শরনার্থী শিবিরের সেই লাজুক বালক

রাশিয়া বিশ্বকাপে তিনি দলের হয়ে দু’বার গোল করেছেন। দু’টি টাইব্রেকারে দু’বারই জালে বল জড়িয়েছেন। দলকে নিয়ে গেছেন ফাইনালে। সেই সুবাদে জিতেছেন ফিফার বর্ষসেরা পুরস্কার। কি দারুণ ছবির মত সাজানো একটা গল্প। না, জীবনটা মদ্রিচের জন্য ‘এক পিস কেক’-এর মত সহজ নয়। গল্পের গোড়ায় আবার ফিরি চলুন। ক্রোয়েশিয়ার জাডারে মড্রিচের জন্ম হয় ১৯৮৫ সালের নয় সেপ্টেম্বর। দেশটা তখন ছিল যুগোস্লাভিয়া। মাত্র ছয় বছর বয়সে মদ্রিচকে রিফিউজি জীবন শুরু করতে হয়।

২০১৮ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। লুজনিকি স্টেডিয়ামের আলোর মেলায় যখন উদ্ভাসিত হচ্ছিলেন ক্রোয়াটরা, তখন তাতে সামিল হয়েছিলেন লুকা মদ্রিচও। রিয়াল মাদ্রিদের এই শৈল্পিক মিডফিল্ডারই তো ক্রোয়াটদের বিশ্বকাপ দলের, বলা ভাল তাঁদের ফুটবল ইতিহাসের সেরা তারকা।

সময়টাকে স্বপ্নের মত মনে হতেই পারে তাঁর কাছে। অথচ, একটা সময় জীবন ছিল দু:স্বপ্নের চেয়েও কঠিন। সার্বিয়ান বিদ্রোহীরা মেরে ফেলেছিল তাঁর দাদাকে। পরিবার সহ বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন, বেছে নিয়েছেন শরণার্থীর জীবন।

সেই জীবন থেকে একটু নির্ভার থাকার মাধ্যম ছিল ফুটবল। সেখান থেকে ফুটবলে তাঁর বিকাশ হয় ডায়নামো জাগরেবের হয়ে। এপর তিনি একটা সময় খেলেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে। চার বছর খেলেছেন টটেনহ্যাম হটস্পারে। সেখান থেকে ২০১২ সালে যোগ দেন স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদে। দলটির হয়ে জয় করেন চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা।

রাশিয়া বিশ্বকাপে তিনি দলের হয়ে দু’বার গোল করেছেন। দু’টি টাইব্রেকারে দু’বারই জালে বল জড়িয়েছেন। দলকে নিয়ে গেছেন ফাইনালে। সেই সুবাদে জিতেছেন ফিফার বর্ষসেরা পুরস্কার। কি দারুণ ছবির মত সাজানো একটা গল্প।

না, জীবনটা মদ্রিচের জন্য ‘এক পিস কেক’-এর মত সহজ নয়। গল্পের গোড়ায় আবার ফিরি চলুন।

ক্রোয়েশিয়ার জাডারে মড্রিচের জন্ম হয় ১৯৮৫ সালের নয় সেপ্টেম্বর। দেশটা তখন ছিল যুগোস্লাভিয়া। মাত্র ছয় বছর বয়সে মদ্রিচকে রিফিউজি জীবন শুরু করতে হয়।

১৯৯১ সালের আট ডিসেম্বর শুরু হয় বলকান যুদ্ধ। নৃশংস সার্বিয়ান বিদ্রোহীরা হামলা করে নর্দান ডালমাটিয়ায়, ভেলেবিট পাহাড়ের খুব কাছে ছবির মত সুন্দর গ্রাম মদ্রিচিতে। নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় ক্রোয়েশিয়ান পরিবারগুলোর ওপর।

এই গ্রামেই থাকতো মদ্রিচের পরিবার। দাদা লুকা মড্রিচ সিনিয়র তখন ক্ষেতে ভেড়া চড়িয়ে ফিরছিলেন। তখনই স্থানীয় আরো পাঁচজনের সাথে তিনি সার্বিয়ান অস্ত্রধারীদের রোষের মুখে পড়ে প্রাণ হারান। পরিবার খবর পেয়ে বুঝতে পারে, জায়গাটা তাঁদের থাকার জন্য নিরাপদ নেন। তাই, পালিয়ে আসতে বাধ্য হন তাঁরা।

মড্রিচ তাঁর পরিবারের সাথে জাডারের সৈকতাঞ্চলের একটা হোটেলে ঠাই নেন। আপাত দৃষ্টিতে জায়গাটা নিরাপদ মনে হলেও গ্রেনেড-বুলেটের ভয় তো ছিলই। মা রাদোজকা নিটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। হোটেলের শরণার্থী শিবিরে না ছিল পানি, না ছিল বিদ্যুৎ।

অতটুকু বয়সে ওই পরিবেশে ফুটবলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন মদ্রিচ। হোটেলের মধ্যেই একটা বল নিয়ে খেলতেন। কখনো সঙ্গী হিসেবে পেতেন বোন জেসমিনাকে। এর মধ্যেও ভয় ছিল, কখনো গ্রেনেড এসে পড়ে, কোথায় মাইন পাতা আছে, কে জানে!

