‘আমি যা অনুভব করি তা হল গর্ব, গর্ব, গর্ব।’ – এভাবেই অ্যাথেন্স সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য, অসম্ভাব্য, চমকপ্রদ বিজয় উদযাপন এর মুহূর্তে মারিয়া কোকিনো নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের এক সাংবাদিকের সাথে কথা বলার সময় এভাবেই নিজের অনুভূতির জানান দিচ্ছিলেন মারিয়া কোকিনো।
মারিয়া এবং তার দেশবাসীরা যা দেখেছে তা কল্পনা করাও ছিলো কঠিন। ইউরো ২০০৪ এর আগে গ্রিস ছয়টা ম্যাচ খেলে যার মধ্যে পাঁচটায় হেরে যায় তারা, একটা ড্র করে। তাদেরকে ইউরো ইতিহাসের সবথেকে বাজে দলগুলোর একটিই বলা হচ্ছিল।
তাদের যে বাধাগুলি অতিক্রম করতে হয়েছিল তা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ, ইউরো ২০০৪ একটি উচ্চ-মানের টুর্নামেন্ট যা ওয়েন রুনি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মতো ভবিষ্যতের আইকনদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ হিসেবে কাজ করেছিল।যেই টুর্নামেন্ট একে সাথে কয়েকটা ইউরোপের গোল্ডেন যুগের সাক্ষী ছিলো তার মধ্যে ছিলো পর্তুগাল,ইংল্যান্ড,সুইডেন,ডেনমার্ক তারই সাথে আরেকটা সারপ্রাইজ প্যাকেজ ছিলো চেক রিপাবলিক।
গ্রিস এই টুর্নামেন্টে প্রবেশ আন্ডারডগ হিসেবে প্রবেশ করে। কিন্ত, টুর্নামেন্টের ফলাফল সবাইকে অবাক করে দেয়। তারা যা অর্জন করেছিলো সেই অর্জনের ধারেকাছেও যেতে পারেনি পূর্ববর্তী চ্যাম্পিয়ন্স ফ্রান্স। চেক রিপাবলিকের গ্রেট এন্টারটেইনার কিংবা ইংল্যান্ডের গোল্ডেন জেনারেশন যা করতে পারেনি তা তারা করে দেখিয়েছে। তারা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নদের সবচেয়ে অত্যাশ্চর্য মুকুট জয় করেছে।
এস্তাদিও দা লুজ এর ফাইনালে যাওয়ার আগে তাদের ১১ কম্পিটিটিভ ম্যাচে মাত্র ১১ গোল হজম করে তারা। গড়ে প্রত্যেক ম্যাচে ৪৮টি ট্যাকেল করে, এরই সাথে এই টুর্নামেন্টে হাফ টাইমের পর মাত্র এক গোল হজম করে তাঁরা।
যখনই কোনো প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের পায়ে বল যেতো তখনই কোনো না কোনো গ্রিক ফুটবলার তাদের পাস দিতে বাধা দিতো,তাদের দমিয়ে দিতো। তারা কার্যকরভাবে শুরু থেকেই গভীরভাবে খেলছিল, তাদের গেম প্ল্যানে ছিল: ডিপ ডিফেন্ড, হাই প্রেস।এমনকি নবম মিনিটে গ্রিক ডিফেন্ডাররা কার্যকরভাবে সময় নষ্ট করতে থাকে। গ্রিকরা সেট পিস এবং লম্বা থ্রোতে জোর দিয়েছিল কারণ এই টুর্নামেন্টে তাদের বেশিরভাগ গোল হজম করতে হয়েছিল ক্রস থেকেই।
অটো রেহাগেল কীভাবে তার দলকে খেলতে চেয়েছিলেন তার একটি নিখুঁত প্রমাণ মিলে ১৯তম মিনিটে।পর্তুগাল একটি কুইক ফ্রি কিকে ইয়াং রোনালদোর দিকে ডি বক্সে বল বাড়িয়ে দেও।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তিনি সাত গ্রিক ডিফেন্ডার দ্বারা পরিবেষ্টিত হন। এতোটাই প্যাশনেট ছিলো গ্রিকরা।
প্রতিটি ট্যাকল, প্রতিটি প্রেস, প্রতিটি ব্লক এই জ্ঞান দিয়ে তৈরি ছিল যে একটি ভুল এবং তাদের স্বপ্নভঙ্গ হতে পারে।কোন অহংকার বা কৌশল ছিল না বা বিভ্রমের মহিমা ছিল না গ্রিসদের মাঝে।তাদের কোচকে ডাকা হতো রাজা অটো রেহাগেল নামে।যার প্রতিটি আদেশ পালনে সচেষ্ট ছিল তাঁর দল।
ক্লাসিক গ্রিসের উইনিং গোলের জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না পর্তুগাল। নকআউট পর্বে গ্রিসের দুটি গোলই এসেছে বক্সের ক্রস থেকে। প্রথমে কোয়ার্টারে ফ্রান্সের বিপক্ষে হেডারে গোল করেন অ্যাঞ্জেলোস ক্যারিস্টিয়াস,অপরদিকে সেমিফাইনালে হেডার করে চেকদের মন ভেঙে দেন ডিফেন্ডার ট্রায়ানোস ডেলাস।
ফাইনালের এই গোলটিও ছিলো একই রকমের।তার স্বদেশী স্ট্রাইকার ক্যারিস্টিয়াস এর মাথায় একটি নিখুঁত আউট-সুইং বল বাড়িয়ে দেন বেসিনাস। হারকিউলিস, পার্সিয়াস, অ্যাকিলিস এবং এখন ক্যারিস্টিয়াস চিরকালের জন্য গ্রীক পুরাণে অমর হয়ে যান।
সাইডলাইনে, স্কলারি শুধু সেখানে দাঁড়িয়ে, হতবাক। খেলা চলাকালীন কোনো সময়েই লুইস ফিগো, রুই কস্তা এবং ডেকোর মতো প্রতিভাবান প্রজন্মের খেলোয়াড়দের নেতৃত্বে পর্তুগাল জয়ের জন্য মরিয়া দলের তাগিদ নিয়ে খেলেনি।এর কারণেই তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে পথ হারিয়ে ফেলে।
তাদের সমর্থকরা প্রত্যাশা করেছিল যে কোনো ম্যাজিকাল কিছু ঘটবে।কিন্ত তেমন কিছুই ঘটেনি।তাদের নায়ক ফিগোকে হেনরি ডেলাউনি ট্রফি তুলতে দেখার পরিবর্তে, তারা ইউসেবিওকে সেন্টার সার্কেলে কাঁদতে দেখে।
এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই, এটা ছিল গ্রিকদের দিন এবং এই ম্যাচের কোন সময়েই তারা হেরে যায়নি।তারা পুরো ৯৫ মিনিটের ম্যারাথনের জন্য দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ ছিল।
২০০০ মাইল দূরে এস্তাদিও দা লুজ এ চূড়ান্ত বাঁশি বেজে উঠলে, অ্যাথেন্সের রাতের আকাশ আতশবাজি দ্বারা আলোকিত হয়, অ্যাক্রোপলিস কামানের আগুনে প্রতিধ্বনিত হয়। এত বছর পরও এটি ইউরোর ইতিহাসে সবচেয়ে অসাধারণ জয়গুলির মধ্যে একটি।