স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

১৭/৫। নাহ, এটা ক্লিশে হয়ে গেছে। অন্য কিছু দিয়ে শুরু করি। তাহলে ৩১/৫? না, না, এটা দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সেই বিখ্যাত ডোনাল্ড নিধন নয়। যদিও ওটা দিয়েও শুরু করা যায়। আসলে আজকে কপিলদেবের অন্য ধরনের কিছু কীর্তি নিয়ে আলোচনা করব ঠিক করেছি।

যে ম্যাচের কথা বলছি সেটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। ভারতের এই অবস্থার জন্যে দায়ী বোলারটির নাম প্যাট্রিক প্যাটারসন। নাম না শুনে থাকতে পারেন কিন্তু ইউ টিউবে একটি ভিডিও পাবেন যেখানে দুজোঁ জানাচ্ছেন মার্শাল, হোল্ডিং বা রবার্টস নন, ওনার কিপ করা দ্রুততম ফাস্ট বোলারের নাম প্যাটারসন।

১৯৮৮ সালে সেই প্যাটারসন ভারতকে ৩১/৫-এ নাবিয়ে এনেছিল। কিন্তু তারপর? না, ভারত জয়লাভ করে নি, শেষ অব্দি ১০ রানে হেরেছিল। শুধু হারার আগে একজন ৬৪ বলে ৮৭ রানের ইনিংস খেলে কিছুক্ষনের জন্যে আমাদের জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। একদিনের ম্যাচে কপিলের এটা দ্বিতীয় হাইয়েস্ট স্কোর। থার্ড হাইয়েস্ট স্কোরের পরও ভারত হেরেছিল। ৫১ বলে ৭৫। তিনটে ছক্কা। ঐ ম্যাচে আর কেউ ছক্কা মারে নি।

আরও একটা বিস্মৃত প্রায় ম্যাচের কথা বলি। সেদিন প্রথমে ব্যাট করে ভারত অল আউট হয় মাত্র ১১৩ রান করে। মূল ঘাতক রিচার্ড হ্যাডলি। আবার ভারত হারল। ৩ উইকেটে। কিন্তু হারার আগে কিছুক্ষনের জন্যে আবার মনে হোল যেন স্বপ্ন দেখছি। একজন ভারতীয় ফাস্ট বোলার একদিনের ম্যাচে পাঁচখানা স্লিপ নিয়ে বল করছে। তিনটে উইকেটও নিল। সঙ্গে দুটো ক্যাচ ড্রপ। একটা নিশ্চিত এল বি’র আবেদন নাকচ। একটা ডাইভ দিয়ে অসাধারণ ক্যাচ। ইস, যদি আরও খান তিনেক ওভার বাকি থাকত কপিলের!

এগুলো কয়েকটি হারা একদিনের ম্যাচের খতিয়ান। এমন টেস্টেও আছে। ৯/৮৩। এখনও কোন ক্যাপ্টেনের বেস্ট বোলিং এনালিসিস। সম্ভবত কোন হেরে যাওয়া দলের হয়েও সেরা এনালিসিস। ঐ নয়জনের মধ্যে কারা ছিলেন? গ্রিনিজ, ভিভ, লয়েড, গোমস, ডুজন, লোগি।

অথবা ১৯৮২ সালের লর্ডস। দুই ইনিংস মিলে ১৩ উইকেটের মধ্যে ৮ উইকেট, দুই ইনিংসে স্কোর ৪১ (দলের স্কোর ১২৬) ও ৮৯ (৫৫ বলে)। তবুও ভারত হারল। জানি না এটাও হারা ম্যাচের শ্রেষ্ঠ অলারাউন্ড প্রদর্শনী কিনা। অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ১২৯। ডান হাতে চোট, ডোনাল্ডের আগুন, অপরপ্রান্তে প্রায় কোন সাপোর্টই নেই। আবার পরাজয় কিন্তু তার আগে মনে রাখার মতো লড়াই। সেই সঙ্গে আশা এবং স্বপ্ন।

কিন্তু আমি শুধু হারা ম্যাচগুলোর কথাই বলছি কেন? বলছি এটা বোঝাতে যে তখন আমরা হারতেই অভ্যস্ত ছিলাম। আমাদের সুপারম্যানের এই পারফর্মেন্সগুলোও যথেষ্ট ছিল না অন্যান্য শক্তিশালী দলের সঙ্গে ভারতের পার্থক্য দূর করার পক্ষে। তবুও আমরা স্বপ্ন দেখেছি। কয়েকটি অবিশ্বাস্য সাফল্যও পেয়েছি। ১৯৮১ মেলবোর্ন (৫/২৮)। ১৯৭৯ চেন্নাই (১১ উইকেট, ৮৪ রান)। ১৯৮৬ লর্ডস (৪/৫২, ২৬)। ১৯৮৮ আবার চেন্নাই (১০৯)। এবার একদিনের ম্যাচের কথা বলি। ১৯৮৩ বারবিস (৩৮ বলে ৭২)। ১৯৮৫ বেন্সন এন্ড হেজেসের সেমিফাইন্যাল (৩৮ বলে ৫৪)ও ফাইন্যাল (৩/২৩)। ১৯৮৫ রথম্যান্স কাপ (৩০ ও ৩/১৭)। হরিয়ানার ১৯৯১ সালে রঞ্জি (মুম্বাইকে হারিয়ে) এবং ইরানি ট্রফি (অবশিষ্ট ভারতকে হারিয়ে) জয়। এবং আজ অবধি বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় রূপকথার নায়ক – ১৯৮৩ বিশ্বকাপ।

