ধ্রুপদি কর্ণাটকী ভরসা

দক্ষিণ কলকাতার কোনো এক ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে মা এবং বাবা দুজনেই এসেছেন তাঁদের ছেলেকে নিয়ে। স্কুল লেভেলে বেশ প্রতিশ্রুতি জাগাচ্ছে ছেলেটি। এবং স্কুলের কোচই বলেছেন , এই কোচিং ক্যাম্পে আসতে। সঙ্গে রেফারেন্স হিসেবে একটা চিঠি দিয়েছেন। কোচিং ক্যাম্পের কোচ ভদ্রলোক বাংলা এবং ভারতের হয়েও বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলেছেন।

ভারতীয় দলে তাঁর ঢোকা এবং বেরোনোটা নিয়ে মজার, মজার গল্প চালু ছিল এক সময়ে। তো মিতভাষী সেই ভদ্রলোক ছেলেটিকে একটি নেটে ঢুকতে বললেন। ক্যাম্পের সেরা জোরে বোলার পর পর কয়েকটা বল করল ছেলেটিকে। বেশ খুশি হলেন কোচ। এবার স্পিন! ইতোমধ্যেই বাংলার হয়ে আন্ডার ফিফটিন খেলা বাঁ-হাতি স্পিনারকে ডাকলেন তিনি বল করার জন্য। এই ছেলেটি বছর কয়েকের মধ্যেই খুব বড় মঞ্চে খেলবে বলে বিশ্বাস কোচের । তো সেই স্পিনারের বিরুদ্ধে ও নতুন ছেলেটি সমান স্বাচ্ছন্দ্য।

বাহ্ আপনার ছেলে তো বেশ ভাল খেলে ! রণদীপ ( স্কুলের সেই ক্রিকেট কোচ ) যতটা বলেছে তার থেকেও ভাল। ও থাকল আমার কোচিংয়ে।

ছেলেটির বাবা সমানে হাত কচলে যাচ্ছিলেন (ছেলের মায়েরা উপস্থিত থাকলে পৃথিবীর সব বাবারাই যেমন হাত কচলে থাকেন আর কী!) কিন্তু স্বভাব প্রগলভ মা আর চুপ থাকতে পারলেন না। এমনিতে তিনি এই কোচিং ক্যাম্প এ ছেলেকে নিয়ে আসতে চাননি কারণ ক্যাম্পের কোচ ভদ্রলোক কখনো তেমন ওয়ানডে খেলেন নি! আর ওয়ানডে না খেললে সেই ভদ্রমহিলার বিচারে তিনি কোনো প্লেয়ারই নন!

হ্যাঁ স্যার, মানে দেখুন একটু…. মানে দাদার মত যদি একটু ওকে বানিয়ে দিতে পারেন… মানে দাদার পর তো আর কেউ সেভাবে বেঙ্গল থেকে ইন্ডিয়া খেলল না… 

– দাদা মানে সৌরভ ?

– হ্যাঁ, তাছাড়া আবার কে?

– স্যারের অজ্ঞতায় ভদ্রমহিলা বিরক্ত .

– কিন্তু সে তো বাঁ হাতে খেলে … 

– তাহলে মানে যদি শচীন ….

– কেন যদি রাহুল বানিয়ে দিই ওকে। চলবে না?

– মিতভাষী কিন্তু স্বভাব রসিক কোচ সুযোগটা ছাড়তে পারলেন না।

– না মানে…. রাহুল….. মানে রাহুল ও ঠিক আছে …. 

ঠিক যে একদমই নেই তা ভদ্রমহিলার গলার আওয়াজেই মালুম।

এটা নেহায়েতই একটা কাল্পনিক কথোপকথন। কিন্তু বাস্তবও হতে পারত অনায়াসেই। ঘটনাস্থল কলকাতার বদলে মুম্বাইয়ের শিবাজী পার্ক বা অন্য যে কোনো জায়গা হতেই পারত। তখনো ক্রিকেট আকাশে মহেন্দ্র সিং ধোনি , বিরাট কোহলি বা রোহিত শর্মাদের মত নক্ষত্রদের আবির্ভাব ঘটেনি । আর বাবা-মায়েরা নিজের নিজের ক্রিকেট খেলা ছেলেদের তখন শচীন বা সৌরভই বানাতে চাইছেন।

