ক্রিকেট পাড়ায় ক্যারি প্যাকার বেশ পরিচিত এক নাম। ৩৯ বছর বয়সী এক বিজনেস টাইকুন সত্তরের দশকে ক্রিকেট পাড়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। বলা হয় ক্যারি প্যাকারের হাত ধরেই ক্রিকেটের আমূল পরিবর্তন। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের উপর ক্ষোভ ঝাড়তে এক বিদ্রোহী টুর্নামেন্ট শুরু করেন। অর্থের কমতি ছিল না; ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ধনকুবের। খেলোয়াড়দের মোটা অর্থের লোভ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলেন নিজের গড়া সেই টুর্নামেন্টে।
সাল ১৯৭৬। বছরের একদম শেষদিকে কাজ শুরু করলেন। প্রায় ছয় মাস বিশ্বের নামি-দামি তারকা ক্রিকেটারদের অনেকের সাথেই চুক্তি সাক্ষর করলেন। হুট করেই দিয়েছিলেন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা! ততদিনে অবশ্য খেলোয়াড় গোছানোর কাজটা সেরে ফেলেছেন অনেকটাই।
ঘোষণা করা হল মোট তিন দল খেলবে এই সিরিজে – অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর বিশ্ব একাদশ। যারা প্যাকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল তারাই শুধুমাত্র এই সিরিজে খেলতে পারবে। এতে ক্ষোভে ফুঁসে উঠে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড। তাদের সমর্থন জানিয়ে বাকি বোর্ডগুলো অবশ্য পাশে দাঁড়িয়েছিল। অনেক ক্রিকেট বোর্ড থেকে জানানো হল যারা এই সিরিজে খেলতে যাবে তাদেরকে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হবে।
ক’জনকে নিষেধাজ্ঞা দিবে? অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ ক্রিকেটারই তখন টাকার লোভ সামলাতে না পেরে নাম লেখান ক্যারি প্যাকারের দলে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড সহ আরও কয়েকটি দেশ থেকেও খেলোয়াড়েরা নাম লেখান। দারুণ ছন্দে থাকা ইংলিশ অধিনায়ক টনি গ্রেগকেও তিনি নিয়ে আসেন নিজের টুর্নামেন্টে!
অনেক আলোচনা-সমালোচনা, ক্ষোভের পর পর্দা উঠলো ওয়ার্ল্ড সিরিজের প্রথম আসরের। রঙিন জার্সি, ফ্লাড লাইট, হেলমেট থেকে শুরু করে মাঠে কারের ব্যবহার, সাদা বল – কি না ছিল? সত্তরের দশকেই ক্রিকেটে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন ক্যারি প্যাকার। এর আগে ক্রিকেট সমর্থকরা যা ভাবতে পারেনি, সেসবই করে দেখিয়েছেন প্যাকার।
অর্থাভাব বলতে কোনো শব্দই ছিল না প্যাকারের জীবনে। মৃত্যুর আগে প্যাকারের বাবা ১০০ মিলিয়ন ডলার রেখে যান ছেলের জন্য। সেই টাকা থেকেই পরবর্তীতে চালু করেন বহুল আলোচিত সেই ওয়ার্ল্ড সিরিজ। বাবার কাছ থেকেই চ্যানেল নাইনের মালিকানা পান। প্যাকারের হাত ধরেই প্রথম টিভির পর্দায় খেলা উপভোগ করেন দর্শকরা।
ক্যারির কাছে টাকাটা কখনোই চিন্তা কারণ হয়নি। ওয়ার্ল্ড সিরিজ থেকে প্যাকার আর্থিকভাবে তেমন লাভবান হতে পারেননি। প্রথম মৌসুমে ক্রিকেটে আধুনিকতার ছোঁয়া আনলেও দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় করতে পারেননি। তবে পরবর্তীতে ক্রিকেট সমর্থকদের কাছে এই সিরিজ অনেকটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের তখন বেহাল দশা। ভারত বাদে প্রায় দেশগুলো থেকেই ক্রিকেটাররা অংশ নিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার মূল দলের অধিকাংশ ক্রিকেটারই ছিল ক্যারি প্যাকারের সিরিজে। উপায়ন্ত না দেখে প্যাকারের সাথে শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় বসতে রাজী হয় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড। মূলত অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সমর্থকদের চাপ, ক্রিকেটের বেহাল অবস্থা – সব মিলিয়েই মাথা নোয়াতে বাধ্য হয় ক্রিকেট বোর্ড।
১৯৭৯ সালে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের সাথে সমঝোতায় আসেন প্যাকার। পেয়ে যান টিভি স্বত্ত্ব! সেই সাথে মার্কেটিং ও প্রোমোশনের দায়িত্ব পেয়ে যান প্যাকারে। ওয়ার্ল্ড সিরিজ নামের লস প্রজেক্টই যেন পরবর্তীতে সোনার হরিণ বনে যায় প্যাকারের জন্য।
ক্যারি প্যাকারের সিরিজের ইতি ঘটলো। ক্রিকেটাররাও নিজ নিজ দেশে ফিরে গেলেন। ইংল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশেই ক্রিকেটারদের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হল। অনেকেই আর ক্রিকেটে ফিরতে পারেননি। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদেরও একই দশা হত। কিন্তু সমর্থকদের চাপে বোর্ড পিছপা হতে বাধ্য হয়; ওই যাত্রায় বেঁচে যায় অনেক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাদের ক্যারিয়ার। অবশ্য উপায়ও ছিল না তারকা ক্রিকেটারদের হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট তখন ছিল অনেকটাই ব্যাকফুটে।
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের সাথে প্যাকারের ক্ষোভের কারণ কি সেটাই ভাবছেন?
প্যাকার অনেক আগ থেকেই অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটে সত্ত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন নিজের চ্যানেল নাইনের জন্য। কিন্তু প্যাকারের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড (এসিবি)। বরং টিভি সত্ত্ব দেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (এবিসি) নামক এক প্রতিষ্ঠানকে।
প্যাকারের চ্যানেল নাইনের তুলনায় ওই প্রতিষ্ঠান অনেকটাই পিছিয়ে ছিল; বোর্ডের সাথে ভাল সম্পর্ক থাকায় এবিসি কোম্পানি সহজেই সত্ত্ব পেয়ে যায়। মূলত এতেই চটে যান প্যাকার। ক্ষোভে ঘোষণা দিলেন ওয়ার্ল্ড সিরিজ আয়োজনের। মূল লক্ষ্যই ছিল নিজের ক্ষমতা আর অর্থের মাধ্যমে বোর্ডের কাছ থেকে ক্রিকেটারদের আলাদা করে ভিন্ন এক টুর্নামেন্ট গড়ার।