বিশ্বব্যর্থতা থেকে বিশ্বরেকর্ড

২০১৮ সালের ১৪ মে। বিশ্বকাপ খেলতে না পারার ব্যর্থতায় কোচ ছাটাই করে  ইতালি জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বরার্তো ম্যানচিনিকে। এরপর ধীরে ধীরে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে নতুনভাবেই শুরু করে তাঁরা।

গুনে গুনে দায়িত্ব নেওয়ার ১১৫৫ দিন পর ইউরো ২০২০ এর শিরোপা জেতে ম্যানচিনির দল। তিলে তিলে গড়ে তোলা দলটি ২৭ ম্যাচ অপরাজিত থেকে ইউরোতে খেলতে আসে। পুরো টুর্নামেন্টে অপরাজিত থেকে সংখ্যাটা নিয়ে যান ৩৪ এ! এখন আবার বিশ্বকাপ বাছাইয়ের খেলা শুরু হয়েছে।

এখানেও অপ্রতিরোধ্য দলটির নাম ইতালি। আন্তর্জাতিক ফুটবলের শুরুতেইন বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ড্র করে সংখ্যায় ব্রাজিল ও স্পেনের সমকক্ষ হয়ে যায় ইতালি। এরপর সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করে সংখ্যাটা চলে যায় ৩৬ এ। আর বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে লিথুয়ানিয়াকে ৫-০ গোলে হারানোর পর সংখ্যাটা এখন ৩৭! যা থেকে উন্নতি করছেন সেটিকে অহংকারের বড় একটা জায়গাই তৈরি করে ফেলেছে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।

নিজেদের ব্যর্থতার কারণে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলা হয়নি ইতালির। এ যেন দেশটির ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হয়ে ছিল। সর্বশেষ বিশ্বকাপে যে কোয়ালিফাই করতে পারেনি ইতালি সেটি কি অপনাদের মনে আছে?

দেশটির ফুটবলের ৬০ বছরের ইতিহাসে এই ঘটনার পর থেকেই নতুন করে বিনির্মান করা শুরু হয়। এরপর দলের দায়িত্ব নিয়ে রবার্তো ম্যানচিনি ৩৭ ম্যাচে অপরাজিত রেখেছেন ইতালিকে। সেটি দিয়ে আবার হয়ে গেছে বিশ্বরেকর্ডও।

ইউরো ২০২০’র ফাইনালে টাইব্র্রেকারে জর্জিনহোর ব্যর্থতা ঢাকা পড়েছিল সতীর্থদের নৈপুণ্যে। কিন্তু এবার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তার পেনাল্টি মিস হয়ে থাকল ইতালির হতাশার অন্যতম কারণ। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে বাসেলে খেলায় জর্জিনহোর স্পটকিক ঠেকিয়ে দেন ইউরোতে দারুণ পারফর্ম করা গোলরক্ষক ইয়ান সমের। ইউরোর ফাইনালের পর টানা দ্বিতীয় ড্র এটি ইতালির। তবে জয় না পেলেও দারুণ এক কীর্তি গড়েছে আজ্জুরিরা।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে টানা সবচেয়ে বেশি ম্যাচ (৩৬) অপরাজিত থাকার রেকর্ড নিজেদের করে নিয়েছে ইতালি। যাতে পেছনে পড়ে গেছে ব্রাজিল ও স্পেন। ব্রাজিলের ৩৫ ম্যাচের রেকর্ড ছিল ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আর স্পেনের রেকর্ড ২০০৭ থেকে ২০০৯ সময়ে। কাতার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে পাঁচ ম্যাচে তিন জয় ও দুই ড্রয়ে ‘সি’ গ্রুপের শীর্ষে এখন ইতালি।

সুইসদের বিপক্ষে ড্র ম্যাচে তাই আলাদা আলো চলে গেছে সর্বশেষ ইউরো বিজয়ীদের। সবার নজর ছিল ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকা ব্রাজিল ও স্পেনের রেকর্ড তারা ভাঙতে পারেন কিনা। জয় না পেলেও ড্র দিয়ে রেকর্ডটা করেই ফেলেছেন ইউরোপের দলটি। সে কারণেই বলা হচ্ছে, ’হারতে ভুলে যাওয়া ইতালির কাছেই গেল সর্বাধিক ম্যাচ অপরাজিত থাকার বিশ্ব রেকর্ডটি।’

যদিও প্রায় দুই মাস আগে ইউরো জেতা দলটি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে এখনো নিজেদের সেভাবে ফিরে পায়নি। গেল সপ্তাহে ঘরের মাঠে বুলগেরিয়ার সঙ্গে ড্র করেছিল ইতালি। এবার জয়ের সূবর্ণ সুযোগ পেয়েও সেটিকে কাজে লাগাতে পারেনি তারা। তবে এখানে ব্রাজিলের রেকর্ডটি ৩৬ ম্যাচের বলে দাবি করা হতো একসময়। কারণ পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলটি দাবি করত, তারা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত ছিল।

কিন্তু ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে রোমানিয়ার সঙ্গে ২-২ গোলের ড্র ম্যাচটি এই হিসাবে রাখতে রাজি নন পরিসংখ্যানবিদদের কেউ। যেহেতু সে ম্যাচ রোমানিয়ার ‘বি’ দল খেলেছিল, তাই সেটা ফিফার কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক ম্যাচের স্বীকৃতি পায়নি কখনোই। সে কারণেই ইতালির বিশ্বরেকর্ড নিয়ে এ ধরনের কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।