সেই কোলোভারে হোটেলের এক কর্মী স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘ও একবার ফুটবল খেলতে গিয়ে হোটেলের কাচ ভেঙেছিল। হোটেলের হল রুমে সারাটা দিন খালি ফুটবল খেলে বেড়াতো ও।’

মদ্রিচ বলেন, ‘ওই হোটেলটাতে আমাদের অনেকদিন থাকতে হয়, কারণ আর্থিক ভাবে স্বচ্ছলতা ছিল না মোটেও। আমি তখন থেকেই সব সময় ফুটবল ভালবাসতাম। আমার মনে হয়ে, আমার প্রথম শিন প্যাডে ব্রাজিলের রোনালদোর ছবি ছিল। ওগুলো আমার খুবই প্রিয় ছিল।’

ফুটবলের প্রতি এত ভালবাসার পরও শৈশবে একটা ক্লাব খুঁজে পেতে যথেষ্ট ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল মদ্রিচকে। যখন বয়স মাত্র ১০, তখন বেশ কয়েকজন কোচ মদ্রিচকে দলে নিতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁদের দাবী ছিল, এত লাজুক আর ঠুনকো শরীরের ছেলে দিয়ে ফুটবল হয় না।

মদ্রিচকে নেয় কেবল জাডারের ক্লাব হাজডুক স্লিট। সেই দলের কোচ টমিস্লেভ বেসিচের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সেখান থেকে ডায়নামো জাগরেবের ট্রায়ালে যান, তাদেরও মনে ধরে যায় মড্রিচকে। সেখান থেকে টটেনহ্যাম হয় মদ্রিচ বনে যান রিয়াল মাদ্রিদের প্রাণভোমরা। এখনো তিনি শৈশবের কোচ টমিস্লেভের সাথে যোগাযোগটা ধরে রেখেছেন।

২০১০ সালের মে তে জাগরেবেই মদ্রিচ বিয়ে করেন ভানজা বসনিচকে। এই দম্পতি তিন সন্তানের বাবা-মা। এর মধ্যে ২০১০ সালের ছয় জুনে জন্ম নেন ইভানো, ইমার জন্ম হয় ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিলে, আর ২০১৭ সালের দুই অক্টোবর জন্ম হয় সোফিয়ার।

বলকান যুদ্ধের অবসান হয় অনেক রক্তক্ষয়ের পর। এক লাখ ৪০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। যুগোস্লাভিয়ার কাছ থেকে ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর ২০১৮ সালে মাত্র দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের নক আউট রাউন্ডে খেলতে পারছে ক্রোয়েশিয়া। ২৬-২৭ বছর বয়সী দেশটির ইতিহাসে এর চেয়ে বড় সাফল্য আগে কখনো আসেনি।

মদ্রিচ একবার বলেছিলেন, ‘ক্রোয়াটরা একটু আলাদা। প্রতিটি শোক, প্রতিটি যুদ্ধ আমাদের একটু একটু করে শক্ত করেছে। আমাদের যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, সেটা কোনো ভাবেই সহজ নয়। যুদ্ধ আমাদের শক্ত করেছে। আমাদের মানসিক দৃঢ়তাকে তাই এখন সহজে ভাঙা যায় না। আমরা খুবই একাগ্র। আমরা সাফল্যের জন্য ক্ষুধার্থ। তাই সবাই যখন বলেছিল আমি প্রিমিয়ার লিগে মানিয়েই নিতে পারবো না, তখন সেই সমালোচনাকে শক্তি হিসেবে নিয়েছিলাম। আমি সবাইকে ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম। এখন তো মনে হয় সেটা করতে পেরেছি।’

এজন্যই তো যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্যে থেকেও ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা এক বিন্দুও নড়চড় হয়নি মদ্রিচের। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ শুরু হল। আমরা শরণার্থী হয়ে গেল। সব কিছু এখনো স্পষ্ট মনে আছে, কিন্তু সত্যি কথা হল সেসব দিনের কথা এখন আর মনে রাখতে চাই না।’

মদ্রিচকে বড় ফুটবল বানানোর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন বাবা স্টাইপে মদ্রিচ। লুকা মদ্রিচ বলেন, ‘আমাকে ফুটবল খেলানোর জন্য বাবা অনেক সংগ্রাম করেছেন। আমাদের অর্থকড়ি ছিল না, সকার স্কুলে যেতে পারিনি। বাবার শিনপ্যাড কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। বাবা সেনাবাহিনীর চাকরি করতেন, ছিলেন এয়ারক্রাফটের মিস্ত্রি। সব সময় তিনি আমার ফুটবলকে সমর্থন যুগিয়ে গেছেন।’

বিশ বছর আগে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েই চমকে দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। ফ্রান্সের মাটিতে সেবার ডেভর সুকার, স্লাভেন বিলিচ, জভোনিমির বোবানরা চলে গিয়েছিল ফাইনালে। বিশ বছর পর আবার সেই বিশ্বকাপেই স্বপ্নটা আরোকটু বাড়িয়ে ফাইনাল খেলে ক্রোয়াটরা।

মড্রিচ আগেই বলে রেখেছিলেন, এবার বিশ্বকাপে ২০ বছর আগের অর্জনকে ছাড়িয়ে যেতে চান তাঁরা। সেটা করতে পেরেছেন তাঁরা। যদিও, জার্সিতে একটা তারকা যোগ করতে পারেননি। তারকা যোগ হোক আর নাই হোক ক্রোয়েশিয়ার এই ফুটবলের নাম ইতিহাসের পাতায় সব সময়ই তারকার মত জ্বলজ্বল করবে!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...