আসছে ডেলিভারির জন্য রান আপ শুরু করতে যাওয়া জেমস অ্যান্ডারসনকে উত্ত্যক্ত করা শুরু করলেন নন স্ট্রাইকে থাকা মিশেল জনসন। এ অবশ্য নতুন ব্যাপার নয়। ক্রিকেট বিশ্বে অজি-ইংলিশদের আগ্রাসী মনোভাব সম্পর্কে ক্রিকেট ভক্তদের ভালোই জানা থাকার কথা। অনেকে আবার ব্যাপারটাকে উপভোগও করেন। সে যাই হোক, জনসনের কথাগুলো শুনেছেন কি শুনেননি বোঝা যাচ্ছিল না।
স্ট্রাইকে থাকা রায়ান হ্যারিসকে অসাধারণ এক ইয়র্কারে বোল্ড করে ঘুরে গেলেন সেই জনসনের দিকে। তারপর দুই হাত প্রসারিত করা ও পরে মুখে সোজা আঙুল দেওয়ার পর বোঝা গেল- তাঁর কথা কানে নিয়েই রান আপ শুরু করেছিলেন তিনি। এমন আগ্রাসী মনোভাবই তো থাকা চাই একজন পেসারের!
জেমস অ্যান্ডারসনকে বলা যায় গতিময় বোলিং ও সঠিক লাইন লেন্থের সাথে নিয়মিত সুইং- রিভার্স সুইংয়ের এক কম্প্লিট প্যাকেজ। ল্যাঙ্কশায়ারের বার্নলিতে জন্ম নেয়া এই পেসার ২২ গজের মাঠে যেমন আগ্রাসী, মাঠের বাইরে ততটাই লাজুক প্রকৃতির। ক্যারিয়ারে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের একের পর এক সুইং – রিভার্স সুইংয়ে খাবি খাইয়ে যেমন নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়, ক্যারিয়ারের শুরুতে তেমন দেখেছেন কঠিন বাস্তবতাও।
২০০২ সালে অজিদের বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের মধ্য দিয়ে পথচলা শুরু করা এই বোলিং জাদুকর ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ বছরে জাতীয় দলে নিয়মিত ছিলেন না একেবারেই। এ সময়ে তাঁকে যে প্রায়ই নেট বোলারের ভূমিকায় থাকতে হয়েছিল- তাঁর এখনকার অবস্থান দেখে তা বিশ্বাস করা একটু কঠিনই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন সাদামাটা পারফরম্যান্সের কারণে দলের কোচিং প্যানেলের পরামর্শে বোলিং অ্যাকশনেও আনতে হয়েছিল পরিবর্তন, যাতে কাজের কাজ তো কিছুই হয়নি বরং আগের ছন্দ ও আত্মবিশ্বাসে ভাঙন ধরেছিল তাঁর।
দলে আসা যাওয়ার মধ্যেই এন্ডারসন ডাক পান ২০০৬/০৭ মৌসুমের অ্যাশেজে। সেবার ৫-০ ব্যবধানে ধবলধোলাই হয় ইংলিশরা। এমন ভরাডুবির পর অনুমিত ভাবেই পরবর্তী ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে করা হয় বেশকিছু রদবদল। আর তাতে বাদ পড়েন তিনিও। তবে সে সিরিজে সুযোগ না পেলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো বোলিং করে যান তিনি। যার ফলে ভারত সিরিজে দলে আবারও ডাক পান তিনি।
ঐ সিরিজে প্রথম ম্যাচেই একের পর এক ইনসুইঙ্গার – আউটসুইঙ্গারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন টেন্ডুলকার- দ্রাবিড়দের নিয়ে গড়া ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপকে। ভারতের প্রথম ইনিংসে সে সময়কার ব্যাটিং লাইনআপের তিন স্তম্ভ শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড় ও সৌরভ গাঙ্গুলির উইকেট সহ মোট পাঁচটি উইকেট শিকার করে ভারতকে মাত্র ২০১ রানে বেঁধে ফেলতে বড় ভূমিকা রাখেন তিনি। প্রথম ইনিংসে এমন নজরকাড়া বোলিংয়ের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও দুটি উইকেট শিকার করেন।
