লখনৌয়ের উইকেট স্লো কিন্তু স্পঞ্জি বাউন্সের ছিল। ইংল্যান্ডের আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছে। তারা বরাবর ফিফথ গিয়ারে খেলে অভ্যস্ত, বিশেষত ২০১৮ থেকেই। কিন্তু, বর্তমানে গিয়ার চেঞ্জ করতে পারছে না কারণ বিশ্বজয়ী দলের একটা ইয়ন মর্গান ছিলেন, যিনি মাঝের ওভারগুলি নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু, রানরেট কমতে দিতেন না।
এই দলে একটা জো রুট আছেন বটে, কিন্তু তিনি বড় উপরে নামছেন। দলটার গড় বয়স ৩১-এর উপর। নতুন জমানার প্রতিনিধি একমাত্র হ্যারি ব্রুক। ইংল্যন্ডের এই দলটাকে দেখে আমার ২০০৭-এর ভারত মনে পড়ছে। পার্থক্য, ইংল্যন্ড বিশ্বকাপের আগে পর্যন্ত তাদের রোলস রয়েস মসৃণ রাস্তায় ২০০ কিমি গতিতেই চালাচ্ছিল। বিশ্বকাপে ভারতের খানাখন্দ ভরা রাস্তায় এক্সেল ভেঙে বসে গেছে। কুরুক্ষেত্রে কর্ণ এবং এট অল!
আগেই বললাম, আবার বলছি। উইকেট অনুযায়ী উইলি এবং ক্রিস ওকস ভীষণ ভালো লেন্থে বল রেখেছেন। শুভমানের বলটা সিম করে ঢুকেছে, ঠিক যেন টেস্ট উইকেট। বিরাট বা শ্রেয়াস বলের বাউন্সের উপর উঠতে পারেননি। স্পঞ্জি বাউন্স, শ্রেয়াসের ক্ষেত্রে বলটার গতিও বৃদ্ধি পেয়েছিল। উইলির বলটা সিমের ঠিক ধারে পড়ে গতি ও উচ্চতা ধরে নেয়। রাহুলের ক্ষেত্রেও বাউন্সের উপর উঠতে পারেননি।
আর ঠিক এইখানেই রোহিত এবং বিশেষত সুরিয়াকে কৃতিত্ব দিতে হবে। রোহিত ডান হাতের ব্যবহার খুব নিশ্চিত হয়ে করছিলেন। কোনও টেন্টেটিভ পুস নয়, মারলে পুরোটা মারবেন, কিন্তু ডান হাত দিয়ে ইমপ্যাক্ট বা পাঞ্চ নিয়ন্ত্রণ করবেন, তাহলে বল নভোচারী হয়ে গন্তব্যের জায়গায় স্যাটেলাইট খুঁজবে না। আর সুরিয়া, বলের পেস ব্যবহার করে স্কোয়ার অব দ্য উইকেট খেলে গেছেন।
আরেকটা কথা, ব্যাটারদের যেমন বল করানো হচ্ছে, বোলারদেরও ধৈর্য ধরে ব্যাট করানো হচ্ছে। আগের মায়চে পাকিস্তান ৪৩তম ওভারে অল আউট হয়ে যায়। ভারত অপরদিকে, টেল এন্ডারদের সহায়তায় ২০০ তো পার করেই, আরও তিরিশ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। ফলস্বরূপ অতিরিক্ত চাপ।
এবার ভারতীয় বোলিং। নতুন বলে সিরাজ শুরু করছেন, মোহাম্মদ শামি নন কারণ সিরাজের থেকে ওয়াবল সিমে বল স্কিড করানো আশা করা হচ্ছে। সামি যখন আসবেন সোজা সিমে গতির সঙ্গে প্রথাগত স্যুইং করাবেন এটাই আশা করা হবে। কন্ট্রাস্ট স্যুইং নয়। সেটা করছেন বুমরাহ। আর বুমরাহর কবজি, লেন্থ এবং লাইনের হেরফের।
শামি মারাত্মক বল করছেন। সিম পজিশন একমাত্র তুলনীয় মিচেল স্টার্কের সঙ্গে। আর বুমরাহ! কী আর বলি। লোকে বিশ্বাস করবে না কিন্তু বুমরাহ থাকলে মোহাম্মদ শামি কেন, উমেশ যাদবও অপ্রতিরোধ্য হয়ে যাবেন। বিশ্বের বর্তমানে সেরা ডিফেন্সিভ বোলার, হ্যাজেলউডের থেকেও বেশি ভালো।
ইংল্যান্ডের ব্যাটিং নিয়ে দুটো কথা। ইংল্যন্ডের পঞ্চাশ ওভারে চারশ-পাঁচশ করা ব্যাটাররা মূলত পাঞ্চ করে খেলেন। একটা গুছিয়ে জ্যাব, সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে ছোট কিন্তু দ্রুত মুভমেন্টে বলকে পত্রপাঠ বাইরে ফেলা, কিন্তু ফলো থ্রু নেই। কিন্তু এই যে ছোট ছোট মুভমেন্ট, সহজ হয়ে আসা পিচে শিশিরকে অসুবিধা না ভেবে বরং বল স্কিড করানোর সহায়ক করে ফেলা, এগুলো ভারতীয় বোলাররা দারুণ রপ্ত করে ফেলেছেন। জোরে বোলারদের কথা বলছি।
স্পিনারদের ক্ষেত্রে বল শুকনো রাখাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যা আউটফিল্ডাররা নিয়মিতভাবে করছেন। আর একটা কথা হল গতি। যে গতিতে স্পিনাররা বল করছেন। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি কুলদীপ কিছু কিছু বল আরেকটু ধীর গতিতে করলে পছন্দ করতাম। কিন্তু যেখানে ৮০-৮৯ কিমি গতিবেগ ব্যাটারের নাভিশ্বাস তুলতে সাহায্য করছে, সেখানে আমি আর আলাদা করে কী বলব।
কাল ইংল্যন্ডের ব্যাটারদের দম বন্ধ করে আউট করা হয়েছে, মালান বা বেয়ারস্টো, শরীরের কাছের বল পাঞ্চ করে খেলেন, সেখানে সামান্য সিম মুভমেন্টে খোঁচা লেগে যা তা হতে পারে। রুটের আউটের আগে, টিভিতে দেখছিলাম বিরাট রোহিতকে বারবার দ্বিতীয় স্লিপের জায়গায় শর্ট কভার নিতে বলছেন, রোহিত অপেক্ষা করতে বলছেন, আর রোহিত শর্ট কভার চাইলে বুমরাহ দ্বিতীয় স্লিপ নিয়েই কাজ করতে চাইছেন।
এটাই আমি পাকিস্তানের বোলিঙের সময় বলছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। চাপ কম করা যাবে না, বরং বাড়াতে হবে। রুট আসতেই রুটের ফ্লিক আটকাতে একটা ওয়াইড লেগ গালি, আর দুটো স্লিপ। বুমরাহর স্যুইং সামলাতে রুট সামনের পা চতুর্থ স্টাম্পে নিয়ে আসতে চাইলেন। পরিষ্কার এলবিডব্লিউ!
