সৌম্য-সংকট

টানা দুই ম্যাচ রান না পেলেই ভাটা পড়ে আত্মবিশ্বাসে। সাবলীলতা দূর হয় ব্যাটিংয়ে। এরপরেও, তাকে মাঠে নামানো হয়। বদলানো হয় ব্যাটিং পজিশন। নির্বাচকদের তাঁকে ঘিরে আশা আর সমর্থন বন্ধ হয়না। বাদ পড়েন না সহজে, পড়লেও অন্য কারো ইনজুরিতে তাঁর উপরেই আস্থা খুঁজে বেড়ান নির্বাচকরা।

সৌম্য সরকারের জাতীয় দলে অন্তর্ভূক্তি নিয়ে কারো মনেই কোনো প্রশ্নের জন্ম নেয়নি বলেই আমার স্পষ্ট ধারণা। যেহেতু, নতুন খেলোয়াড় সুযোগ পাওয়াই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার আওতায় পড়ে।

২০১৪ এর শেষে সুযোগ পেয়ে জিম্বাবুয়েকে যেই দৃষ্টিনন্দন পেরিস্কুপ খেললেন, ওই শটেই ২০১৫ বিশ্বকাপ স্কোয়াডে স্থান দখল হয়ে গেলো। এক শটের এতবড় পুরস্কার সৌম্য নিজেও বোধহয় আশা করেননি।

এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পারফরম্যান্সের বৃহৎ পুরস্কার ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত লাভ করেই যাচ্ছেন সৌম্য। তাই বারবার ব্যর্থতার পরেও সৌম্যর দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে তোলা প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননা নির্বাচকদের কেউই।

একম্যাচের ক্যারিয়ারে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ডাক পাওয়ার পেছনে, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের উইকেটে পেস বোলিং অল-রাউন্ডারের সুযোগ কাজে লাগানোর ভূমিকার প্রত্যাশায় তার হাতে বিশ্বকাপের বিমানের টিকেট ধরিয়ে দেওয়া হয়।

একম্যাচের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ক্যারিয়ারেই তাকে বিশ্বকাপে খেলানোর সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে আত্মঘাতী। তবে, বিশ্বকাপে সৌম্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কার্যকরি ইনিংসে দলের শুরুর ধকল সামলে নেয় বেশিরভাগ দিন।

পরোক্ষভাবে রিয়াদের সাথে তাকেই প্রতিম্যাচে ইনিংস সামলাতে হয়েছিলো মূল ওপেনারদের ব্যর্থতায়। শুরুতে প্রশ্নের জন্ম নিলেও পরে — নির্বাচকদের সিদ্ধান্তকে যথার্থ ভাবতে শুরু করে সবাই। সিমিং কন্ডিশনে নির্ভীক ব্যাটিংয়ের শুরু প্রতিবারই দেখা গেছে তার কাছে।

পেস বোলিং অল-রাউন্ডার বিবেচনা সুযোগ পেলেও বিশ্বকাপে হাত ঘোরানোর সুযোগ মিলেছিলো মোটে ৭ ওভার। বিশ্বকাপ পরবর্তী তিন হোম সিরিজেই দূর্দান্ত সৌম্যে স্বপ্ন বুনতে থাকে বাংলাদেশ। সমর্থকদের আশার পালে সৌম্য হাওয়া লাগাতে শুরু করেন। নির্বাচকদের অন্তরেও তখন প্রশান্তির বাতাসের ধারা বহমান। সমর্থকরাও সৌম্যকে নতুন দিনের বিজ্ঞাপনের তকমা দিতে শুরু করে।

২০১৫ এর শেষে অনুষ্ঠিত বিপিএলেই ব্যাটে খেই হারান সৌম্য। আমলে নেওয়া হয়নি জাতীয় দলে ফর্মের তুঙ্গে অবস্থান করায়। নির্বাচক বা সমর্থক কারো কপালেই চিন্তার ভাঁজ পড়েনি। সৌম্যর উপর তাই আশার চাকাও থেমে থাকেনি ।

কিন্তু, সৌম্য ধারাবাহিকতা হারিয়ে ধুঁকতে শুরু করেন জাতীয় দলেও। ২০১৫ সালের জুলাই মাসের ১৫ তারিখে চট্টগ্রামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ওয়ানডেতে হাফ সেঞ্চুরি হাঁকানোর পর পরবর্তী হাফ সেঞ্চুরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় সময়ের হিসেবে ২ বছরের চেয়ে তিন দিন কম ও ইনিংসের হিসেবে ৮ ইনিংসের বিরতি শেষে।