নিজের এমন বোলিংয়ে কতটা উচ্ছসিত ছিলেন তিনি তা তাঁর কথাতেই ফুটে ওঠে, ‘তখন বল সুইং করছিল এবং আবহাওয়াও আমার অনুকূলে ছিল। গাঙ্গুলির উইকেটটি আমার জন্য বিশেষ কিছু ছিল। বেশ কিছু আউটসুইঙ্গারের পর ইনসুইঙ্গারে তাঁকে বোল্ড করি আমি- যেটা আমার অনেক দিন মনে থাকবে। তাঁর পাশাপাশি টেন্ডুলকার আর দ্রাবিড়ের উইকেটও নিই আমি। আমার মনে হয় না একই ইনিংসে এমন তিনজন ব্যাটসম্যানের উইকেট নেওয়ার সৌভাগ্য আগে কারও হয়েছে।’
কঠোর পরিশ্রম ও পূর্বের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের ক্যারিয়ারে এভাবেই পরিবর্তন আনা শুরু করেন অ্যান্ডারসন। ক্যারিয়ারের এমন একটা সময়ে ভারতের মতো ব্যাটিং লাইনআপের বিপক্ষে এমন পারফরম্যান্স স্বাভাবিক ভাবেই বাড়তি আত্মবিশ্বাস যোগায় অ্যান্ডারসনকে, যা পরবর্তীতে বোলিংয়ের এই ধারা ধরে রাখতে সহায়তা করেছিল তাঁকে।
তিনি নিজেও স্বীকার করেন সেটা, ‘একজন বোলার হিসেবে আপনি অবশ্যই চাইবেন ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে। আর এই পারফরম্যান্সের পেছনে ছিল কঠোর পরিশ্রম, অনুশীলন ও পূর্বের ভুল থেকে নেওয়া শিক্ষা। আমার মনে হয় (ক্যারিয়ারে) ধারাবাহিক হওয়ার শুরুটা হয়েছিল এ সময় থেকেই। আমি জানি না ঠিক কোন বিষয়টি কাজ করেছিল কিন্তু এই সময় থেকেই আমার মনে হয় ধারাবাহিক হওয়া ও নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত হওয়া শুরু করে।’
বলা যায় এ সময়টাই ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের ‘ইউ-টার্ন’।
ভারতের বিপক্ষে অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর পরের শ্রীলঙ্কা সিরিজেও ডাক পড়ে তাঁর। প্রথম টেস্টে অবশ্য তেমন সুবিধা করতে পারেননি তিনি। যে কারণে পরের দুই টেস্টে সতীর্থ স্টিভ হার্মিসনের কাছে জায়গা হারান তিনি। তবে তাঁর ওপর থেকে আস্থা হারান নি নির্বাচকরা। যে কারণে ব্ল্যাকক্যাপদের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত পরের সিরিজেও স্কোয়াডে জায়গা পান তিনি।
কিউইদের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে হারের পর একাদশে সেই হার্মিসনের জায়গাতেই আনা হয় তাঁকে। এবং এসেই দেখান তাঁর বোলিং কারিশমা। দ্বিতীয় টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৭৩ রানে পাঁচ উইকেট ও দ্বিতীয় ইনিংসে দুই উইকেট শিকার করেন তিনি।
পরের সিরিজেও অ্যান্ডারসন বজায় রাখেন তাঁর সে ধারাবাহিকতা। ২০০৮ সালে ঘরের মাঠে কিউইদের বিপক্ষে সেবার ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জেতে ইংলিশরা। আর এ জয়ে বোলারদের মধ্যে মূল ভূমিকা রাখেন জেমস অ্যান্ডারসন। বিশেষ করে নটিংহ্যামে অনুষ্ঠিত সিরিজের শেষ টেস্টে তাঁর বিধ্বংসী রূপ দেখেছিল কিউইরা। প্রথম ইনিংসে ওভার প্রতি মাত্র দুই রান খরচায় সাত উইকেট নিয়ে কিউইদের ব্যাটিংয়ে ধস নামান তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসেও দুই উইকেট শিকার করেন তিনি। সে ম্যাচে তাঁর বোলিং নৈপুণ্যেই ব্ল্যাকক্যাপদের ইনিংস ব্যবধানে হারিয়েছিল ইংলিশরা।
