অপূর্ণ এক স্বপ্ন ও একটু বাংলাদেশ

১৯৯১-৯২ মৌসুমে মার্ভ হিউজের এক বাউন্সার আসে শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচ চলাকালে। সেই বাউন্সার তাঁর সম্ভাবনা ও আত্মবিশ্বাস – দুটোই শেষ করে দেয়। সিডন্স বলেন, ‘ওটা আমার অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার স্বপ্ন শেষ করে দেয়। ক্যারিয়ারে ওরকম খারাপ সময় আর আসেনি আমার।’

২০১০ সাল। অস্ট্রেলিয়ান পত্রিকা সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে একটা সাক্ষাৎকার বের হল দেশটির সাবেক হয়ে যাওয়া এক ক্রিকেটারের। না, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তেমন একটা খেলা হয়নি সেই ফার্স্ট ক্লাস কিংবদন্তির। তবে, শীর্ষ পর্যায়ের কোচিংয়ে তিনি বেশ অভিজ্ঞ।

সেই সাক্ষাৎকারে তিনি রীতিমত বোমা ফাঁটান। বলেন, ‘ডায়নামাইটের মতো কয়েকজন ক্রিকেটার আছে আমার দলে। সাকিব (আল হাসান) অস্ট্রেলিয়া দলে ছয় নম্বরে ব্যাট করতে পারে, হতে পারে এক নম্বর স্পিনারও। আর শেন ওয়াটসনের সঙ্গে তামিম ইকবাল দিব্যি ওপেন করার সামর্থ্য রাখে।’

ভুল বলেননি তিনি, কালক্রমে সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল দু’জনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের প্রমাণ করেছেন। সেই সাক্ষাৎকার দেওয়া লোকটি হলেন জেমি সিডন্স। হ্যাঁ, বাংলাদেশের সাবেক কোচ জেমি সিডন্স।

জেমি সিডন্সের জমানাটা কেমন ছিল? সাফল্যের বিচারে অনেক বড় কিছু না হলেও, এটুকু বলা যায় যে ডেভ হোয়াটমোর যে উন্নতির ধারা চালু করেছিলেন সেটা সিডন্সের জমানায়ও বজায় ছিল। আর সেই ধারাটা ধরে রাখা সহজ ছিল না।

একগাদা ক্রিকেটার বিদ্রোহ ঘোষণা করে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএল) নাম লেখায়। ফলে, শীর্ষ ক্রিকেটারদের সংকট তৈরি হয়। এই অবস্থায় প্রথম সিডন্সের দল মাঠে নেমেই দেশের মাটিতে হারায় নিউজিল্যান্ডকে।

হ্যাঁ, ওখান থেকে আরেকটা নতুন বাংলাদেশের শুরু হয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ বাংলাদেশ দল ১৯ টি ওয়ানডে খেলে জিতে তাঁর ১৪ টিতেই। তিন টেস্টের জিতে দু’টিতে। ২০১০ সালে হোয়াইটওয়াশ হয় নিউজিল্যান্ড।

সেই অবস্থায় ২০১১ বিশ্বকাপটা স্মরণীয় হতে পারতো পরিচিত কন্ডিশনে। হয়নি, বুকের দগ দগে ঘাঁ হয়ে সাকিব আল হাসানের দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৮ রানে অল আউট হয়। ইংল্যান্ডকে হারালেও তাই খুব বেশি লাভ হয়নি।

এর ওপর বিশ্বকাপের আগে মাশরাফি বিন মুর্তজা দলে জায়গা না পাওয়ায় কম জল ঘোলা হয়নি। তাতে জেমি সিডন্সের নামও জড়িয়ে যায়। ফলে, বিশ্বকাপ শেষেই জেমির বিদায় ঘণ্টা বাজে।

এটা ঠিক যে, জেমি সিডন্সকে বড় আশা করে বাংলাদেশ ক্রিকেট উড়িয়ে এনেছিল। বাংলাদেশে আসার আগে অস্ট্রেলিয়ার সহকারী কোচ ছিলেন। সেই অস্ট্রেলিয়া দল যেখানে রীতিমত পন্টিং, ল্যাঙ্গার, ওয়ার্নরা খেলেন। ফলে, তাঁর ওপর প্রত্যাশার চাপ স্বাভাবিক ভাবেই ছিল বেশি। কখনো প্রত্যাশার চাপ মিটিয়েছে, কখনো পারেননি।

বিশেষ করে বিশ্বকাপটার পারফরম্যান্সই তাঁর বাংলাদেশ অভিজ্ঞতাটাকে সাদামাটা করে দেয়। যদিও, এট ঠিক যে, তাঁর দলের মূল সদস্যরা কালক্রমে লম্বা সময় বাংলাদেশ দলকে সার্ভিস দিয়েছেন, এখনও দিয়ে যাচ্ছেন।

সিডন্সের কোচিং ক্যারিয়ারটা বাদ দিলেও অবশ্য তাঁকে নিয়ে মহাকাব্য লেখা যায়। তিনি অস্ট্রেলিয়ান টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের বিরাট এক আক্ষেপ। টেস্ট ক্রিকেট? যিনি টেস্টই কখনো খেলেননি – তিনি কি করে আক্ষেপ হন? হন, কারণ ভাগ্য তাঁকে কখনো টেস্ট খেলতেই দেয়নি সামর্থ্য থাকার পরও।

শেফিল্ড শিল্ডে তিনি ১০,৬৪৩ রান করেন, অথচ, তাঁকে কখনো দেখাই যায়নি টেস্ট ক্রিকেটে। দেখা যাবে কি করে! জেমি যখন অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে বিরাট বিরাট সব স্কোর করে চলেছেন – তখন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটিং লাইন আপের সবাই একেকজন কিংবদন্তি। অ্যালান বোর্ডার, স্টিভ ওয়াহ, মার্ক ওয়াহ, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, রিকি পন্টিং – কে নেই!

তবে, একবার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন টেস্ট দলের। ১৯৮৮ সালে ক্যারিয়ারের একমাত্র ওয়ানডে ম্যাচটা খেলেন। এরপর তিনি পাকস্থলীর বিচিত্র এক রোগে এক বছরের জন্য ছিটকে যান। তবে, ইনজুরি থেকে ফিরেও তিনি আলোচনায় ছিলেন।

কিন্তু, এরপর ১৯৯১-৯২ মৌসুমে মার্ভ হিউজের এক বাউন্সার আসে শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচ চলাকালে। সেই বাউন্সার তাঁর সম্ভাবনা ও আত্মবিশ্বাস – দুটোই শেষ করে দেয়। সিডন্স বলেন, ‘ওটা আমার অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার স্বপ্ন শেষ করে দেয়। ক্যারিয়ারে ওরকম খারাপ সময় আর আসেনি আমার।’

একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি।

শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচ চলছে। মাত্রই উইকেটে এসেছেন স্টিভ ওয়াহ। স্লিপে দাঁড়িয়ে সিডন্স।

স্টিভ স্টান্স নিতে একটু বেশিই সময় নিচ্ছিলেন। সিডন্স পেছন থেকে টিপ্পনি কেটে বলেন, ‘স্টিভ, ওপরওয়ালার দোহাই, এটা তো আর টেস্ট ম্যাচ নয়।’

স্টিভ ওয়াহ সুযোগটা ছাড়লেন না। পাল্টা খোঁচা দিলেন, ‘অবশ্যই এটা টেস্ট নয়। কারণ, এখানে তুমি আছো!’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...