একটা রূপকথাই ছিল বটে; আইরিশ রূপকথা। এক যুগ বাদে আবারো যখন ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ ফিরছে, তখন ২০১১ বিশ্বকাপে ব্যাঙ্গালুরুর সেই রাতের গল্প স্মৃতি রোমন্থনের পাতায় ঠিকই উঠে আসে।
ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড। প্রতিবেশি দুই দেশের অসম লড়াই। কিন্তু সেই লড়াই-এ যেন এক বিন্দু ছাড় নেই। শক্তিমত্তার বিচারে ইংল্যান্ড যোজন যোজন এগিয়ে। তবে সবাইকে অবাক বিস্ময়ে ভাসিয়ে সেদিন রূপকথার জন্ম দিয়েছিল ‘আন্ডারডগ’ আয়ারল্যান্ড। আইরিশ রূপকথার নায়ক হিসেবে সেদিন আবির্ভূত হয়েছিলেন কেভিন ও’ব্রায়েন।
বিশ্বকাপের মঞ্চে বড় দলকে হারিয়ে আপসেট ঘটানো। আয়ারল্যান্ডের জন্য এ আর নতুন কী! ২০০৭ বিশ্বকাপেই পাকিস্তানকে হারিয়েছিল তাঁরা। তবে ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারানোটা আইরিশদের জন্য ছিল রূপকথার মতোই। বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সবচেয়ে চমকে দেওয়া জয়ের ঘটনা ছিল সেটি।
ব্যাঙ্গালুরুর এম চিন্বাস্বামী স্টেডিয়ামে সে দিন ম্যাচের শুরুটা ছিল ইংলিশ ব্যাটারদের প্রতাপেই। আক্রমণাত্বক ব্যাটিংয়ে স্কোরবোর্ডে ৩২৭ রান জমা করে এক রকম স্বস্তিতে ম্যাচ বিরতিতে গিয়েছিল অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের দল। তখন অবধি এত রান চেজ করে বিশ্বকাপের মঞ্চে কেউ জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেনি। সেখানে মাত্র দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে আসা আয়ারল্যান্ড যে দূর লক্ষ্যে এগোবে না, তা অনেকের কাছেই অনুমিত ছিল। স্বয়ং ইংলিশ ক্রিকেটাররা ম্যাচ বিরতিতেই পেয়ে গিয়েছিল জয়ের উপলক্ষ্য।
এর মধ্যে আবার এমন পাহাড়সম রান তাড়া করতে নেমে ১০৬ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলে আয়ারল্যান্ড। ইংল্যান্ডের হয়ে এক সময় খেলা এড জয়েস আবার তখন আইরিশদের হয়ে খেলছেন। দলের সেরা ব্যাটারও তিনি। কিন্তু দলের সংকটাপন্ন অবস্থায় আর হাল ধরতে পারলেই। তিনিও ফিরলেন, আইরিশদের স্কোরবোর্ডে যখন ১১১। ৩২৮ রানের লক্ষ্যে ১১১ রানেই নেই ৫ উইকেট। ম্যাচ তখন কার্যত আইরিশদের নাগালের বাইরেই চলে গেছে বলা যায়।
তবে কী মনে করে তখন কেভিন ও’ব্রায়ান ইংলিশ বোলারদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালাতে লাগলেন। গ্রায়েম সোয়ানের উপর শুরু থেকেই চড়াও হলেন। এরপর ইংলিশ বোলারদের একের পর এক করা ডেলিভারি আছড়ে ফেলছিলেন ব্যাঙ্গালুরুর গ্যালারিতে।
তবে কতক্ষণই বা চলবে সেই পাল্টা আক্রমণ? আইরিশদের সামনে লক্ষ্যটা তখনো প্রায় অসম্ভবের পথে। আবার কেভিন ও ব্রায়ান এমন ব্যাটারও নন যে, সেঞ্চুরি করে ম্যাচ জেতাতে অভ্যস্ত। কারণ তখন পর্যন্ত একদিনের ক্রিকেটে কেভিনের পাশে সেঞ্চুরি সংখ্যা যে মাত্র ১।
তবে ব্যাঙ্গালুরুতে সেদিন বোধহয় অতি মানবীয় কিছু একটা ভর করেছিল কেভিন ও’ব্রায়েনের উপরে। আক্রমণাত্বক ব্যাটিংয়ের ধারা অব্যাহত রাখছিলেন ইনিংস জুড়েই। বোঝা যাচ্ছিল, তিনি নেহায়েতই ম্যাচ পরাজয়ের ব্যবধান কমাতে আসেননি, চোখ রাখছেন ম্যাচ জয়ের দিকেও।
