ফুটবলের দেশে ক্রিকেটের স্বপ্ন

রিও ডি জেনিরো হতে পাঁচশ কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর পোকোস দে ক্যালদোস। শহরটি মূলত শৌখিনদের বসন্তকালীন অবকাশযাপনের জন্য বিখ্যাত। ইদানীং আরো একটা কারণে শহরটি বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত হয়েছে সেটা হলো ব্রাজিলের ক্রিকেট সিটি হিসেবে। সম্প্রতি শহরের মেয়র সার্জিও অ্যাজেভেদো এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আমি পোকোস দে ক্যালদোস নামের শহরের মেয়র, যেখানে বাচ্চারা ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেট খেলতেই বেশি পছন্দ করে।’

ফুটবলের দেশ ব্রাজিলে পোকোস দি ক্যালদোস কিভাবে ক্রিকেটের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল আসুন সেই গল্পই জেনে নেই আজকে।

২০১০ সালে ব্রাজিলে প্রথমবারের মতো এক এতিমখানায় ২৪ জন শিশুকে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে কার্যক্রমের পরিধি। বর্তমানে ‘পথশিশুদের উন্নয়ন’ প্রোগ্রামের আওতায় পুরো দেশজুড়ে ৫ হাজারের অধিক শিশু ক্রিকেটের প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। শিশুদের মাঝে অধিকাংশ মেয়ে। মেয়েদের হাত ধরেই ব্রাজিল ক্রিকেটে এসেছে যুগান্তকারী এক বিপ্লব। সম্প্রতি বিগত চার বছরের পারফরমেন্স অনুযায়ী সেরা ১৫ জন প্রমীলা ক্রিকেটারকে আনা হয়েছে কেন্দ্রীয় চুক্তির আওতায়। তারা স্বপ্ন দেখে ২০২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত প্রমীলা টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নেবার।

কেবল লক্ষ্য নির্ধারণ করে বসে থাকেনি, সে অনুযায়ী কাজও শুরু করে দিয়েছে ব্রাজিল ক্রিকেট বোর্ড। শহরের কেন্দ্রে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ক্রিকেট একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেখানে ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণাতে জোগাতে রয়েছে বিশাল এক ঘড়ি, কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে ২০২৩ বিশ্বকাপের। সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে এ বছরের শুরুতে দক্ষিণ আমেরিকান বাছাইপর্ব প্রথমে উতরে যেতে হবে ব্রাজিলকে।

দক্ষিণ আমেরিকান মহিলা চ্যাম্পিয়নশীপের পাঁচবারের মাঝে চারবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ব্রাজিল। সুতরাং ধরে নেয়া গ্লোবাল কোয়ালিফায়ারে উঠতে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না ব্রাজিলকে। গ্লোবাল কোয়ালিফায়ারের সেরা দুই দল অংশ নেবে ২০২৩ বিশ্বকাপে।

বেশিরভাগ মানুষের কাছে দীর্ঘমেয়াদী স্বপ্ন মনে হলেও ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ম্যাট ফেদারস্টোন এবং দলের অধিনায়ক রবার্তো মোরেত্তি অ্যাভেরি তাদের দলে নেই। অ্যাভেরি বলেন, ‘আমরা থাইল্যান্ডকে অনুসরণ করতে চাই এবং নারী ক্রিকেটে পরবর্তী সাফল্যের গল্প হতে চাই।’