ব্যাটে বলে সঠিক সংযোগ স্থাপনে পুরোপুরি ব্যর্থ সৌম্য। রানের খাতা খুললেও এগোতে পারছিলেননা সামনে। অতিক্রম করাই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায় দুই অঙ্কের ঘর। গড়ে তোলেন অফ-ফর্মের সাথে সন্ধি।

ফর্মে ফিরতে মরিয়া প্রমাণে প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়েও নানান শট খেলা শুরু করেন। কিন্তু, খারাপ সময় লেপ্টেই ছিলো সেসময়। এলবিডব্লু, ইনসাইড এজ, ছয় মারতে গিয়ে ক্যাচ সবভাবেই কাটা পড়েন সৌম্য।

২০১৬ তে বেশিরভাগ ম্যাচ টি-টোয়েন্টি খেলতে হলেও সেখানেও খুঁজে পাওয়া যায়নি সৌম্যকে। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ছিলেন অফ-ফর্মে। অকৃতকার্য হন দলের ইনিংস মেরামতে অবাদন রাখতে।

ফর্মে ফেরার তাগিদে ক্রিকেটের ব্যাকরণকে তোয়াক্কা না করেই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে অতিপ্রচেষ্টায় ব্যর্থতা ধরা দেয় তার নামের পাশে। বিশ্বকাপে ৭ ম্যাচে ১০ গড়ে করেছিলেন ৭৫, স্ট্রাইকরেট মাত্র ৮৮। একজন ওপেনারের ব্যর্থ প্রচেষ্টার চিত্র এখানেই স্পষ্ট।

সৌম্যর ব্যাটে রান ফেরাতে মরিয়া হয়ে উঠে পড়ে লাগে টিম ম্যানেজম্যান্টও। ওপেনিং থেকে ছয় নম্বর পজিশনে নামিয়ে ফেলা হয় তাকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই। একজন জাত ওপেনারকে এমন পজিশনে ব্যাট করানো মোটেও সমীচীন নয়।

ফর্মে না থাকলে তো আরও বিপদে ফেলে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত। কিন্তু, তাই করা হলো। পজিশন পাল্টে সুযোগ দেওয়া হলো। ব্যর্থতা চলতে থাকলেও বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়নি তার জায়গায় অন্যকাউকে। সৌম্য বাদ পড়লেই বরঞ্চ বেশি সুবিধা হতো তার জন্য। রান খরার মাঝে পজিশনের পরিবর্তন সুফল বয়ে আনেনা কোনোক্রমেই।

একজন ব্যাটসম্যানকে পাখির সাথে তুলনা করা হলে তার ডানা হলো ব্যাট। যে ব্যাট ঘুরিয়েই ভেসে বেড়াতে হয় ক্রিকেটের দুনিয়ায়। সৌম্যর ব্যাট কথা বললে তা ডানায় রূপ নেয় দারুণভাবে। অসাধারণ পুল শট ও নান্দনিক স্কয়ার কাটে উড়ে বেড়ানোয় দ্বিধা নেই, তাই প্রমাণ করেন।

পরের বছর তথা ২০১৭ সালের চিত্রও পুরোপুরি একই। তীব্র আশা থাকলেও, চ্যাম্পিয়ন’স ট্রফির চার ম্যাচেই ডানা মেলে উড়তে ব্যর্থ। হাসেনি ব্যাট, পাল্লা ভারি হয়েছে ব্যর্থতার। ৪ ম্যাচে ব্যাটে রান মোটে ৩৪। থিতু হওয়ার আগেই তিনম্যাচে বিদায় নিয়েছেন ইংলিশদের কন্ডিশনে।

এর আগে শ্রীলঙ্কা সফরেও স্বভাবসুলভ সৌম্যের অভাবে ভুগতে হয়েছে দলকে। কোনোভাবেই খারাপ সময় পিছু ছাড়তে চাইছিলোনা। সৌম্যের দু:সময়ের প্রভাবেই ভিত নড়বড়ে হয়ে যায় প্রতি ম্যাচে বাংলাদেশের।

অবশেষে সৌম্য বাদ পড়লেন, বারবার সুযোগ পেয়েও প্রতিদান দিতে না পারায় তাকে বাইরে রাখা হলো দলের। এক্ষেত্রে সৌম্যর ভাগ্যও সুপ্রসন্ন বলতে হবে — দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ২০১৮ এশিয়া কাপে তামিমের আকস্মিক ইনজুরিতে নির্বাচকরা ইমরুলের সাথে সৌম্যকেও দেশ থেকে উড়িয়ে নেয়।