স্টোকসের ক্ষেত্রে বুঝতে হবে যে যেভাবে সাঁড়াশি দিয়ে বুমরাহ এবং শামি চেপে ধরছেন, তাতে বলের সিম মুভমেন্ট কমাতে বলকে মাটি কামড়ে আউটফিল্ডে পাঠাতে হবে, তাহলেই শিশিরে সিক্ত বল অতিরিক্ত সিম বা স্যুইং করা বন্ধ করবে। ঝুঁকি, চান্স এবং ফর্দাফাই!
একমাত্র বাটলারের ক্ষেত্রে মনে হয়েছে আত্মবিশ্বাসের কিছুই বাকি নেই। হতেই পারে যে পরপর ম্যাচ হেরে হেরে অধিনায়ক হিসাবে এটা হয়েছে। বিশ্বকাপটা পুরো ধ্বসে গেল ইংল্যান্ডের।
বিশ্বকাপের আগেই শক্ত সিরিজ খেলে ক্লান্তি নিয়ে আসা। তারপর বেশি বয়সী ব্যাটিং লাইনআপ, গিয়ার পরিবর্তন করার ক্ষমতার অভাব এবং ব্যাটিং ও বোলিং-এর ক্ষেত্রে সঠিক নেতার অভাব। নোয়ার জাহাজ জোয়ারের অপেক্ষায় বসে বসে ভাঁটিতেই কাদায় আটকে গেল।
আর ভারত? ভুললে চলবে না সুরিয়া এবং শামি প্রথম দলের খেলোয়াড় নন। কিন্তু পারফরম্যান্স দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন। সামিকে বসানো যাবে না। হার্দিক ফেরা পর্যন্ত সুরিয়াকেও নয়। ড্রেসিং রুমে অশ্বিন, কিষাণ অপেক্ষায়। তবে একটা কথা মনে করাব, ভারতীয় দল লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিংএর জায়গায় বোলিং শক্তি বাড়াতে অক্ষরকে সরিয়ে অশ্বিনকে শেষ মুহূর্তে ঢুকিয়েছে। তাহলে চূড়ান্ত একাদশ বাছার সময় লম্বা ল্যাজ নিয়ে ভাবনাটা কি ঠিক?
আর শ্রেয়াস বা গিলের রান না পাওয়া? দেখুন না, গিলের একটা বড় রান দরজার কোণে অপেক্ষা করছে আর শ্রেয়স উপর্যুপরি শট মারতে গিয়ে আউট হচ্ছেন, ফলস্বরূপ যদি আত্মবিশ্বাসের খামতি দেখা দেয় সেটাই ভয়ের। তবে এই টিম ম্যানেজমেন্ট এসব ছোটোখাটো বিচ্যুতিকে আমল দেয় না এটাই যা স্বস্তির। ৬-এ ৬।
একটা কথা, এই পেস বোলিং লাইন আপের সঙ্গে সাদা বলে একমাত্র তুলনীয় ২০০৩এর পেস অ্যাটাক। শ্রীনাথ-জাহির-নেহরা। কন্ট্রাস্ট স্যুইং, সিম এবং প্রথাগত স্যুইং বোলিঙের তিন কারিগর। ভারতের ফাইনাল খেলারও।
এবার বিজনেস এন্ড আসছে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলাটায় সতর্ক থাকতে হবে, নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধেও। কিন্তু আসল ক্রাঞ্চ ম্যাচ হল দক্ষিণ আফ্রিকা। ইডেনের উইকেটে অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে সমস্যা হবার কথা নয়। আর তাহলে সেমি ফাইনাল আর ফাইনাল। নকআউটে যেন গাড়ির হঠাৎ গতিরোধ না হয় সেইভাবেই তেল দিয়ে সার্ভিসিং করে রাখতে হবে। পঁচা শামুক বারবার সামনে পড়তে পড়তেই কিন্তু ডাইনোসর হয়ে ওঠে।