পরবর্তী চারটি টেস্ট সিরিজে যেখানে প্রতিপক্ষের কাছে একের পর এক নাকাল হচ্ছিলো ইংলিশরা, সেখানেও ভালো বোলিং করে যান জিমি। তবে ২০০৯ সালে উইন্ডিজদের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত পাঁচ টেস্টের সিরিজে সিরিজ হারলেও একেবারে খারাপ খেলেনি ইংলিশরা।
প্রথম টেস্টে বাজে ব্যাটিংয়ের কারণে ইনিংস ব্যবধানে হারলেও সিরিজের বাকি ম্যাচগুলোতে ভালোই লড়াই করে গিয়েছিল তাঁরা। মাঝে তৃতীয় ও পঞ্চম টেস্টে জয়ের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও জেতা হয়নি তাঁদের। এই সিরিজেও ভালো বোলিং করে দলের বোলিং আক্রমণকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি। আর এভাবেই ধীরে ধীরে ইংলিশ বোলিং আক্রমণের প্রধান অস্ত্র হয়ে ওঠেন তিনি।
ক্যারিয়ারের শুরুতে বাজে সময় পার করা সেই জেমস অ্যান্ডারসন এখন টেস্টে ৬০০ এরও বেশি উইকেটের মালিক, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচে ইংলিশদের হয়ে উইকেট সংগ্রাহকের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছেন তিনি। এ তালিকায় শীর্ষ ১৫-তে এখনও খেলে যাচ্ছেন এমন বোলারদের মধ্যে আছেন শুধু স্টুয়ার্ট ব্রড। গেল বছরে পাকিস্তানের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত টেস্টে আজহার আলীর উইকেট নিয়ে ইংলিশদের হয়ে টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবার কোন বোলারের ৬০০ উইকেট শিকারের মাইলফলক ছুঁয়েছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তুলনামূলক ভাবে লাল বলেই বেশি সফল ছিলেন এন্ডারসন। আর সেই ধারা বজায় রাখেন ঘরোয়া ক্রিকেটেও। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ২৬২টি ম্যাচ খেলে ১০০০ এরও বেশি উইকেট শিকার করেছেন তিনি। ২০০২ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষিক্ত হওয়া বোলারদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত তিনিই সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক।
তবে ওডিআইতেও কম যান না তিনি। সাদা বলের পুরো ক্যারিয়ার মিলিয়ে ৫-এর কম ইকোনমি রেটে বল করেছেন জিমি, যা এখনকার ধুন্ধুমার ক্রিকেটের হিসেবে খুবই কম। ১৯৪ টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ২৬৯টি উইকেট নিজের ঝুলিতে জমা করেছেন তিনি।
গতিময় বোলিং, সঠিক লাইন-লেন্থ ও সুইংয়ের মিশেলে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের খাবি খাওয়ানোর মধ্যেই পেস বোলিংয়ের নান্দনিকতা। আর তা খুঁজতে গেলে অ্যান্ডারসনের কাছে আসতেই হবে আপনাকে। প্রায় দুই দশক ধরে জাতীয় দলে খেলে যাওয়া এই ইংলিশ পেসারের পেস বোলিংয়ের নান্দনিক প্রদর্শনীতে হয়তো আরও কিছুদিন মুগ্ধ হতে চাইবে ক্রিকেট বিশ্ব।