পরিসংখ্যান বলছে, ইতালি সবশেষ পরাজয়ের মুখ দেখেছিল ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। ন্যাশনস লিগের গ্রুপ পর্বে সেবারের চ্যাম্পিয়ন পর্তুগালের কাছে ১-০ গোলের হেরেছিল। এরপর ইউক্রেনের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র দিয়ে অপরাজিত থাকার যে যাত্রাটা শুরু করেছিল সেটি প্রায় তিনবছর ধরেই অক্ষত রয়েছে। পরাজয়েল সেই ঘোড়াটা ছুটে চলেছে দুরন্ত দুর্বার গতিতে। এই সময়ের মধ্যে ইতালি ২৯টি ম্যাচ জিতেছে আর ড্র করেছে ৭টি।

এর মধ্যে আবার ইউরোর সেমিফাইনাল, ফাইনালও আছে। দুই ম্যাচে পেনাল্টি শুটআউটের মাধ্যমে জয় পেয়েছে ইতালি। বিশ্বকাপে জায়গা না পাওয়া দলটি গেল তিন বছরের মধ্যে এমন রেকর্ড গড়া নিশ্চিতভাবেই বিস্ময়কর কিছু। জিয়ান পিয়েরো ভেনতুরার অধীনের পথ হারানো ইতালি রবার্তো মানচিনির ছোঁয়ায় পুরনো রুপে জেগে উঠেছে। তবু ইউরোর আগে ইতালির খুব একটা সম্ভাবনা দেখছিলেন না বিশ্লেষকদের কেউ।

ইউরোর আগে বাছাইপর্বে দাপট দেখালেও ওই সময় পর্যন্ত তথাকথিত বড় দলের সঙ্গে শুধু একটি ম্যাচই খেলার সুযোগ পেয়েছিল তারা। কিন্তু ইউরোতে বেলজিয়ামকে দাপটের সঙ্গে হারানোর পর স্পেন ও ইংল্যান্ডকে টপকেই শিরোপা জয় নিশ্চিত করেছে। ৫৩ বছর পর ইউরো জেতা ইতালি এবার তো বিশ্ব রেকর্ড করে বসল!

যদিও সবদিক থেকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অপরাজেয় থাকার মূল রেকর্ডটি নিজেদের দখলে নিতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হবে ইতালিকে। ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৫১ ম্যাচে অপরাজিত ছিল যুক্তরাষ্ট্র নারী ফুটবল দল। যদিও সেটি নিয়ে খুব একটা ভাবনা চিন্তাও নেই তাদের মধ্যে। এর আগে ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ সালের মাঝের এই তিন বছরও দুর্দান্ত ফুটবল খেলেছিল ইতালি।

তখনকার কোচ ভিত্তোরিও পাজ্জোর অধীনে টানা ৩০ ম্যাচ অপরাজিত ছিল দলটিল। গত ইউরোতে অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে জিতে নিজেদের ৮২ বছরের পুরোনো সেই রেকর্ড ভেঙে টানা ৩১ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ইতালি। পরে বেলজিয়াম, স্পেন ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জিতে ইউরো জয়ের পাশাপাশি সংখ্যাটা ৩৪ –এ নিয়ে গিয়েছিল মানচিনির দল।

এরপর ইউরো জয়ের রেশ ধরে রেখে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচেও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে ইতালি। বিশ্বকাপ খেলতে না পারার ব্যর্থতা কাটাতে এরপর ঢেলে সাজানোর কোন বিকল্প ছিলনা। সেটাই করল দেশটির ফুটবল ফেডারেশন। ইংল্যান্ডে ক্লাব ফুটবলে কোচিং করানো রবার্তো ম্যানচিনিকে ধ্বংসস্তুপ থেকে টেনে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরের গল্পটা ইউরো ২০২০ টুর্নামেন্টের কল্যানে সবাই এরই মধ্যে জেনে গেছেন। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ৩-২ গোলে পরাজিত করে ৫৩ বছর পর শিরোপা পূনরুদ্ধার করার পর আলোচনাটা একটু বেশিই হচ্ছে। অনেকটা রুপকথার গল্পের মতোই প্রত্যাবর্তন হয়েছে ইতালির।

নিজেদের ফুটবল রেনেসা ফিরে পাওয়াটাকেই বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন দেশটির ফুটবল বিশ্লেষকরা। রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলতে না পারা দেশটিই হয়েছে ইউরোপ সেরা। ইংল্যান্ডের মাটিতে ভরা গ্যালারীতে অনেকটা প্রতিকুল পরিস্থিতিতে খেলেই শিরোপা জয় করে রবার্তো ম্যানচিনির দল। যেখানে আরেকবারের মতো ব্যর্থ মনোরথে ফিরে যেতে হয়েছে গ্যারেথ সাউথগেটের শীষ্যদের।

৫৫ বছর পর কোন বড় আসরের ফাইনালে খেললেও শিরোপা জেতা হয়নি স্বাগতিক দলের। নির্ধারিত সময়ে খেলা ১-১ গোলে ড্রয়ের পর খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেই সময়েও কোন গোল না হওয়ায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। পাঁচ শটের এই লড়াইয়ে ৩-২ ব্যবধানে জিতে শিরোপা নিয়ে বাড়ি ফেরে ইতালি।’হোমে’ না ফিরে শিরোপা চলে যায় ’রোমে’। ইউরোতে এটি ইতালীর দ্বিতীয় শিরোপা জয়। ১৯৬৮ সালে প্রথম ও সর্বশেষবার শিরোপা জিতেছিল তারা। সেই ইতালিই ছুটছে এখন অবিশ্বাস্য গতিতে। যেখানে এখন নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্বন্ধী হয়ে গেছে। একটা করে ম্যাচ জিতবে কিংবা ড্র করবে তখনি ’অপরাজিত’ থাকার রেকর্ডটা আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link