কেন্টের সাবেক ক্রিকেটার ফেদারস্টোন ২০০০ সালে ব্রাজিলে আসেন। ব্রাজিল ক্রিকেট বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতাদের মাঝে একজন তিনি। তার লক্ষ্য বিশাল এই দেশের প্রতিটা প্রান্ত হতে প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের খুঁজে বের করা। ফেদারস্টোনের ভাষ্যমতে, ‘আমরা একটা এতিমখানা থেকে প্রথমে শুরু করেছিলাম। এখন সারা দেশে ৫০ এর বেশি স্কুলে নিয়মিত ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অনেকের জীবন বদলে দিচ্ছে ক্রিকেট। সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুন্দর-স্বাভাবিক জীবন দিতে চেষ্টা করছি আমরা। তারা স্কুলে যাচ্ছে, স্কুল শেষ কলেজ এরপর ভার্সিটিতে যাবে পাশাপাশি ক্রিকেটেও ভবিষ্যত গড়ার চেষ্টা করবে।’

‘একটা সময় শিশুরা এতটাই উৎসাহিত ছিল তারা নিজেরাই একাই চলে আসতো। তবে সবেচেয়ে কঠিন ছিল তাদের বাবা-মাকে বোঝানো যে তাদের ছেলেমেয়েদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত আছে এই খেলায়। অথচ এই খেলার নামই তারা শুনেনি কখনো।’, যোগ করেন তিনি।

দলের বর্তমান অধিনায়ক অ্যাভেরি ছোটবেলায় সব ধরনের খেলাই খেলেছেন। পরবর্তীতে ২০০০ সালে ইংল্যান্ডে চলে যান পড়াশোনা করতে। সেখান থেকে ফিরে ২০১০ সালে দেশে ফিরে জড়িয়ে পড়েন ক্রিকেটের সঙ্গে। ৩৬ বছর বয়সী অ্যাভেরি একজন সত্যিকারের অলরাউন্ডার। ফলের দোকান চালান, জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেন, বিভিন্ন স্কুলে বাচ্চাদের ক্রিকেট শেখান, দিনে চার ঘন্টা হাইপারফরম্যান্স সেন্টারে সময় দেন এবং পাশাপাশি ব্রাজিলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

‘আমি সাত বছর ইংল্যান্ডে থাকলেও সেখানে কখনো ক্রিকেটের সাথে জড়াইনি’, অ্যাভেরি হাসতে হাসতে বলেন। মূলত তার স্বামীর উৎসাহেই দেশে ফিরে খেলাধুলায় আসা। স্বামীর জোড়াজুড়িতে সপ্তাহের ছুটির দিনে সফট বল খেলতে যেতেন। সেখান থেকে স্থানীয় ক্লাব, জাতীয় লিগ হয়ে এখন জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করছেন।

অ্যাভেরির মতো পনেরোজন আইসিসি স্বীকৃত কোচ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় বর্তমানে ব্রাজিলে কাজ করছেন। বেশিরভাগই আছেন পোকোস দে ক্যালদোসের হাইপারফরম্যান্স সেন্টারে। গত কয়েকবছরে ব্রাজিলিয়ান জনগণের মাঝে ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। রিও এবং সাও পাওলোতে কয়েকটি ক্রিকেট ক্লাবও তৈরি হয়েছে। ‘ক্রিকেটে আগ্রহীদের মাঝে বেশিরভাগই হচ্ছেন মেয়ে’, বলেন অ্যাভেরি। ‘ধীরে ধীরে মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মাচ্ছে পেশাদার ক্রীড়াবিদ হতে কেবল ফুটবল খেলতে হয় না। তারা ক্রিকেটকে দেখছে এবং ভাবছে আমি এই খেলাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে পারি।’, যোগ করেন তিনি।

