প্রায় অপরাজেয় হয়ে ওঠা একটি দল। অপরদিকে কাগজে কলমে গ্রুপের সবচেয়ে দুর্বলতম দল সৌদি আরব। আর্জেন্টিনা নিমেষেই তাদের উড়িয়ে দিবে- এমন ভাবনার আত্মবিশ্বাসে তুঙ্গে ছিল পুরো বিশ্ব। কিন্তু সব সমীকরণ পাল্টে গিয়ে কাতার বিশ্বকাপের প্রথম অঘটনের শিকার হলো আর্জেন্টিনা। আরব্য রজনীর ঝংকার তুললো সৌদি আরব।
আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের দিনে সৌদি আরবের হয়ে গোল পেয়েছেন আল শেহরি আর আল দাওসারি। তবে সৌদি আরবকে এমন পাল্টে দেওয়ার নেপথ্যে ছিলেন কোচ হার্ভি রেনার্ড।
২০০৬ এর পর দীর্ঘ এক যুগের অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছিল সৌদি আরব। ২০১৮ এর সে বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডেই সৌদি আরব বিদায় নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মিশরকে হারিয়ে গ্রুপ পর্বে তৃতীয় হয়ে বিশ্বকাপ অভিযান শেষ করেছিল তারা। আর সেই বিশ্বকাপের পরেই সৌদির কোচ হয়ে আসেন রেনার্ড।
এসেই দলটাকে বদলে দিয়েছেন নিজের সমস্ত অভিজ্ঞতা ঢেলে। খেলোয়াড়দের জন্য নির্দিষ্ট করে কাজ করেছেন অনেক। জিম সেশনে খেলোয়াড়দের আলাদা করে গুরত্বারোপ করেছেন তিনি। কারণ বৈশ্বিক ফুটবলের ট্যাকটিসে এগোতে হলে ফিটনেসের বিকল্প নেই। রেনার্ডের এই কাজ ফলেও দিয়েছে বেশ। চার বছর আগের সেই সৌদি আরব এবার রীতিমত দুর্দান্ত। আজকের ম্যাচের পর তাদের জন্য দুর্দান্ত শব্দটা মোটেও অতিরঞ্জিত নয়। কারণ বিশ্বকাপের মতো আসরে এসে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দেওয়াটাকে দুর্দান্ত বলতেই হবে বৈকি।
তবে, কোচ হিসেবে আর্জেন্টিনাকে হারানোই রেনার্ডের সেরা সাফল্য নয়। কোচিং ক্যারিয়ারে নয়টি দেশকে সামলেছেন। এর মধ্যে নিজের অর্জনের খাতায় শিরোপাও যোগ করেছেন। জাম্বিয়া আর আইভরি কোস্টকে জিতিয়েছেন আফ্রিকান নেশনস কাপ। ভিন্ন দুটি দেশের কোচ হয়ে আফ্রিকান নেশন কাপ জেতার কৃতিত্ব যা আর কারও নেই।
হার্ভি রেনার্ডের কোচিং ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল ক্লাব ড্রাগুইগানের হয়ে। এরপর একে একে সাংহাই কস্কো, ক্যামব্রিজ ইউনাইটেডের কোচের দায়িত্ব পালন করার পর জাম্বিয়াকে দিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবলের কোচিং আভিষেক ঘটে তাঁর। জাম্বিয়ার হয়ে প্রথমবারে তেমন সফল না হলেও দ্বিতীয় মেয়াদে এসে দেখান চমক। ২০১২ আফ্রিকান নেশন্স কাপে জাম্বিয়ার শিরোপা জেতানোর পেছনে কারিগর তিনিই ছিলেন।
রেনার্ডের সাফল্যযাত্রা সেখানেই থেমে থাকেনি। ২০১৪ সালে আইভরি কোস্টের কোচ হয়ে এসে সেই বছরেই তিনি আবার আফ্রিকান নেশন কাপ জেতেন। আফ্রিকায় নিজের দ্যুতি ছড়ানোর পর ইউরোপে পাড়ি জমান রেনার্ড। ২০১৫ সালে নিজ দেশ ফ্রান্সে ফিরে আসেন। এবার তিনি ফেরেন লিলির কোচ হয়ে।
অবশ্য এক বছর বাদেই লিলি ছেড়ে মরক্কোর কোচিংয়ের দায়িত্ব নেন তিনি। আর রেনার্ড এখানে এসেও নিজের মুনশিয়ানার ছাপ রাখেন। প্রায় দুই দশক পরে মরক্কো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় তাঁর কোচিংয়েই। রেনার্ডের ছোঁয়ায় নতুন করে বেড়ে ওঠা সেই মরক্কোই এখন আফ্রিকার সেরা দল।
মরক্কো ছাড়ার পর সৌদি আরব ফুটবলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন রেনার্ড। যখন তিনি দায়িত্ব নেন তখন সৌদি আরবের ফিফা র্যাংকিং ৭০। আর তিন বছর বাদে সেই দলটার র্যাংকিং ৫১। অর্থাৎ তাঁর অধীনে ১৯ ধাপ এগিয়েছে সৌদি আরব। ঠিক যেন কোনো এক জাদুর পরশে বদলে গেছে দলটা। আর সৌদি আরবের এমন বদলে যাওয়ার নেপথ্যে কিংবা উপমা অর্থে জাদুকর ছিলেন হার্ভি রেনার্ড।
সৌদি আরবের এবারের বিশ্বকাপ যাত্রা কোথায় থামবে তা এখনই বলাটা কঠিন। কিন্তু স্বল্প প্রত্যাশা নিয়ে কাতারে আসা সৌদি আরবের জন্য আজকের এ ম্যাচ জয়ই অনেক বড় উপলক্ষ। দেশটির জন্য ঐতিহাসিক দিনও বলা যেতে পারে। তবে হার্ভি রেনার্ড নিশ্চয় এখানেই থামতে চাইবেন না। নিজের দূরদর্শিতায় সৌদি আরবকে নিশ্চিতভাবেই অনেক দূরে নিয়ে যেতে চান। কারণ শিখরের যাওয়ার অতীত সুখকর অভিজ্ঞতা তো তাঁর আছেই। বিশ্বকাপেও সেই পথে পা বাড়ালে সমস্যা কি!