ঐ নীল চোখের বিশালতায়…

ইয়োর্কশায়ারের অন্য দশটা বাচ্চার মত এদিনও স্কুল শেষে ছোট বোনকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল আট বছরের জোনাথন। বাড়ি ফিরে যা হয়, দুই ভাইবোনের মাঝে লড়াই কে আগে দৌড়ে যাবে বাবার কোলে। কিন্তু বাবার ঘরে গিয়ে স্তব্ধ হতে হয় দুজনকেই। জীবনযুদ্ধের প্রতিনিয়ত লড়াইয়ে হার মেনে বাবা যে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারের উদ্দেশ্যে।

আত্নহননের সবচেয়ে সহজ পথটাই বেছে নিয়েছিলেন। ফলে ঘরে ফিরে জোনাথন আর বেকি আবিস্কার করেছিল নিথর ঝুলন্ত বাবাকে। সময়ের পালাবদলে সেদিনের জোনাথন আজ পরিণত, ইংল্যান্ডকে এনে দিয়েছেন তাদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ। তবুও আজও  দুঃস্বপ্ন হয়ে হানা দেয় সেদিনের সেই ছবি। তিনি জোনাথন মার্ক বেয়ারস্টো, বিশ্ববাসী যাকে চেনে জনি বেয়ারস্টো নামেই। 

অথচ ছোটবেলার শুরুটা কি রঙিনভাবেই না শুরু হয়েছিল জনির। বাবা ইংল্যান্ড জাতীয় দলের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। ইয়োর্কশায়ারের সবাই সম্মানের চোখে দেখে তাদের পরিবারকে। জনির চোখে তখন ফুটবলার হবার স্বপ্ন, বল পায়ে সবুজ গালিচায় দৌড়ে বেড়াতেই তাঁর প্রশান্তি। কিন্তু সবকিছু এলোমেলো করে দেয় জনির মা জ্যানেটের অসুস্থতা।

জ্যানেট আক্রান্ত হন ক্যান্সারে, স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ বহন করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যান ডেভিড। তাঁর আত্নহত্যার পর সন্তানদের নিয়ে অকূল পাথারে পড়েন জ্যানেট। জীবনের এই দু:সময়ে ঢাল হয়ে দাঁড়ান জনির দাদা। জনিকে ফুটবলের বদলে হাতে তুলে দেন ক্রিকেট ব্যাট। বাবার অপূর্ণ স্বপ্নটা যে পূরণ করতে হবে তাঁকে। 

ইয়োর্কশায়ারের বয়সভিত্তিক দলগুলোর হয়ে খেলা শুরু করেন বেয়ারস্টো। খুব দ্রুতই খুলে যায় মূল দলের দরজাও। মাইকেল ভনের ইনজুরিতে সুযোগ পেয়ে যান সমারসেটের বিপক্ষে। সুযোগ কাজে লাগাতেও ভুল করেননি, দ্বিতীয় ইনিংসেই খেলেন ৮২ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস। 

পাশাপাশি উইকেটের পেছনে দাড়িয়েও ছিলেন সমান সাবলীল, দারুণ দক্ষতায় লুফে নেন চারটি ক্যাচ। দারুণ পারফর্ম করার সুবাদে জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যায় বছর দুয়েকের মাঝেই। কার্ডিফে ভারতের বিপক্ষে একদিনের ক্রিকেটে অভিষেক হয় তাঁর।

টি-টোয়ন্টিতে আর টেস্টেও খুব দ্রুতই অভিষেক হলেও ব্যাট হাতে ঠিক পারফর্ম করতে পারছিলেন না। তবে সুযোগটা এসে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, মরনে মরকেল-ডেল স্টেইনদের সামলে খেলেন ৮১ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। এরপর লাল বলের ক্রিকেটে দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও সাদা বলের ক্রিকেটে ঠিক পারফর্ম করতে পারছিলেন না। ফলে বাদ পড়ে যান দল থেকে। 

দক্ষিণ আফ্রিকা বরাবরই পয়মন্ত ছিল বেয়ারেস্টোর জন্য। যখনই আফ্রিকা সফরে গিয়েছেন, ক্রিকেটদেবতা দুহাত ভরে দিয়েছেন তাঁকে। বিশেষ করে ২০১৬ সফরটা ছিল তাঁর জন্য ভীষণ আবেগী। সেই সফরের মাত্র এক মাস আগে হারান অভিভাবকতুল্য দাদাকে।

সেই সফরেই পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। কান্নায় ভেঙ্গে পড়া আবেগি বেয়ারস্টোর ছবি আজও নস্টালজিক করে তোলে ক্রিকেটপ্রেমীদের। বেন স্টোকসকে নিয়ে গড়েন ৩৯৯ রানের জুটি, যা কিনা ষষ্ঠ উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি।  

বেয়ারস্টোর ক্যারিয়ার ঘুরে যায় ২০১৫ বিশ্বকাপের পর। চিরায়ত রক্ষণাত্নক ক্রিকেট থেকে খোলনালচ বদলে ইংল্যান্ড শুরু করে নতুন যুগের আক্রমণাত্নক ক্রিকেট। আর নতুন ব্র্যান্ডের এই ক্রিকেটে ইনিংস শুরুর দায়িত্বটা দেয়া হয় বেয়ারস্টোকে। আক্রমণাত্নক ব্যাটিং করে প্রতিপক্ষের বোলিং এলোমেলো করে দেয়ার দায়িত্বটা উপভোগ করতে শুরু করেন বেয়ারস্টো। ক্রমেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে। 

২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ ছিল ইংল্যান্ডের জন্য নিজেদের প্রমাণের। থ্রি লায়ন্সদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ এনে দিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন বেয়ারস্টো। লর্ডসের ফাইনালটা স্টোকসময় হলেও পুরো বিশ্বকাপেই পারফর্ম করে গিয়েছেন এই ওপেনার। ১১ ম্যাচে দুই শতক আর দুই অর্ধশতকে সংগ্রহ করেন ৫৩২ রান।

তবে বেয়ারেস্টোর মাহাত্ন্য কেবল রান করাতেই নয়, শুরুতে নেমে দলের ইনিংসের গতিপথ ঠিক করে দিতেন জেসন রয়কে সাথে নিয়ে। সম্প্রতি গলফ খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়ে টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল থেকে ছিটকে পড়েছেন জনি বেয়ারস্টো। কিন্তু ক্রিকেটপ্রেমীরা চিন্তিত হন না, তারা জানেন বেয়ারস্টোরা ফিরে আসেন। বারবার ফিরে আসার লড়াইটা যে তাঁর জন্মগত, কোনো বাঁধাই তাই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না তাদের সামনে।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link