কর্ণাটকের জ্যাম কোম্পানিতে চাকরি করা বাবা এবং অধ্যাপিকা মায়ের ছেলেটি কখনো তাঁদের দূরতম কল্পনাতেও আসেননি।

এবার একটা খুব বহু ব্যবহারে ‘ক্লিশে’ হয়ে যাওয়া প্রশ্ন। ধরুন আপনাকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে বসিয়ে রেখে একজন ব্যাটসম্যান কে বেছে নিতে বলা হচ্ছে যার ব্যাটিং আপনি দেখেছেন। মানে সেই ব্যাটসম্যান আউট হলেই আপনিও শেষ । কাকে বেছে নেবেন আপনি? এখানে বোধহয় আপনার চোখের সামনে ওই কর্ণাটকী আসবেন অথবা শচীনের পূর্বসূরি এক ‘খর্বকায়’ মারাঠি । কিন্তু শচীন বা সৌরভ বোধহয় আসবেন না। কারণ এখানে প্রশ্নটা জীবনের।

এবং এই হলেন রাহুল শরদ দ্রাবিড়। রঙিন ব্যাপার স্যাপার থেকে দূরে জীবনের খুব কাছে যার উপস্থিতি। এবং ঈশ্বরও তাঁকে এইভাবেই প্রচারের ঝলসানো আলো থেকে দূরে রেখেছেন। যেখানেই তিনি ভাল পারফর্ম করেছেন সেখানেই তাঁর থেকেও ভাল করে পুরো আলোটা নিয়ে গেছেন অন্য কেউ। সে টনটন হোক বা ইডেন। অবসরের পর ও তাঁর জন্য সঠিক চেয়ার জুটেছিল।

ভারতীয় ক্রিকেটের সাপ্লাই লাইন ঠিক রাখার কাজ। এ টিম বা জুনিয়রদের নিয়ে কাজ। এবং যথারীতি প্রচার থেকে দূরে। তাই যখন সিনিয়র টিমের দায়িত্ব নিলেন তখন অবাক লেগেছিল। এখন, যখন দেশে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞর সংখ্যা করোনার জন্য টিকা নেওয়া মানুষের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যাবে তখন ভারতীয় সিনিয়র ক্রিকেট টিমের (পুরুষ) কোচ হওয়া মানে আপনি চাইলেও প্রচারের সার্চ লাইটের বাইরে থাকতে পারবেন না।

প্রথমে বিস্ময়, পরে শঙ্কা এবং শেষে আশা। রাহুল যখন কোচ তখন কোচের সংজ্ঞাটাও হয়তো বদলাবে । কারণ আমার কাছে তিনি এক সংস্কারক। ইদানিং ঋষাভ পান্তের উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে আসাটা ভারতীয় ক্রিকেটের ‘হট টপিক’ তবে আমার মনে হয় আমাদের অত উত্তেজিত হয়ে কাজ নেই। ঋষাভকে যেটা শিখতে হবে সেটা শেখানোর সেরা লোক তাঁর দলেই আছেন। তাঁর কোচ হয়ে। নিজের উইকেটের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে ঋষাভকে। আর সেই ব্যাপারটা রাহুল দ্রাবিড় এর থেকেও ভালো কেই আর শেখাতে পারেন?

এই কর্ণাটকির এক সময় অধিকাংশ বাঙালির কাছে অমরিশ পুরি এবং ড্যানি ছিলেন একসঙ্গে! ভিলেন! কারণ আমরা বিশ্বাস করতাম ওই লোকটা যত না ক্রিকেট খেলে তার থেকে বেশি ষড়যন্ত্র করে। চরম স্বার্থপর একটা লোক।

আর আজ পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সে এসে পুরো তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে এই লেখা লিখছি।

অবাক হচ্ছেন? হবেন না। কারণ জীবন প্রতি পদে এরকম পরিবর্তনে বাধ্য করে। কারণ জীবনের হাতে রাহুল দ্রাবিড় নামের কোনো কোনো চরিত্র থাকেন।

একটা শুকনো পরিসংখ্যান দিয়ে শেষ করি। ভদ্রলোক পাঁচশো আটটা ম্যাচ খেলেছেন। ওয়ানডে এবং টেস্ট মিলিয়ে। চব্বিশ হাজার রান করেছেন। হ্যাঁ, ঠিক পড়ছেন চব্বিশ হাজার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link