প্রমাণের আরেকটি বড় মঞ্চ সামনে পেয়েও সৌম্য নিজেকে পুনরায় হারিয়ে খুঁজেছেন অফ-ফর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে। আস্থার প্রতিদান দিতে গিয়ে আড়ালে গা ঢাকা পড়ে যায় আরেকবার। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধে সৌম্যকে পরাজিতই মনে হচ্ছিলো। এই গল্প অজানা নেই কারোই।

এশিয়া কাপ পরবর্তী হোম সিরিজে জিম্বাবুয়েকে দিশেহারা করে গ্যালারি মাতানো ৯২ বলে ১১৮ রানের রোমাঞ্চকর ইনিংসে বার্তা দেন এবার ফিরছি — আগের সেই পুরোনো বীরের বেশ।

কিন্তু, পরের সিরিজেই উইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম দুই ম্যাচে সৌম্যের সেই ক্ষুরধার ব্যাটিং কোথায় যেন হারিয়ে যায়। শেষ ম্যাচে সিলেটে ৮০ রানের মারকুটে ইনিংস তার দলে স্থান নিশ্চিতের টিকেট বলা চলে। এভাবেই নিয়মিত চলছে।

টিকেট নিয়েই ২০১৯ নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে রানের খরা আবারও ব্যাটে। তবে, বিশ্বকাপ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে তিন অর্ধশতকে বিশ্বকাপে ভালোকিছু করার আভাস দিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। তিন অর্ধশতকে বিশ্বকাপে ওপেনিংয়ে লিটনের জায়গাও কেড়ে নেন।

সৌম্যের নির্ভীক ব্যাটিংয়ে একটা ভালো শুরু এলেই দল শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলার সুযোগ তৈরি হয়। ২০১৯ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ ছাড়া সব ম্যাচেই সৌম্য মলিন ছিলেন। পারফরম্যান্সে চিরায়ত সেই অনুজ্জ্বলতা। তামিমের অফ-ফর্মের আলোচনায় সৌম্য বেঁচেই গিয়েছিলেন সমালোচনা থেকে। নিজে বেঁচে গেলেও বাঁচাতে পারেননি দলকে খাদে পতিত হওয়া থেকে।

টানা ব্যর্থতায়ও হুঁশ ফিরে আসেনা নির্বাচকদের। ফলে, সৌম্যও বারবার দলে টিকে যান। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কার মাটিতে দলগত ব্যর্থ সিরিজের শেষ ম্যাচে একটিমাত্র অর্ধশতক তাও মূল্যহীন। প্রতিভার ঘাটতি না থাকলেও, ফলাফলে ঘাটতি সীমাহীন। ফলাফল ছাড়া প্রতিভা দেখিয়ে কতদিন অফিসের পদে টিকে থাকা যায় ?

ব্যাটিং পজিশন হারিয়ে ৬-৭ নম্বরে তাকে খেলতে হয়। করোনার পর ঘরের মাঠে উইন্ডিজ কিংবা টি-টোয়েন্টিতে কিউইদের মাঠেও সৌম্যের নামের পাশে রান নেই। জিম্বাবুয়েতে রান করেও মিরপুরে অজিদের বিপক্ষে ধারাবাহিকতার বালাইও ছিলোনা। রান খরাই সৌম্যের অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছে। দুই ম্যাচ রান করে লুকিয়ে থাকেন দশ ম্যাচ।

টানা দুই ম্যাচ রান না পেলেই ভাটা পড়ে আত্মবিশ্বাসে। সাবলীলতা দূর হয় ব্যাটিংয়ে। এরপরেও, তাকে মাঠে নামানো হয়। বদলানো হয় ব্যাটিং পজিশন। নির্বাচকদের তাঁকে ঘিরে আশা আর সমর্থন বন্ধ হয়না। বাদ পড়েন না সহজে, পড়লেও অন্য কারো ইনজুরিতে তাঁর উপরেই আস্থা খুঁজে বেড়ান নির্বাচকরা।

সর্বশেষ ৪০ ওয়ানডে ইনিংসের ২৪ টিতেই সৌম্য রানের খাতায় পাশ মার্ক পেতে যুদ্ধ করে গেছেন। ২০১৭ ও ২০১৯ সালের ক্যালেন্ডারে সৌম্যর ব্যাটিং গড় যথাক্রমে ২৪ ও ২৯। ২০১৮ সালে ৬ ম্যাচে ৪২ গড়ের রহস্য একটি শতক জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ও সিলেটে উইন্ডিজের বিপক্ষে ৮০ রানের ইনিংস ছাড়া ওয়ানডেতে বাকি চার ম্যাচে করেছেন যথাক্রমে ০, ৩৩, ১৯, ৬। সাম্প্রতিক পাঁচ টি-টোয়েন্টির পরিসংখ্যান নতুন করে জানানোর তো কিছুই নেই।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...