফল। ক্রিকেটারদের প্রাপ্তবয়স্কদের মতো ধরে নিয়ে, তাঁদের ইগোকে সম্মান দিয়ে কাজ করেছেন বলেই জন রাইট বা গ্যারি কার্স্টেন সফল। বর্তমানে রবি শাস্ত্রীও। কিন্তু ভারতীয় সিস্টেম গ্রেগ চ্যাপেল কেন, অনিল কুম্বলেকেও হজম করতে পারে না। অবশ্য দুজনেরই বোঝার কথা যে, কোচ নয়, ক্যাপ্টেনই মূল কথা।

গ্রেগ খুব বড় মাপের কোচ, কিন্তু নিজের ছ-ফুট দু-ইঞ্চির ইগোর কারণে ম্যানেজার একেবারেই ভালো নন। হাই পারফরম্যান্স কোচ এবং অবজার্ভার হিসেবে এর পরেও সমস্যায় পড়েছেন। ২০১২-তে অস্ট্রেলিয় ড্রেসিং রুমে ঢোকাই তাঁর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কার দোষ কার গুণ এসবের মধ্যে না গিয়ে সোজা কথা, এই ইস্যুটা আরও ভালো করে সামলানো যেত। সৌরভ গাঙ্গুলি যেমন থেকে থেকেই বিষোদ্গারর করেন, চ্যাপেল ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে বলেওছেন যে, পরিস্থিতি সঠিকভাবে হ্যান্ডল করেননি।

যদিও বিশ্বাস করি ব্যাটসম্যান সৌরভের আখেরে লাভই হয়। ফিরে আসার পরে টেস্টে সেরা ব্যাটিং করছিলেন। তাঁর অবসরের ক্ষেত্রেও ভারতীয় বোর্ড খুব খারাপভাবে সামলেছে ঘটনাপ্রবাহ।

সে অন্য কথা, গ্রেগে ফিরে আসি। যে কারণে গ্রেগকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত, সেটা তাঁর বই, ‘গ্রেগ চ্যাপেল অন কোচিং’ বা তাঁর ওয়েবসাইট চ্যাপেলওয়ে ডট কম পড়ে। আধুনিক ক্রিকেটের একনিষ্ঠ সেবক গ্রেগকে উটকোআটকা কারণে নয়, ক্রিকেট-বিজ্ঞানী হিসাবে স্মরণে রাখা উচিত।

অবশ্য কিছুটা হলেও, ভারতের ২০১১-র বিশ্বকাপ জয়েও তাঁর অবদান লক্ষ করা যায়। রান তাড়া করে কীভাবে ভেঙে নিতে হয়, সেটা গ্রেগের সময় থেকেই শুরু হয়। ফিল্ডিংকে সঠিক গুরুত্ব দেওয়া অথবা স্টার সিস্টেম খতম করার চেষ্টা করাটাও গ্রেগের অ বদান। এর সঙ্গেই ইরফান পাঠানকে অলরাউন্ডার বানানো বা মুনাফ প্যাটেলের পেস কমিয়ে শুধুমাত্র লাইন অ্যান্ড লেন্থ বোলার করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও কি তাঁর অবদান নেই? আসলে পরীক্ষা নিরীক্ষা একেবারে কম বয়সে হলেই ভালো। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিনিশড প্রোডাক্ট নমনীয় হয় না, তাকে মুড়তে গেলে ভেঙে যাবার সম্ভাবনা।

ফিরে যাই ক্রিকেট-বিজ্ঞানী গ্রেগের কথায়।

গ্রেগের কথা শুনলে রিফ্লেক্স অ্যাকশনেরও ব্যাখ্যা আছে। বোলার বল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটসম্যান যেভাবে বলটি খেলতে যান সে যেন ঠিক ফ্রেড অ্যাস্টেয়ার বা জিন কেলির নাচ। সংগীতের তালে তালে পা আপনিই দোলা লাগায়। চিন্তাভাবনার পদ্ধতিকে খালি অনুশীলনের মাধ্যমে তৈরি করে সঠিক প্রয়োগ করতে পারলেই ব্যাট করা আর ‘অ’-‘আ’ লেখার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।

