যে ফুটবল বিশ্ববাসীর সামনে বিনোদনের পসরা বয়ে নিয়ে আনে, যে ফুটবল আনন্দের কারণ হয়ে উঠে; সেই ফুটবলে একজন সত্যিকারের বিনোদনদাতা, আনন্দদাতা হয়ে এসেছেন এক বেলজিয়ান। মাঠে একের পর এক মারণ-ক্রস আর রক্ষন চেরা পাস দিয়ে প্রতিপক্ষের পরীক্ষা নেয়াই তার প্রধান কাজ। নামটা – কেভিন ডি ব্রুইনা। ব্রুইনার পায়ে বলের কারিকুরির চেয়ে বেশি নান্দনিক দৃশ্য ফুটবলে খুব কমই আছে।
কেভিন ডি ব্রুইনার জন্ম ১৯৯১ সালের ২৮ জুন। বেলজিয়ামের ড্রঙ্গনে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। অল্প বয়স থেকেই চামড়ার বলের সাথে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয় ডি ব্রুইনার। মাত্র ৬ বছর বয়সেই স্থানীয় ক্লাব কেভিভি ড্রঙ্গেনে যোগ দেন তিনি। দুইবছর সেখানেই নিজের ফুটবলীয় দক্ষতা আরো ঘষেমেজে শানিত করে নেন। এরপর ১৯৯৯ সালে কে.এ.এ জেন্ট ক্লাবের যুব দলে চলে আসেন এই এটাকিং মিডফিল্ডার।
সেখানে পাঁচবছরে কাটানোর পর কেভিন ডি ব্রুইনার ঠিকানা হয় কে.আর.সি জেঙ্ক। এই দলের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৭ এবং অনূর্ধ্ব ১৯ পর্যায়ে খেলার পরে অবশেষে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় কেভিন ডি ব্রুইনার। ২০০৫ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বেলজিয়ান ক্লাবটিতেই ছিলেন তিনি। এইসময় ১১৭ টি ম্যাচ খেলে ২০টি গোল করেছিলেন ব্রুইনা, এছাড়া সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছিলেন আরো ৩৬টি গোল। তবে গোলসংখ্যা ছাড়িয়ে তাঁর খেলার ধরণ এবং কৌশল নজরে পড়ে ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর।
২০১২ সালে কেভিন ডি ব্রুইনা ইংলিশ ক্লাব চেলসির সঙ্গে চুক্তি করেন। কিন্তু এখানে আসার পরেই অফ ফর্মে পড়ে যান তিনি। নতুন জায়গায় ঠিক মানিয়ে নিতে পারেননি এই বেলজিয়ান। বাধ্য হয়ে তাকে লোনে জার্মান ক্লাব উলফসবার্গে পাঠায় চেলসি ম্যানেজম্যান্ট৷ সেখানে সত্তরের বেশি ম্যাচ খেলে ২০ টি গোল এবং ৩৭ টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন ডি ব্রুইনা।
অথচ চেলসি’র প্লেয়ার হয়েও দুইবছরে তিনি দলটির হয়ে খেলেছেন মাত্র নয় ম্যাচ। শেষপর্যন্ত ৭৯ মিলিয়নের বিনিময়ে আরেক ইংলিশ পরাশক্তি ম্যানচেস্টার সিটি দলে ভেড়ায় এই প্লে-মেকারকে। সেটিই সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হয়ে আসে ডি ব্রুইনার জন্য। নিজেকে নতুন করে খুঁজে পান তিনি। পেপ গার্দিওলার অধীনে রীতিমতো সময়ের সেরা হয়ে উঠেছেন এই বেলজিয়ান।
এখন পর্যন্ত ক্লাবটির হয়ে ৩০৭ টি ম্যাচ খেলেছেন কেভিন ডি ব্রুইনা। ৮৬ বার পেয়েছেন জালের দেখা আর ১২১ বার সতীর্থকে সাহায্য করেছিলেন গোল পেতে। এছাড়া সিটিজেনদের হয়ে ৪টি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা, পাঁচটি লিগ কাপ এবং একটি এফএ কাপ জিতেছেন তিনি। এসব ছাড়াও বেলজিয়ান কাপ এবং জার্মান কাপও আছে তাঁর অর্জনের ঝুলিতে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কেভিন ডি ব্রুইনা’র অভিষেক হয় ২০১০ সালে। এখন পর্যন্ত জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ৯১টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। এইসময় গোল করেছেন ২৪টি। বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্মের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তিনি। দলটির মিডফিল্ড সামলানোর দায়িত্ব তার কাঁধেই থাকে।
তবে পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে মাঝমাঠে খেলা একজন ফুটবলারকে পরিসংখ্যান দিয়ে আসলে কতটুকুই বিচার করা যায়। তাকে বিচার করতে হলে খেলা দেখতে হয়, দেখতে হয় কিভাবে প্রতিপক্ষের পা থেকে নিপুনভাবে বল কেড়ে নিচ্ছেন তিনি। এরপর আরো চমৎকার উপায়ে একটি পাসেই তচনচ করে দিচ্ছেন বিপক্ষ দলের রক্ষন লাইন।
বর্তমান বিশ্বে একেবারে ‘কমপ্লিট’ ফুটবলার বলতে যা বোঝায় ডি ব্রুইনা ঠিক তাই। কমপ্লিট মিডফিল্ডারদের অন্যতম আদর্শ ব্রুইনা নিজেই – এমনটা বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। প্রায়ই নিজের স্বভাবজাত আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার পজিশনে খেললেও মাঠের সর্বত্রই পারফর্ম করতে পারেন তিনি। প্লেমেকার, ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডার, বক্স টু বক্স, উইঙ্গার এবং কিংবা ফলস নাইন যে দায়িত্বেই মাঠে নামানো হোক, ডি ব্রুইনা সেটা পালন করেন, জানান দেন নিজের সামর্থ্যের।
ব্যক্তিগত অর্জন হিসেবে প্রিমিয়ার লিগের ‘বেস্ট প্লে-মেকার অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘প্লেয়ার অব দ্য সিজন’ জেতা হয়েছে বেশ কয়েকবার। এছাড়া ম্যানচেস্টার সিটির মৌসুম সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার আছে তার ক্যাবিনেটে। একক কোনো মৌসুমে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট করার রেকর্ডের মালিকও সিটি মিডফিল্ডার।
তবে এতকিছুর পরেও আক্ষেপ থেকেই গিয়েছে এই সুপারস্টারের। বেলজিয়ামের ইতিহাসের সেরা দল হয়েও বিশ্বকাপ কিংবা ইউরোর মত মেজর ট্রফি জিততে পারেননি তিনি। পারেননি ম্যানচেস্টার সিটি’র হয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ ছুঁয়ে দেখতে। এমন না জেতার বেদনা সঙ্গী করেই বুটজোড়া তুলে রাখতে হবে ‘মিডফিল্ড মায়েস্ত্রো’-কে নাকি শেষ সময়ে এসে নিজের অতৃপ্তিকে তৃপ্ততা দান করবেন ডি ব্রুইনা? উত্তরগুলো আপাতত ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা যাক।