ক্রিকেটের বেশিরভাগ অর্থসাহায্য ব্রাজিলিয়ান সরকার করে থাকলেও বর্তমানে স্পন্সররাও এগিয়ে আসছে। বায়োট্রিট নামের এক মাইক্রোবায়োলজি কোম্পানি এবং ডানসান নামের পোশাকের এক কোম্পানি তাদের মধ্যে অন্যতম। ‘আমরা ভেবেছি স্পন্সর থেকে প্রাপ্ত টাকাটা স্থানীয় কোচ তৈরিতে ব্যয় কররো। যখন বাইরের কোনো দেশ থেকে কোচ আনা হয় তারা এক বা দুই বছর কাজ করেন। এরপর নিজ দেশে ফিরে যান কিংবা অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্য কোথাও চাকরি নেন। এজন্য আমরা ভেবেছি যদি আমরা পর্যাপ্তসংখ্যক ব্রাজিলিয়ান মানসম্মত কোচ তৈরি করতে পারি সেটা হবে আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া’, জানান ফেদারস্টোন। স্থানীয়ভাবে তৈরির সুযোগ না থাকায় ‘দ্য লর্ডস ট্যাভেরনাস’ নামক ব্রিটিশ ক্রিকেট চ্যারিটি খেলাধুলার সরঞ্জাম, কিট, বোলিং মেশিন সবকিছু দিয়ে সাহায্য করছে।

ব্রাজিলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হলো স্থানীয়দের মাঝে ক্রিকেট সংস্কৃতি সৃষ্টি করা এবং স্থানীয়দের স্কোরার, আম্পায়ার, কিউরেটর, মাঠকর্মী হতে উৎসাহিত করা। বাজেট বরাদ্দ অল্প হলেও ব্রাজিলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড হাল ছাড়ছে না, তারা চেষ্টা করছে চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের ভালো বেতন দিতে। যদিও কেমন বেতন পাচ্ছেন তারা সেটা জনসম্মুখে জানানো হয়নি। তবে অলিম্পিকে ক্রিকেট যুক্ত হলে সরকারের কাছে থেকে বড় অংকের টাকা পাওয়ার আশা রাখছে ক্রিকেট বোর্ড। এছাড়া ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পেয়ে থাকে তাঁরা।

চার বছর আগে লরা কারদোসো ভলিবল ছেড়ে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। এখন ১৫ বছর বয়সে ক্রিকেট দলের সবচেয়ে কমবয়সী সদস্য সে। দলের সেরা অলরাউন্ডার সে, তার আইডল এলিসা পেরির মতোই। দলের কোচ লিয়াম কুকের বিশ্বাস লরা যদি আগামীকালও কেন্টে যায় তবেও মূল দলে জায়গা করে নিতে তার বেশিদিন সময় লাগবে না। লরার উঠে আসা ‘ফেলিজ’ নামের কমিউনিটি ক্রিকেট প্রকল্প থেকে। লরা তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার এবং পড়াশোনা সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছে। সে বর্তমানে আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রমী এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ বলেই জানান তার মা অ্যালিন।

লারা বিটেনকোর্ট, লরার চেয়ে তিন বছরের বড়। ক্রিকেট এবং ফুটবলের মাঝে সে নতুন খেলাকেই বেছে নেয়। তিন বছর আগে তার বড় বোন ক্রিকেটের এক পরীক্ষামূলক ক্লাসে যায় এবং সেখানেই প্রথম ক্রিকেট সম্পর্কে জানতে পারেন, ‘আমার বোন আমাকে বলেছিলো এটা কিভাবে খেলতে হয়; একটা ব্যাট, একটা বল এবং হাত সোজা রেখে বল ছুঁড়তে হয়। আমি ২০১৬ সালে কলেজের এক টুর্নামেন্ট দিয়ে ক্রিকেট খেলতে শুরু করি।’

তিনি আরো বলেন, ‘ক্রিকেট আমার কাছে বাড়ির মতো, যেখানে আমি রিল্যাক্স করতে পারি। আমি কেন্দ্রীয় চুক্তির বাইরেও ক্রিকেট খেলার সুবাদে স্কলারশিপ পেয়েছি। এজন্য আমি ক্রিকেটের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি ফিজিওথেরাপি নিয়ে পড়ছি এবং এখানেই ক্যারিয়ার গড়ার কথা ভাবছি যেন ভবিষ্যতে ক্রিকেট বোর্ডে অবদান রাখতে পারি।’