যারা সেই সময়ের কপিলকে কাছ থেকে উপলব্ধি করেছেন তারা জানেন তিনি কী ছিলেন। যারা আজ জাদেজা, হার্দিক বা আশ্বিনকে কপিলের সঙ্গে তুলনা করেন তাদের বোলব কপিলের কয়েকটি ইনিংস বা বোলিং স্পেল খুঁটিয়ে দেখুন। মার্শাল, হোল্ডিং, রবার্টস, ডেভিস, গারনারদের বিরুদ্ধে তার ১০০, ৯৮ ও ৭২ (এটি ৩৮ বলে) রানের ইনিংস ছিল তার।

ছিল বোথাম, উইলিসদের বিরুদ্ধে ১১৬, ৯৭ ও ৮৯ রানের ইনিংস (এগুলোর সম্মিলিত স্ট্রাইক রেট ১২৩, টেস্ট ম্যাচে)। গ্রিনিজ, হেইন্স, ভিভ, লয়েডদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার ইনিংসে ৫ বা তার বেশি উইকেট। জহির, মিয়াঁদাদ, মুদাসসার, আসিফ ইকবাল, ইমরানদের বিরুদ্ধেও। বা বয়কট, গাওয়ার, গুচ, ল্যাম্ব, বথামদের বিরুদ্ধে। মোটকথা ব্যাট বা বল হাতে কপিল পারতেন না এমন কাজ ক্রিকেট মাঠে ছিল না। ভিভের সঙ্গে তিনিই সেই যুগের একমাত্র ক্রিকেটার ছিলেন যিনি কোনরকম এডজাস্টমেন্ট ছাড়াই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অনায়াসে সাফল্য লাভ করতেন।

সেই সঙ্গে অত্যাশ্চর্য ফিল্ডিং। নিজের বোলিঙে ফলো থ্রুতে লম্বা পায়ে ছুটে গিয়ে বল তুলেই নির্ভুল লক্ষ্যে নন স্ট্রাইকার এন্ডের উইকেট ভেঙ্গে ফেলা। নিশ্চিত বাউন্ডারি বাঁচিয়ে কিরমানির পেতে রাখা গ্লাভসে বুলেটের গতিতে বল ফেরত পাঠানো। ব্যাটসম্যানের মিস্টাইমড শটকে ছুটে এসে (কখনও বা পেছনের দিকে ছুটে) ক্যাচ করায়ত্ব করা। ক্যারিয়রের পরের দিকে নির্ভরযোগ্য স্লিপ ফিল্ডারও হয়ে উঠেছিলেন কপিল। অর্থাৎ এখানেও তিনি প্রকৃত অলরাউন্ডার ছিলেন।

এরপরও ছিল রানিং বিটুইন দ্য উইকেট। টেস্টে এবং একদিনের ম্যাচে – দুটোতেই এই ক্ষেত্রেও দুটো আশ্চর্য বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী কপিল। তিনি নাকি জীবনে একটাও নো বা ওয়াইড করেন নি (করেছেন। এটি নিছক গুজব। কিন্তু তা এতটাই রেয়ার ছিল যে এই গুজব বিশ্বাসযোগ্য মনে হত, হয়)।

অনেকের মনে হবে এসব আবেগের কথা। মাঝে মধ্যে হয়ত কপিলদেব কিছু স্মরণীয় কীর্তি করে বসতেন কিন্তু বেশিরভাগ সময় তিনি ততটাও অসাধারণ কিছু ছিলেন না। নইলে কপিলের রেকর্ড কেন আজ সাধারন মনে হয়?