এরপর থেকে ব্যাঙ্গালুরুর গ্যালারিতে থাকা দর্শকরা কেবল বিস্ফারিত চোখেই কেভিনকে আবিস্কার করেছেন। মাত্র ৩০ বলেই পৌঁছে ব্যক্তিগত অর্ধশতকে। তবে তখন পর্যন্ত কেভিন ও ব্রায়ানের কাজটা শেষ হয়নি। এর পরে ব্যাট হাতে আরো বিস্ফোরক ভূমিকায় হাজির হন তিনি। পরের ২০ বলে তুলে ফেলেন ৫০ রান। ফলত, মাত্র ৫০ বলেই শতক হাঁকান কেভিন ও ব্রায়ান। আর এর মধ্য দিয়েই ওয়ানডে বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডে নাম লেখান আইরিশ এ ব্যাটার।
১১১ রানে ৫ উইকেট পড়ার পর অ্যালেক্স কুসাকের সাথে কেভিন ও’ ব্রায়েনের মাত্র ১০৩ বলে ১৬৩ রানের দুর্দান্ত জুটিটাই মূলত সেদিন গড়ে দিয়েছিল ম্যাচের ভাগ্য। দলীয় ২৭৩ রানের মাথায় রান আউটে কাটা পড়েন ৫৮ বলে ৪৭ রান করা কুসাক। তবে তখনও ইংলিশ শিবিরে স্বস্তি ফেরেনি। কারণ উইকেটে তখন পর্যন্ত টিকে ছিলেন কেভিন ও ব্রায়ান।
তবে লক্ষ্য থেকে ১১ রান বাকি থাকতে ৩১৭ রানের মাথায় ও’ব্রায়েন নিজেও কাটা পড়েন রান আউটের চক্রে। আইরিশদের তখন চাই ১১ বলে ১১ রান। ৭ উইকেটের পতনসহ কেভিন ফিরে যাওয়া ইংল্যান্ড তখন ম্যাচটা নিজেদের দিকে নেওয়ার পথেই ছিল।
তবে কেভিন ও ব্রায়ানের অমন ইনিংসের পর সতীর্থদের মধ্যেও ছড়িয়ে গিয়েছিল উত্তাপ। আর তাই কেভিনের সেই লড়াই সেদিন বৃথা যেতে দেয়নি জন মুনি আর ট্রেন্ট জন্সটন। তাদের ব্যাটে চড়েই আয়ারল্যান্ড পায় তাদের ইতিহাসের স্মরণীয় এক জয়। শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয় পাওয়ার নতুন রেকর্ড গড়ে আয়ারল্যান্ড। যা এখন পর্যন্ত অক্ষত রয়েছে।
২০১১ বিশ্বকাপের পর আবারো ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ। আবারো আতিথিয়েতা দিবে সেই আইরিশ রূপকথার স্বাক্ষী হওয়া ব্যাঙ্গালুরুর এম চিন্বাস্বামী স্টেডিয়াম। তবে এবারের বিশ্বকাপের মঞ্চে নেই আয়ারল্যান্ড। ১০ দলের বিশ্বকাপ চালুর পর থেকে দলটা আর বিশ্বকাপই খেলতে পারেনি। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপটাই এখন পর্যন্ত তাদের অংশ নেওয়া শেষ বিশ্বকাপ হয়ে গেছে।
আর ৬৩ বলে ১১৩ রান করে সেদিন আইরিশ রূপকথার জন্ম দেওয়া কেভিন ও’ব্রায়েন ক্রিকেট ছেড়েছেন কয়েক বছর আগে। এক যুগ বাদে, উপমহাদেশের মাটিতে হতে যাওয়া এবারের বিশ্বকাপে নিশ্চয়ই এক ধরনের স্মৃতিকাতরতা অনুভব করবেন আইরিশ এ কিংবদন্তি ক্রিকেটার।
বাইশ গজে কেভিন ও’ব্রায়ান নেই, বিশ্বকাপে নেই আয়ারল্যান্ডও। তবে এই সব রূপকথার গল্পই তো বিশ্বকাপে তাদের বারবার ফিরিয়ে আনে। আর অমরত্ব পেয়ে যায় কেভিন ও’ ব্রায়েনের অমন নায়কোচিত ইনিংস। শেষ ৮ বছরে বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ড এক প্রকার বিলীন হয়ে গেলেও, বিশ্বকাপের ইতিহাসে তাঁরা স্মরণীয় হয়ে আছে ঠিকই। একই ভাবে, ‘ফিরে দেখা’র পাতায় স্মরণীয় দৃশ্যের নায়ক হিসেবে বারবার আবির্ভূত হবেন কেভিন ও’ব্রায়েনও।