বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য সবচেয়ে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল শ্রীলঙ্কান মডেলে স্কুল ক্রিকেট।
আজ স্কুল ক্রিকেটের সেই দিন আর নেই। অথচ এই দেশে আশির দশকে মাথা তুলে দাড়িয়েছিলো দারুণ সাড়া জাগানো এক স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। ঢাকা মহানগরী থেকে শুরু করে মফস্বল শহরগুলোতে ব্যাট-বল হাতে স্কুল শেষে ছাত্রদের ছোটাছুটি চোখে পড়তো। স্কুল ক্রিকেটের খবর তখন জায়গা করে নিতো পত্রিকার পাতায়।
মানুষের মৌসুম শেষে বড় জিজ্ঞাসা ছিলো – কে জিতলো নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট?
হ্যা, নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট নামে এই টুর্নামেন্ট বাংলাদেশে তৈরী করেছিলো এক ক্রিকেটের জোয়ার। আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাহমুদ সুজন, জাভেদ ওমর বেলিম গোল্লা থেকে শুরু হাবিবুল বাশাররা উঠে এসেছেন এই নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট থেকে।
পরিতাপের বিষয়, নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট অনেক আগেই হারিয়ে গেছে; স্কুল ক্রিকেটই এখন দেশে চলে নামকাওয়াস্তে। এবার পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলেন সেই নির্মাণ স্কুল ক্রিকেটের জনক কামাল জিয়াউল ইসলাম; ক্রিকেটের জগতে যিনি কে জেড ইসলাম।
কে জেড ইসলামের খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ততা সেই ষাটের দশকের শেষ ভাগ থেকে। ১৯৬৯ সালে তিনি তখনকার সাড়া জাগানো ফুটবল ও ক্রীড়া দল করতো ইপিআইডিসি। আর এই ইপিআইডিসির ফিন্যান্স কন্ট্রোলার ছিলেন কে জেড ইসলাম। এরপর ১৯৭৮ সালে আজাদ বয়েজ ক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। ক্রিকেটে এই তাঁর আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু।
আজাদ বয়েজের দায়িত্ব পালন করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ছিলো। ১৯৭৭ সালে এমসিসির একটি দল বাংলাদেশ সফর করে। তাঁদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশকে আইসিসির সদস্য করা হয়। আর এমসিসির দলটির বিপক্ষে বাংলাদেশের যে দলটি খেলেছিলো, তার সিংহভাগ খেলোয়াড়ই এসেছিলেন এই আজাদ বয়েজ থেকে। এই শীর্ষ তারকাদের সামলে ১৯৮১ সালে কে জেড ইসলাম ক্রিকেট বোর্ডে আসেন।
১৯৮১ সালে কে জেড ইসলাম ক্রিকেট বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। তখন বোর্ড সভাপতি ছিলেন কমোডর (অব:) মুজিবুর রহমান। এরপর ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের চতুর্থ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন কে জেড ইসলাম।
তার সময়ের প্রথম সবচেয়ে বড় কাজ ছিল বাংলাদেশ দলকে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে মাঠে নামানো। তার সময়েই এশিয়া কাপ খেলতে শ্রীলঙ্কায় যায় বাংলাদেশ দল। আর সেখানেই বাংলাদেশ প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলে।
তবে কে জেড ইসলামের সেরা কাজ নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট।
কে জেড ইসলাম তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, প্রশাসক হিসেবে তরুণ বয়সেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে গেলে দরকার জনপ্রিয়তা তৈরি করা। আর তৃনমূলে এই জনপ্রিয়তা পাওয়া সম্ভব কেবল স্কুল ক্রিকেট দিয়ে। ফলে স্কুল ক্রিকেট শুরু করার উদ্যোগ নিলেন তিনি। কিন্তু সমস্যা হলো, সে সময়ে বোর্ডের না ছিলো টাকা, না ছিলো স্পন্সর। ফলে স্কুল ক্রিকেটের মত একটা মহাযজ্ঞ চালু করাটা অসম্ভব ব্যাপার ছিলো।
চ্যালেঞ্জটা ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিলেন কে জেড ইসলাম। তার নিজেরই প্রতিষ্ঠান ‘নির্মাণ’-কে করলেন এই স্কুল ক্রিকেটের স্পন্সর। সোজা কথায় নিজের টাকা দিয়ে দেশব্যাপী স্কুল ক্রিকেট শুরু করলেন কে জেড ইসলাম। এর সুফল পেয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। যেমন খেলাটি পৌছে গেছে বাংলাদেশের জেলা স্তরগুলো পর্যন্ত, তেমনই এই টুর্নামেন্ট থেকে উঠে এসেছেন অনেক ক্রিকেটার।
বিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছিলেন এই মানুষটি। পরে আবার ইংল্যান্ড থেকে বিকম ও সিএ সম্পন্ন করেন। বিভিন্ন দেশে চাকরি করেছেন এই দক্ষ প্রশাসক। কে জেড ইসলাম নিজে পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন বড় সময়। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনা ও গবেষণার একটা পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছেন। বাবা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের বিচারপতি। মা রাহাত আরা বেগম একজন সনামধন্য লেখিকা ছিলেন। কে জেড ইসলাম নিজেও লেখালিখি করেছেন। এক সময় ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডেতে ধারাবাহিক লিখতেন। তাঁর দুটি প্রকাশিত বই আছে। বোঝাই যাচ্ছে, নানা ভূমিকায় ও নানা গুনে গুণান্বিত ছিলেন তিনি।