গ্রেগ বলেছেন, আধুনিক ক্রিকেটে ব্যাকলিফটের আলাদা করে কোনও অস্তিত্ব নেই। কব্জির মোচড়, উপরের হাতের কনুই ভাঙা আর কাঁধ লক করার সাযুজ্যের মাধ্যমেই ব্যাটিংটা আয়ত্তে আনা সম্ভব। সেই কথা মেনে ভারী ব্যাট আর আগে থেকে ব্যাট তুলে দাঁড়ানোটাই আধুনিক ব্যাটিং-এ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রেগ অনুশীলনের উপর জোর দিয়েছেন। কারণ মনে করেন যে ক্রিকেটে ব্যাটিংই একমাত্র খেলা, যেখানে স্বাভাবিকভাবে কোমরের কাছাকাছি আড়াআড়ি র‌্যাকেট বা ব্যাট চালানোর পরিবর্তে লম্বালম্বিই চালাতে হয়।

সিম মুভমেন্টের ক্ষেত্রেই আগেকার হিসেবে বাঁ হাতের ভিতর থেকে দেখার কনসেপ্টেও বাধ সাধলেন গ্রেগ। বললেন, যেভাবে হাতকে সর্বোচ্চ অবস্থায় তর্জনী ও মধ্যমা পাশাপাশি রেখে বোলিং-এ ঘোরানো যায়, সেটাই বোলারের অ্যাকশন। হাত সোজা করতে হবে, নন-বোলিং আর্মকে সঠিক অবস্থায় নিতে হবে, এগুলো বাহুল্য। মোদ্দা কথা হল স্বাভাবিকভাবে যে জিনিস স্বত:স্ফূর্তভাবে আসে তাকেই গুরুত্ব দেওয়া এবং তার ভিত্তিতে ব্যাকরণ তৈরি করা। কিন্তু সেক্ষেত্রেও ফাঁক ছিল না কি? শেহবাগকে ফুটওয়ার্ক শেখাতে যাওয়ার মতো গড়বড়ে কাজ বোধহয় আর দুটো হয় না।

সে যা হোক, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় সাফল্য ব্যর্থতা উভয়ই আসে, কিন্তু এর থেকে যে মতবাদ বা থিয়োরির জন্ম হয় সেটাই খেলাটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়, বাঁচিয়ে রাখে।

গ্রেগ এক অদ্ভুত এনিগমা, যিনি সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে চাননি। আবার সাধারণ মানুষকে নিয়েও বাঁচতে পারেননি।

অথচ এক্সিলেন্সের পথে গ্রেগের দেখিয়ে দেওয়া পথে আজও কত কত ক্রিকেটার নিজেদের তৈরি করে চলেছে। গ্রেগ ব্লিউয়েট থেকে বর্তমানে ইংল্যান্ডের ওপেনিং ব্যাট ররি বার্ন্স, সকলেই গ্রেগের দেখানো পথে নিজের স্বাভাবিকত্ব বজায় রেখে সাফল্য লাভ করেছেন, করছেন।

৪৮ বছর আগে হোবার্টের ড্রেসিং রুমে গ্রেগ চ্যাপেল একটা পদ্ধতির জন্ম দিয়েছিলেন। যার ভিত্তিতে নিজের টেস্টে ব্যাটিং অ্যাভারেজ ছিল প্রায় ৫৪। যার ভিত্তিতে আধুনিক ব্যাটিং বা বোলিং এমসিসি ম্যানুয়াল থেকে বেরিয়ে শ্বাস নিতে পারছে। শুধু সৌরভ এপিসোড নয়। ভিক্টর রিচার্ডসনের মেজো নাতি, যাঁকে রিচার্ডসনের মতোই দেখতে বলা চলে, তাঁর অবদান ফল্গুধারার মতো ক্রিকেট নামক আধুনিক খেলাকে এগিয়ে নিয়ে চলবে। বছরের পর বছর। আর সৌরভ-এপিসোড আমাদের সেই চিরকেলে ম্যানেজমেন্টের শিক্ষাটি দিয়ে যাবে, মৌচাকে ঢিল ছুড়লেই মধু মেলে না।

কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link