ব্যর্থতার অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্সে যারা বন্দি থাকে – জীবনটা তাদের জন্য বিরক্তির এক অধ্যায়ের মতই। অনেকেই আবার এই ব্যর্থতার পরবর্তী পরিচ্ছেদটা পড়ে দেখতে চান; হার না মেনে ঘুরে দাঁড়ানোর আরেকটা গল্পে নিজেকে খুঁজে পেতে চান। সমালোচনা কিংবা ব্যর্থতার বৃত্ত থেকেই বেরিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প কম নয়। আর সেই গল্পের-ই সর্বশেষ সংযোজন হার্দিক পান্ডিয়া।
স্রেফ যে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন এমন নয় – সমালোচনার অধ্যায়টা মুছে দিয়ে সফলতার মঞ্চে করেছেন বাজিমাত। ফিটনেস সমস্যা, অফ ফর্মে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেরাটা দিতে পারবননি। বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারতের ভরাডুবিতে সমালোচিত হয়েছেন অনেক। দলের বাইরেও ছিলেন কিছু সময়। এরপর ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) পঞ্চদশ আসরের মেগা নিলাম। প্রথমবারের মত আইপিএলের মঞ্চে নাম লেখালো গুজরাট টাইটান্স। নিলামের আগেই ড্রাফট থেকে দলে ভেড়ানো হল হার্দিক পান্ডিয়াকে।
এর আগে অধিনায়কত্ব করেননি কখনোই। কিন্তু সেই গুরুদায়িত্বটাই তুলে দেওয়া হল হার্দিকের কাঁধে। নতুন করে সমালোচনার শুরু। নতুন দল, আনকোরা অধিনায়ক – গুজরাট যেন শুরুর আগেই পিছিয়ে গেছেন। হার্দিকের হাত ধরে বেশিদূর যেতে পারবে না গুজরাট – এমনটাই সমালোচকদের ধারণা ছিল। তবে বাস্তব চিত্রে দেখা গেল তার ঠিক উল্টোটা। অফ ফর্ম আর ব্যর্থতার সব সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে প্রথমবার অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়ে দলকে শিরোপা এনে দিলেন হার্দিক পান্ডিয়া।
ব্যাট হাতে দেখা মিলল চিরচেনা আগ্রাসী পান্ডিয়ার; বল হাতে ছিলেন বেশ উজ্জ্বল। আসরের শুরু থেকেই গুজরাট অপ্রতিরোধ্য দল হিসেবেই ছিল পয়েন্টস টেবিলের শীর্ষে। শরীরী ভাষায় নেই কোনো চাপ কিংবা ক্লান্তির ছাপ; ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং, অধিনায়কত্ব – সব বিভাগেই সেরাটা দিয়ে মেগা মঞ্চটা নিজের করে নিয়েছেন হার্দিক।
রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে ফাইনালে দুর্দান্ত জয়ে শিরোপা জয়; ফাইনালের সেরা পারফরমারও হার্দিক পান্ডিয়া। বল হাতে একাই ব্যাকফুটে ঠেলে দেন রাজস্থানকে। রাজস্থানের সেরা তিন তারকা জশ বাটলার, সাঞ্জু স্যামসন আর শিমরন হেটমায়ারকে নিজের শিকার বানিয়ে ফাইনালেও দাপটের ছাপটা লেপ্টে দেন। ৪ ওভারে ১৪ ডটে মাত্র ১৭ রানের বিনিময়ে নেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৩ উইকেট।
সহজ এক লক্ষ্যমাত্রা, ঘরের মাঠ; লাখের বেশি দর্শক তাকিয়ে। শুরুতেই দুই উইকেট হারিয়ে খানিকটা চাপের মুখে গুজরাট। ব্যাট হাতেও আবার ত্রাণকর্তা হিসেবে আসলেন হার্দিক। চাপের মুখে খেললেন ৩৪ রানের অসাধারণ এক ইনিংস; দলের জয়ে ব্যাটে বলে রাখলেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। মেগা মঞ্চে বনে গেলেন ম্যাচ সেরাও।
ঘরের মাঠ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম; লাখো ক্রিকেট সমর্থকদের সামনে নিজেকে প্রমাণ করলেন হার্দিক। সব সমালোচনা আর শঙ্কা দুমড়ে মুচড়ে মেগা মঞ্চেই বাজিমাত করলেন এই অলরাউন্ডার।
পঞ্চদশ আসরের মেগা নিলামের আগে হার্দিককে ছেড়ে দেয় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। অফ ফর্মে থাকা কাইরন পোলার্ডকে ধরে রাখলেক হার্দিকের উপর ভরসা করতে পারেনি মুম্বাই। মুদ্রার এক পাশে পোলার্ড চরম ব্যর্থ, মুম্বাইয়ের ভরাডুবি। ঠিক আরেক পাশে ট্রফি উঁচিয়ে জবাবটা দিয়েছেন হার্দিক।
১৫ ম্যাচ; ৪৮৭ রান; ১৩১ স্ট্রাইক রেট; ৪৪.২৭ গড়; ৪ ফিফটি; ৮ উইকেট; ৭.২৮ ইকনমি – আসরের সেরা অলরাউন্ডার বলতে কোনো বাঁধা নেই। দলের হয়ে সর্বোচ্চ আর এবারের আসরের চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি।
ফাইনালের মঞ্চে ‘ব্যর্থতা’ শব্দটা কখনোই কানে বাজেনি হার্দিকের। আইপিএল ইতিহাসে পাঁচবার উঠেছেন ফাইনালের মঞ্চে। হার্দিকের ফাইনাল খেলা মানেই যেন প্রতিপক্ষের জন্য অশনি সংকেত। এই পাঁচবারই তিনি উঁচিয়ে ধরেছেন শিরোপা। তবে এবারেরটা বেশ ভিন্ন; অধিনায়ক হিসেবে প্রথম আসর, এই প্রথম আসরেই তিনি জিতিয়েছেন দলকে।
মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে – প্রবাদটা হার্দিকের জন্য অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। হার্দিকের ফর্মহীনতা নিয়ে অনেকে ভয় করলেও তিনি এসব নিয়ে বিচলিত হননি। সমালোচনার কালো ছায়া সরিয়ে ঠিক খুঁজে পেয়েছেন সফলতার আলো।
আইপিএলের মেগা মঞ্চটা জয়ের পর এই অলরাউন্ডারের চোখ এবার অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। তাসমান পাড়ের দেশটিতে বিশ্বকাপের মঞ্চে এবার দাপুটে এক প্রত্যাবর্তনের পালা। আইপিএল ট্রফি জিতে তিনিও সেই ঘোষণাই দিয়েছেন। সাফ বলে দিয়েছেন, অন্তত পাঁচটা আইপিএল ট্রফি আর দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিততে চান।
আর এখানেই যেন লুকিয়ে আছে আইপিএলের সৌন্দর্য্য। পান্ডিয়া ছিলেন আইপিএলের আবিস্কার। সেখান থেকে তিনি আইপিএলের অন্যতম অলঙ্কারেই পরিণত হয়েছেন। তাই শত সমালোচনার পরও আইপিএল অধ্যায় দীর্ঘায়িত হচ্ছে, সামনেও হবে।