এক ডিসেম্বর, ১৯৮০। এলাহাবাদে জন্ম হয়েছিল ভারতের ‘আপনা জন্টি’র। এলাহাবাদে তাঁর বেড়ে ওঠা ছিল সম্পূর্ণ ক্রিকেটীয় ঘরানাতে। তার বাবা মোহাম্মদ তারিফ আনসারি রেলওয়েজ এবং উত্তরপ্রদেশ আর ইউপি’র হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন।
তাঁর ভাই মোহাম্মদ সাইফও ক্রিকেট খেলেছেন মধ্যপ্রদেশ আর উত্তরপ্রদেশের হয়ে। তাই তার ১৮ বছরেই উত্তরপ্রদেশের হয়ে খেলাটা ছিল ভবিতব্য। ১৯৯৮-৯৯ থেকে ২০১৩-১৪, দীর্ঘ ১৬ বছর উত্তরপ্রদেশের হয়ে খেলে ২০১৪-১৫ আর ২০১৫-১৬, দু’বছর তিনি খেলেন অন্ধ্রপ্রদেশের হয়ে আর তারপরের দু’বছর ২০১৬-১৭ আর ২০১৭-১৮ ছত্রিশগড়ের হয়ে খেলে তিনি ৩৮ বছর বয়সে অবসর নেন, সব ধরণের ক্রিকেট থেকে।
২০ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেকের আগে তিনি তাঁর নেতৃত্বে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট জিতিয়েছিলেন ভারতকে। শ্রীলঙ্কার মাটিতে ২০০০ সালের ২৮ জানুয়ারি শিরোপা তুলেছিল ভারতের যুব ক্রিকেট দল। তিনি অধিনায়কত্ব করেছেন রঞ্জি ট্রফিতে ইউপি’র আর দুলীপ ট্রফিতে মধ্যাঞ্চলের।
২০০৫-০৬ মৌসুমে নিয়মিত অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়ের অনুপস্থিতি তাকে সুযোগ করে দিয়ে ছিল চ্যালেঞ্জার ট্রফিতে জাতীয় দলের অধিনায়ক হবার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার স্থায়িত্ব (মোটামুটি ৬ বছর) আর পরিসংখ্যান ছিল তাঁর ক্ষমতার তুলনায় অনেকটাই কম।
২০০০ থেকে ২০০৬ – এই সময়ে তিনি মাত্র ১৩ টি টেস্ট খেলে একটি সেঞ্চুরি আর তিনটি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৬২৪ রান আর ১৪ টি ক্যাচ আর ২০০২ থেকে চার বছরে মাত্র ১২৫ টি ওয়ানডে খেলে দু’টি সেঞ্চুরি আর ১৭ টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ২৭৫৩ রান আর ৫৫ টি ক্যাচ – এই পরিসংখ্যান দিয়ে তাঁর মূল্যায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে শুধু দু’একটি তথ্যেই।
এই পরিসংখ্যান জানায় না ২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩২৬ রানের টার্গেট তাড়া করে জেতার পিছনে তার ৭৫ বলে অপরাজিত ৮৭ আর ৫/১৪৬ (সৌরভ-সেহবাগ-দীনেশ-রাহুল-শচীনকে হারিয়ে) থেকে যুবরাজের সঙ্গে ষষ্ঠ উইকেটে ১২১ রান আর হরভজনের সঙ্গে সপ্তম উইকেটে ৪৭ রান যোগ করা।
এই পরিসংখ্যান বলে না ২০০৪ সালে বাংলাদেশে তিন ম্যাচের সিরিজে সিরিজ সেরা ছিলেন তিনি (১২৯ রান ও একটি ক্যাচ), আরো অনেক বরণীয় ক্রিকেটার থাকা সত্ত্বেও। এই পরিসংখ্যান জানতে দেয়না ২০০০ সালে বাদ পড়ে ২০০৪ সালে আবার তার টেস্ট দলে ফেরা আর অস্ট্রেলিয়ার শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে দু’টি হাফ সেঞ্চুরি করা।
এই পরিসংখ্যান কখনই বলে না বিশ্বকাপে এক ম্যাচে এখনো সবচেয়ে বেশি চারটি ক্যাচ তিনিই নিয়েছেন, ২০০৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। এই পরিসংখ্যান আপনাকে বলবে না যে টেস্টে বাদ গিয়ে বহুদিন পরে যুবরাজের চোটের জন্য তিনি দলে ফিরেছিলেন ২০০৬ সালের মার্চে নাগপুরে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর ৯১ রান করে টেস্টটি বাঁচিয়েও পরের ম্যাচে বাদ পড়েছিলেন, যুবরাজ ফিট হয়ে যাওয়ার কারণে।
এই পরিসংখ্যান এটা ঢেকে রাখে যে, পরের ওয়েস্ট ইন্ডিজে চার টেস্টের অ্যাওয়ে সিরিজে আবার দলে ফেরা শচীনের চোটের কারণে আর দ্বিতীয় টেস্টে সেন্ট লুসিয়াতে অপরাজিত ১৪৮-সহ ৫০.৬৫ গড়ে মোট ২২৬ রান করা, যা ওই সিরিজ ১-০ জেতার পথে অনেকটাই সাহায্য করেছিল।
এই পরিসংখ্যান সযত্নে লুকিয়ে রাখে এই তথ্য যে তিন থেকে সাত, যে কোন পজিশনে তাঁকে মিডল অর্ডারে ব্যবহার করেছে ভারত আর যখন খুশি তাকে দলের বাইরে রেখেছে, যেভাবে ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তাঁকে দলে ডেকেও টেস্টে কামব্যাকের সুযোগ আর দেওয়া হয়নি।
তাঁর খুব দ্রুত উইকেটের মধ্যে দৌড়নো আর স্ট্রাইক রোটেট করা, খুব বেশি আকাশে না খেলেও রান তাড়া করায় প্রচুর সাহায্য করেছে ভারতকে, যা মনে করিয়ে দিত ঐ সময়ের একই পদবাচ্য অস্ট্রেলিয়ান বিস্ময় মাইকেল বেভানকে।
ফিল্ডার হিসেবে তিনি আজও ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরাদের মধ্যেই বিবেচিত হন। পছন্দের জায়গা কভারে তার ফিল্ডিং আজও ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা দর্শনসুখ। ফিল্ডিংয়ের সময়ে মাটির চেয়ে শূন্যে থাকাটাই বেশি পছন্দ ছিল তাঁর।
তাঁর থ্রো ছিল অব্যর্থ আর খুব দ্রুত। বল তাড়া করে রান বাঁচানো আর ক্যাচ ধরা ছিল তার সহজাত কাজ, খুব আনন্দের সঙ্গেই এটা করতেন তিনি। সেই সময় সহখেলোয়াড়দের জন্য ফিল্ডিংয়ের একটা ‘অনেক উঁচু বেঞ্চমার্ক’ রেখে দিতেন তিনি।
অবসরোত্তর জীবনে সাংবাদিক স্ত্রী পূজা, ছেলে কবির আর মেয়ে ইভাকে নিয়ে তাঁর ফিল্ডিংয়ের মতই চমৎকার আছেন তিনি। তিনি না থাকলে হয়তো লর্ডসে সৌরভ গাঙ্গুলির জার্সি খুলে উদযাপনের ‘অমর ফ্রেম’-এর দেখা মিলতো না। ম্যাচটার জন্য ক্রিকেট বিশ্ব চাইলেও ভুলতে পারবে না কাইফকে।