কেন্দ্রীয় চুক্তি বাইরেও ক্রিকেটাররা সবধরনের সু্যোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন হাইপারফরম্যান্স সেন্টারে। হেলথ ইন্স্যুরেন্স, পোশাক, সরঞ্জামের পাশাপাশি মনোবিদ এবং চিকিৎসকদের সেবা পেয়ে থাকেন তারা। পাশাপাশি অন্যান্য খেলায় সফল ব্রাজিলিয়ান ক্রীড়াবিদরা পরামর্শক হিসেবে কাজ করে থাকেন এই ক্রিকেটারদের সাথে। ২০১৬ অলিম্পিকে দশ হাজার মিটারে সোনাজয়ী রবার্তা কারভালহো তাদের একজন।

তিনি এই নারী ক্রিকেটারদের ডাকেন ‘চ্যাম্পিয়ন’ বলে। প্রতিসপ্তাহেই তিনি ক্রিকেটারদের সাথে একটি সেশন করেন; কিভাবে আরো বেশি ফিট থাকা যায়, ফিল্ডিংয়ে উন্নতি আনা যায়, রানিংয়ে আরো দ্রুত হওয়া যায় এসব নিয়ে। জাতীয় পদকজয়ী সাঁতারু ম্যাথিয়াস নেতো কাজ করেন এই দলের মনোবিদ হিসেবে।

তিনি বলেন, ‘তাদের কাউকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনতে হয় না। তারা এই খেলাটাকে পছন্দ করেন এবং তাদের ইচ্ছে খেলাটাকে পুরো দেশের প্রতিটা প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়া। এটা আশ্চর্যের ব্যাপার তারা কেবল খেলাটাকে ভালোবেসে, বিনাবেতনে এভাবে সাহায্য করে যাচ্ছেন।’

বর্তমানে ক্রিকেট বোর্ডের সবচেয়ে চিন্তার ব্যাপার হলো বাৎসরিক ক্রিকেট ক্যালেন্ডার তৈরি করা। করোনা মহামারীর কারণে তাদের বিগত দুই বছরের কার্যক্রম অনেকটাই বাধাগ্রস্থ হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে দক্ষিণ আমেরিকান মহিলা চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারানোর পর থেকে আর কোনো ম্যাচ খেলতে পারেনি তারা। যদিও তারা নিজেদের মাঝে নিয়মিতই ম্যাচ খেলে থাকেন। কিন্তু ফেদারস্টোন মানেন যে নিয়মিত প্রতিযোগীতামূলক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করতে না পারলে ক্রিকেটারদের আগ্রহ ধরে রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশাল টেনিং সেন্টার আছে যেখানে মেয়েরা একত্রে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি থাকতে পারে। বিশাল স্ক্রিন আছে যেখানে মেয়েরা একত্রে খেলা দেখে। আমরা একত্রে ওমেন্স বিবিএল দেখেছি, বিশ্বকাপ ফাইনালও দেখেছি। মহামারী কেটে গেলে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে আশা করি আমরা আবার নিয়মিত ম্যাচ খেলতে পারবো।’

‘আমরা নতুন থাইল্যান্ড হতে চাই, ঐতিহ্যগতভাবে ক্রিকেটোয় জাতি না হয়েও ক্রিকেটে সফল হতে চাই। আগামী পাঁচ বছরের মাঝে বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের মূলপর্বে খেলাই আমাদের লক্ষ্য’, বলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অ্যাভেরি। যদি সবকিছু ঠিকভাবে চলে তাহলে ব্রাজিল হয়তো তাদের বহুল প্রত্যাশিত বিশ্বকাপ খেলতে পারবে এবং তারপর হয়তো দেশের বিভিন্ন শহরের মেয়ররা অ্যাজেভেদোর সাহায্য নিবেন কি করে তার শহরকেও ক্রিকেটের শহর বানানো যায়।

– ইএসপিএন ক্রিকইনফো অবলম্বনে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link