এর কারণ আমরা ডার্বি ঘোড়াকে এক্কা গাড়িতে জুড়ে তাকে যাত্রী নিয়ে যাতায়াতের কাজে লাগিয়েছিলাম। শুধু উইকেট নিলেই হবে না, রানও আটকাতে হবে। সেই এক্কা গাড়িকে ছোটার মতো প্রয়োজনীয় মসৃণ রাস্তাও দিতাম না। কারণ, আমাদের মাত্র একটা কপিল ওদের তিনটে বা চারটে ফাস্ট বোলার। সুতরাং ন্যাড়া পিচ বানাও, বল যেন কিছুতেই হাঁটুর ওপর না ওঠে। এবং মাঝে মাঝে সেই ডার্বি ঘোড়াকে বলা হত ম্যারাথন ছুটে দেখাও। মাথা নিচু করে ব্যাট – প্যাড একসঙ্গে রেখে ম্যাচ ড্র করার চেষ্টা কর। না পারলে শাস্তি বরাদ্দ। কিন্তু সেই ঘোড়ার আঘাত লাগলে চিকিৎসার বা বিশ্রামের ব্যবস্থা নেই।

কথায় আছে মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের কদর করে না। আমরাও কপিলের কদর সেদিন করি নি। কিন্তু আজকে যখন দেখি পাঁচ ওভারের একটা স্পেলের পর আমাদের ফাস্ট বোলারের রেস্টের প্রয়োজন পড়ছে, দলের টপ ফাস্ট বোলাররা ছোটখাটো সিরিজ স্কিপ করে যথেষ্ট বিশ্রাম নিয়ে নিজেকে ফিট রাখার চেষ্টা করছে গুরুত্বপূর্ণ সিরিজের জন্যে, ফিল্ডিঙের সময় তাদের এমন জায়গায় প্লেস করা হচ্ছে যাতে বেশি এনার্জি নষ্ট না হয় – তখন আমরা কিছুটা অনুভব করি কপিলদেব কী ছিলেন।

ভিভ রিচার্ডস বা এডাম গিল্ক্রিস্টকে কেউ কোনদিন বলে নি এবার একটু দায়িত্ব নিয়ে ব্যাট কর। ১৯৮৩র বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই দায়িত্বহীন পুলের পর দল থেকে বাদ পড়েননি ভিভ। বিশ্বকাপ ফাইনালে রিভার্স স্যুইপ খেলে অস্ট্রেলিয়ার হাতে ম্যাচ তুলে দেওয়ার পর গ্যাটিং-এর ক্যাপ্টেনশিপও কেড়ে নেওয়া হয় নি, দল থেকে বাদও পড়েন নি। অথচ কপিলদেবের বাদ পড়েন। অধিনায়কত্বও হারান। এবং এই দুটোর সমর্থনে আজকেও এদেশের কিছু মানুষ যুক্তি সাজিয়ে বসে রয়েছেন।

আমরা যারা কপিলকে কিশোরবেলায় কাছ থেকে দেখেছি তাদের কাছে কপিলদেব একটা অন্যরকম আবেগ। যদিও আমরা জানি। আমরা জানি বোদ্ধারা তাকে তাদের বিশ্ব একাদশে রাখেন না, এ ক্ষেত্রে তাদের কাছে সানি বা সচিনের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। আমরা জানি মিলার বা ইমরানের গড় অনেক ভালো কপিলের চেয়ে – ব্যাটিং, বোলিং দুটোতেই। আমরা এও জানি কয়েকটি দেশের মাটিতে কপিলের পারফর্মেন্স তেমন পাতে দেওয়ার মতো নয়। আজকে অনেকের চোখেই ভারতের সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলার বুমরা হতে চলেছেন, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার শ্বিন।

কিন্তু আমরা খেলাটাকে মস্তিষ্ক নয়, হৃদয় দিয়ে দেখতাম, অনুভব করতাম। বুঝতাম আমাদের অভাবের সংসারে কপিল দেব নামের ম্যাজিশিয়ান রয়েছে বলেই আমরা স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। তার ডানায় ভর দিয়ে আকাশে উড়তে পেরেছি। তাই আমাদের কাছে চিরশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটারের প্রসঙ্গ তুললেই আমরা কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই একটা নাম কোরাসে বলে উঠব – কপিল দেব। শুধু ভারতেরই নয়, বিশ্বেরও। শুধু সেই সময়েরই নয়, সর্বকালের। জানি কোন যুক্তি নেই, কিন্তু তবুও বলব। বলব এবং বিশ্বাস করব।

ব্যাপারটা কেমন জানেন? অনেকটা শিশুর নিজের বাবাকে সুপারম্যান মনে করার মতো। যে বাবা গোটা মাস বাসে – ট্রামে গলদঘর্ম হয়ে মাসের শেষে ট্যাক্সি করে চিড়িয়াখানা ঘুরতে নিয়ে যায়, হোটেলে খাওয়ায়। অথবা কাঁধে করে ভিড় পেরিয়ে দুর্গা ঠাকুর দেখায়। সেই বাবার ক্ষেত্রে সেই শিশুটি কিছুতেই অবজেক্টিভ হতে পারে না। অথবা যত বড় বিশ্বসুন্দরীর ছবিই তাকে দেখানো হোক, তার কাছে তার মা’ই পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর নারী। তার মায়ের গানের গলা লতার চেয়েও মধুর।

কপিল দেব আমাদের এতটাই কাছের মানুষ ছিলেন। একমাত্র তার ক্ষেত্রে আমরাও কিছুতেই অবজেক্টিভ হতে পারি না। পারব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link