তখন ছক্কা মারাটা আজকের মতো এতোটা সহজ বা স্বাভাবিক ছিল না।
প্রথমত, বল উড়িয়ে মারার চিন্তা করাও তখনকার ব্যাটসম্যানদের জন্য রীতিমতো পাপের পর্যায়ে পড়তো। দ্বিতীয়ত, যে সময়ের কথা বলছি, তখন বল উড়ে গিয়ে সীমানা দড়ির বাইরে পড়লে সেটা ছয় হতো না, হতো পাঁচ। তাহলে ছক্কা কিভাবে মারবে ব্যাটসম্যান? হ্যাঁ, ছক্কাও মারা যেতো, তবে তার জন্য বলকে পাঠাতে হতো মাঠের বাইরে।
তা এতো হ্যাপা পোহানোর দরকারটা কি বাপু? ছক্কা না মারলেই তো হলো! সিঙ্গেল নাও, ডাবল নাও, লাগলে না হয় চার মারো – ছক্কাই মারতে হবে নাকি?
‘হ্যাঁ, ছক্কাই মারতে হবে’ – এটাই বোধহয় তিনি সেদিন বলেছিলেন নিজেকে।
সাহসের মাত্রাটা বুঝাবে আরো একটা তথ্য, আসলে ছক্কা মেরে তিনি পূরণ করতে চাইছিলেন নিজের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরি। যেই ভাবা, সেই কাজ। ইংলিশ স্পিনার জনি ব্রিগসের আপাত নিরীহ বলটার গতিপথ ঠিকভাবেই বুঝে নিলেন, এরপর সজোরে হাকালেন ব্যাট। শর্ট স্কয়ার লেগ দিয়ে নিমিষে উড়ে গেল বল। উড়ছে তো যেন উড়ছেই! উড়তে উড়তে সীমানা দড়ি তো দড়ি, অ্যা ডিলেড ওভালের মাঠ ছাড়িয়ে সেই বল গিয়ে পড়লো পাশের এক পার্কে।
ছক্কা! ছক্কা! ছক্কা!
এই ছক্কাটার সাথে কোনকিছুরই তুলনা নেই, এই ছক্কার মতো কিছুই এর আগে দেখেনি টেস্ট ক্রিকেট! কেন? কেন? কেন? আবার কেন? সেটাই যে টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ছক্কা! ছক্কা মেরে সেঞ্চুরিতে পৌছানোরও তাই সেটাই প্রথম ঘটনা!
সেঞ্চুরি পূরণ করলেন, দিনশেষে অপরাজিত রইলেন ১৭৮ রানে। পরদিন আর কোন রান যোগ না করেই আউট হয়ে ফিরলেন। অ্যাডিলেড টেস্টটা ছিল ১৮৯৭-৯৮ অ্যাশেজের তৃতীয় টেস্ট। সিডনিতে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসেও করেছিলেন সেঞ্চুরি। এক গেল, তিন গেল, পাঁচ নম্বরটা আর বাকি থাকে কেন? থাকলো না। পঞ্চম টেস্টে সিডনিতে আবার করলেন সেঞ্চুরি। এক সিরিজে একের অধিক সেঞ্চুরিও তখন ক্রিকেটে একমেবাদ্বিতীয়ম।
ক্যারিয়ারে ৩৪ টি টেস্ট খেলা এই বাঁ-হাতি অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান এই তিনের পর আর কোন সেঞ্চুরির দেখা পাননি তাঁর ক্যারিয়ারে।
ভাবছেন, বাকি সময়টা নিশ্চয়ই বেশ পানসে গেছে, তাই তো? একদমই না। পরের বছরের অ্যাশেজটা খেলতে অস্ট্রেলিয়া যখন ইংল্যান্ডে গেল, তিনি তখন সেই অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়ক, ১-০ ব্যবধানে জয় নিয়ে ফিরেছিলেন সেবার। এরপর আরো দুটি এশেজে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক হয়ে ইংল্যান্ডে গেছেন, ১৯০২ ও ১৯০৫ সালে। প্রথমটায় জিতেছিলেন, আর হেরেছিলেন দ্বিতীয়টিতে।
১৯০৫-এর সেই অ্যাশেজে পাঁচ টেস্টের পাঁচটিতেই টসে হেরেছিলেন, পাঁচটিতেই প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের অধিনায়ক টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পাঁচ টেস্টের কোন সিরিজের সব ম্যাচেই টসে হারার (বা জেতার) ঘটনাও সেটাই প্রথম।
ইংলিশ অধিনায়কের এই ‘টস ভাগ্য’কে যেন একটু বাড়াবাড়িই মনে হচ্ছিল তার কাছে। পঞ্চম টেস্ট শেষে স্কারবোরোতে আয়োজিত তিনদিনের এক ম্যাচে অংশ নিয়ে দেখেন সেই ইংলিশ অধিনায়কই এই ম্যাচেও প্রতিপক্ষ সিআই থর্নটন’স একাদশের অধিনায়ক। রোখ চেপে গেল মাথায়। কোমরে একটা টাওয়েল জড়িয়ে প্রতিপক্ষের ড্রেসিংরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন, পথেই দেখা হয়ে গেল ‘কাঙ্খিত শত্রু’র সাথে। চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘এবার আর টসের ঝুঁকি নেবো না। বরং কুস্তি করবো; যে জিতবে, সে আগে ব্যাট করবে।’
কিন্তু চাইলেই তো আর সবকিছু করা যায় না। তিনদিনের সেই ম্যাচেও কুস্তি নয়, বরং টসই হলো। আর সেবারও টসে হারলেন সেই অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কই, আবারো প্রতিপক্ষ অধিনায়ক আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
২১ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিয়ে জিতেছেন সাত টেস্ট, ড্র করেছেন দশটি। ১৯০৫ এর এশেজ শেষে আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেননি। ১৯০৮ পর্যন্ত অ্যাডিলেডে থেকে এরপর চলে গেছেন তাসমানিয়ায়, সেখানে ব্যস্ত হয়েছেন কৃষিকাজে।
টেস্ট ক্রিকেটে বেশ কয়েকটা প্রথমের জন্ম দেয়া সেই ক্রিকেটার জো ডার্লিং জন্মেছিলেন ২১ নভেম্বর, ১৮৭০ সালে, অ্যাডিলেডে।
ঠিক একই বছরের একই দিনে ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে জন্মেছিলেন আরো এক ক্রিকেটার। তিনি কে জানেন? জো-এর সেই প্রতিপক্ষ অধিনায়ক, স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। যিনি একাধারে ক্রিকেটার, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল, সংসদ সদস্য ছিলেন; ২০ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৪৮.৮ গড়ে যিনি ১৪১৫ রান করেছেন, ২৪টি উইকেট শিকার করেছেন; স্কারবোরোতে টসে জেতা সেই ম্যাচে যিনি দলীয় সর্বোচ্চ ১২৩ রান করেছিলেন এবং যিনি ১৯২৭ সালে বাংলার গভর্ণর নিযুক্ত হয়েছিলেন।