ফাবিয়ান বার্থেজ – টেকো মাথার এই গোলরক্ষক ফ্রান্সের হয়ে খেলেছেন দুইটি বিশ্বকাপ ফাইনাল। ডি বক্সের ভিতর যাকে ড্রিবলিং করতে দেখা গেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সিতেও। অবশ্য তিনি এখন একজন পুরোদস্তুর মোটরগাড়ির রেসার। লে মান্স ২৪ এর মত মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতায় তাকে অংশ নিতে দেখা গেছে।
বার্থেজের মাথার টাকের মত তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারটাও ঝক্ঝকে উজ্জ্বল। ১৯৯৮ এবং ২০০০ সালে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ এবং ইউরো জয়ী দলের এক নম্বর গোলরক্ষক ছিলেন। ২০০৬ বিশ্বকাপেও যার ব্যত্যয় ঘটেনি, সেবারের ফাইনাল ম্যাচটি তাঁর আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ ছিল।
লম্বা সময় ধরে খেলেছেন ফ্রান্সের সেরা সব ক্লাবে। ১৯৯৩ সালে মার্সেই দলের অংশ ছিলেন যখন তারা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা ঘরে তোলে, যদিও ম্যাচ গড়াপেটার কলঙ্কে ফ্রেঞ্চ এই দলটির ইউরোপ জয়ের আনন্দ ঢাকা পরে যায়।
২০০০ সালে প্রায় ৯.২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে মোনাকো থেকে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। তৎকালীন দলবদলের বাজারে একজন গোলরক্ষকের জন্য টাকার অঙ্কটা ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণের। রেড ডেভিলদের হয়ে জেতেন ২০০১ এবং ২০০৩ মৌসুমের শিরোপা।
খ্যাপাটে গোলরক্ষক হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন বার্থেজ। গোলবারকে বিপদমুক্ত করতে যেমন ঢেলে দিতেন নিজের ১০০ ভাগ তেমনি বিপক্ষ দলের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের সামনে দেখানো শুরু করতেন ড্রিবলিং। দুর্দান্ত সেভ যেমন করতেন তেমনি মাঝেমধ্যে উদ্ভট সিদ্ধান্তও নিতেন যার খেসারত দিতে হত দলকে।
শুরু থেকেই ওল্ড ট্রাফোর্ডে সমর্থকদের প্রিয় খেলোয়াড়ে পরিণত হতে তাই বেগ পেতে হয়নি তাকে। তবে মাঝে মধ্যে তার করা ভুল গুলো রেড ডেভিলদের এক নম্বর গোলরক্ষক হিসেবে তিনি উপযুক্ত কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের ভুল তিনি বড় ম্যাচগুলোতেই করেছেন।
ওয়েস্টহ্যামের বিপক্ষে পাউলো ডি ক্যানিও অফসাইড ভেবে দুই হাত উপরে তুলে করতে থাকেন আবেদন, এদিকে ডি ক্যানিও জালের ফাঁকা জায়গা দিয়ে ম্যাচের একমাত্র গোলটি করে বসেন। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ২০০১-২ মৌসুমে দেপোর্তিভো লা করুণা এবং ২০০২-০৩ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হারের কারণ হিসেবে বার্থেজের হঠকারী সিধান্তকেই ধরা হয়। আর এসবের ফল স্বরূপ ২০০৩ সালের গ্রীষ্মকালীন দলবদলের বাজারে টিম হাওয়ার্ডকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাদের এক নম্বর গোল রক্ষক হিসেবে দলে ভেড়ায়।
২০০৭ সালের এপ্রিলে নন্তে খেলার সময় এক মদ্যপ সমর্থকের সাথে মারামারি করার পর বার্থেজ ক্লাব ফুটবলকে বিদায় জানান। এরপর থেকেই শুরু হয় তার মোটরযান রেসের নতুন অধ্যায়।
বার্থেজ হঠাৎ করে মোটরযান রেসে আসার সিধান্তে উপনিত হন নি। ২০১৮ সালে তৈরি করা ডকুমেন্টারি ‘ব্রাদার্স অফ স্পোর্ট’ এ তিনি জানান যে ১৯৯৮ সালে সাবেক ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভার অলিভিয়্যার প্যানিসের সাথে কথোপকথনের পর থেকেই তিনি এই ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
ডকুমেন্টারিতে তিনি জানিয়েছেন, যখন ফুটবল খেলতেন তখন থেকেই তাঁর মোটররেসের ব্যাপারে আগ্রহ ছিল, এটা তাঁকে সব সময় মুগ্ধ করত। তিনি বলেন, ‘এখানে ৩৫ বছর বয়সের পরও আপনার ক্যারিয়ার থাকবে। ফুটবলে যা শেষের শুরু হিসেবে ধরা হয়।’ হ্যাঁ, বার্থেজ ঠিক এই বয়সেই ফুটবল থেকে বিদায় নেন।
বার্থেজ ২০০৮ সাল থেকে মোটররেসে অংশগ্রহন করছেন। আঞ্চলিক প্রতিযোগিতাগুলোয় তিনি বেশ সাফল্য পেয়েছেন। ২০১৩ সালের জিটি চ্যাম্পিয়নসশিপে মরগান মউলিন ট্রাফোর্টের সাথে তিনিও চ্যাম্পিয়ন হন।
২০১৪ সালে লে ম্যান্সে প্রথমবারের মত অংশগ্রহন করে তিনি ২৯তম স্থান অধিকার করেন। তিনি জানিয়েছেন, প্রায় তিন মাস ধরে তিনি এর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। এই প্রতিযোগিতা তাঁর আবেগ থেকে আসক্তিতে পরিণত হয়। তিনি বলেন, ‘ফুটবলে যেমন আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়, মাঠের পরিবেশ দেখতে হয় এবং প্রত্যাশার চাপ সৃষ্টি হয়, মোটররেসেও তেমনই।’
২০১৬ সালে তিনি অলিভিয়্যার প্যানিসের সাথে একজোট হয়ে প্যানিস বার্থেজ দল গঠন করে লে ম্যান্সে আবার অংশগ্রহন করেন। রেস শেষ হওয়ার তিন ঘণ্টা আগে গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে তিনি রেসটি শেষ করতে ব্যর্থ হন।
অলিভিয়্যার প্যানিস বলেন তিনি বার্থেজের সাথে কাজ করতে পেরে আনন্দিত, বার্থেজের থেকে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন এবং সে একজন দুর্দান্ত ড্রাইভার । তিনি আরও বলেন বার্থেজ যা সাফল্য অর্জন করেছে তাতে তিনি মুগ্ধ।
বার্থেজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাঁর মোটররেসিং, পোশাক এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদির ছবিতে ভরপুর। মোটররেসে তিনি যেমন মজেছেন, এর থেকে দূরে চলে যাবেন সেই সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তিনি যদি ফুটবল ক্যারিয়ারের উদ্দীপনা নিয়ে রেসের মাঠে নামেন তবে প্রতিপক্ষ চালকদের সাবধান হয়ে যাওয়ারই কথা। কারণ, বার্থেজ বরাবরই চ্যাম্পিয়ন।