তখন ২০০৩ সাল। নাফিস ইকবালের আন্তর্জাতিক সফর তখনও শুরু হয়নি। বাংলাদেশ সফরে এসেছে ইংল্যান্ড দল। প্রস্তুতি ম্যাচে বিকেএসপিতে সেঞ্চুরি করেন ইংলিশদের বিপক্ষে।
১৮ বছর বয়সী ডানহাতি ওপেনার ১৪ টা চার ও একটা ছক্কায় ১৬৮ বলে ১১৮ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেন। এই ইনিংস খেলার পথে বেদম প্রহার করেছিলেন, তিনি ইংলিশ স্পিনার অ্যাশলি জাইলসকে।
ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ডের সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন, কী করে এমন ইনিংস খেললো এই বালক? কীভাবে সে জাইলকে পড়ে ফেললো? ছেলেটি স্মিত হেসে বললো, ‘জাইলস তো অর্ডিনারি স্পিনার।’ আদতে জাইলস মোটেও অর্ডিনারি স্পিনার ছিলেন না!
ক্যারিয়ারের শুরুটা একজন পেসার হিসেবে। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল পেসার হবেন। তবে ছোটবেলার সব ইচ্ছে তো আর পূরণ হয় না। তেমনি অ্যাশলে জাইলসও পারেননি পেসার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। ব্যাক ইনজুরির কারণে পেসার থেকে বনে গেছেন একজন স্পিনার। আহামরি টার্ন কিংবা বিরল কোনো প্রতিভা ছিল না। ব্যাট হাতেও যে খুব বেশি কিছু দলকে দিতে পেরেছেন এমনও নয়। তবুও তিনি ইংল্যান্ডের এক উজ্জ্বল তারকা।
২০০৫ অ্যাশেজ সিরিজে জয়ের অন্যতম নায়ক এই অ্যাশলে জাইলস। ইনজুরির কারণে পেসার থেকে স্পিনে শিফট হলেও তিনি দমে যাননি। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থেকে পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাস থেকেই সেরাটা দিয়ে উঠে আসেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ইংল্যান্ডের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন প্রায় ৬ বছর। নিজেকে সময়ের অন্যতম সেরা ইংলিশ স্পিনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন জাইলস। বনে যান ইংল্যান্ডের ‘কিং অব স্পেন’!
১৯৭৩ সালের ১৯ মার্চ সারেতে জন্ম নেন জাইলস। ছোটবেলা থেকে ক্রিকেটে ঝোঁক ছিল। আর সেই ঝোঁক ছিল পেস বোলিং নিয়ে। অনূর্ধ্ব ১৪ তেও গিল্ডফোর্ড ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলেছেন পেসার হিসেবে। এরপরই ইনজুরিতে থমকে যায় জাইলসের ক্যারিয়ার।
কিছুটা সময় নিয়ে পুনরায় শুরু করেন নতুন উদ্যমে, নতুন রূপে! পেসার থেকে টার্ন করলেন স্পিনার হিসেবে। তখন সারের হয়ে খেলার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তবে স্পিনার হয়ে যাওয়া জাইলসের উপর থেকে ইচ্ছে হারায় সারে। তবে দমে জাননি তিনি। ১৯ বছর বয়সে আসেন এজবাস্টনে। নতুন ভূমিকায় আবারও শুরু করেন ক্রিকেট।
স্পিন অলরাউন্ডার হিসেবে খেলা শুরু করেন কাউন্টি দল ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে। ১৯৯৩ সালে ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় জাইলসের। পরবর্তীতে ১৯৯৬ থেকে বনে যান দলের নিয়মিত মুখ এবং দলের ভবিষ্যত সম্ভাবনাময়ী তারকা হিসেবেও আখ্যা পান তিনি।
১৯৯৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক হয় জাইলসের। পরের দু’বছর অবশ্য সাদা পোশাকে আর সুযোগ পাননি তিনি। এরপর ২০০১ সালের পাকিস্তান সফরে ফিরে নিজেকে প্রমাণ করেন জাইলস। তিন টেস্টে শিকার করেন ১৭ উইকেট! এরপর থেকে ইংল্যান্ডের হয়ে নিয়মিত মুখ তিনি। অবশ্য ১৯৯৭ সালে ওয়ানডে অভিষেক হলেও প্রথম ৫ বছর সুযোগ পান মোটে ৯ ম্যাচে!
২০০১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফর্ম করে ইংল্যান্ডের সেরা স্লোয়ার বোলার হিসেবে পরিচিতি পান জাইলস। ২০০২ সালে ভারতের বিপক্ষে অরুন জ্যাটলি স্টেডিয়ামে ৫৭ রানে ক্যারিয়ার সেরা ৫ উইকেট শিকার করেন জাইলস। সেটিই ছিল ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তাঁর একমাত্র ফাইফর!জাইলসের ব্রিলিয়ান্ট স্পেলে ২ রানের শ্বাসরুদ্ধকর জয় পায় ইংলিশরা।
২০০৪ সালে লর্ডসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১২২ রানে ৯ উইকেট শিকার করেন তিনি। ব্রায়ান লারার উইকেট শিকারের মধ্যে দিয়ে টেস্টে ১০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন জাইলস। ওই ম্যাচে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন এই অফ স্পিনার।
২০০৫ সালে উইজডেন বর্ষসেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন ছিলেন জাইলস। সেবার অ্যাশেজ জয়ে দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন জাইলস। অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডারের গুরুত্বপূর্ণ উইকেটগুলোই শিকার করেন তিনি। ট্রেন্ট ব্রিজে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে জাইলসের ব্যাটেই আসে উইনিং রান। শেষ টেস্টে জাইলসের ক্যারিয়ার সেরা ৫৯ রানের ইনিংসে কেভিন পিটারসেনের সাথে সেঞ্চুরির জুটির পথে ওভাল টেস্ট ড্র করে ইংলিশরা। সেবার ২-১ এ অ্যাশেজ জয়ে করে ইংল্যান্ড।
কেন তিনি কিং অব স্পেন? এর পেছনে আছে মজার এক গল্প। ২০০০ সালে এক জোড়া মগ অর্ডার করেছিলেন। সেখানে লিখতে বলা হয়েছিল ‘কিং অব স্পিন’। ভুল করে প্রিন্ট করা হয় কিং অব স্পেন। মানে একটা ‘a’ বাড়তি ছাপা হয়। এর একটা দিয়ে আবার জাইলস ড্রেসিংরুমে বসেই কফি খেতেন।
তখন থেকেই জাইলসের এরকম নাম করা হয়। যদিও, জাইলসের ব্যবহৃত মগটা চুরি যায়। আরেকটা মগ ক্লাবশপে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়। ওয়ারউইকশায়ার ক্লাব পরে ওই রকম দু’শো মগ বানায় সমর্থকদের জন্য, যার এক পাশে আবার ছিল স্পেনের রাজা হুয়ান কার্লোসের ছবি। ২০০৫ সালের সেই অ্যাশেজেও বার্মি আর্মির দল ‘ইয়া ভিভা এস্পানা’ স্লোগান তোলে জাইলসের সম্মানে।
এরপর ২০০৬ সালে সেই পুরনো পিঠের ইনজুরির কারণে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ও টেস্ট থেকে ছিটকে যান জাইলস। ইয়ান ব্ল্যাকওয়েল, লিয়াম প্ল্যাংকেটরা তখন দলে আসার চেষ্টায় মত্ত। জাইলসের জায়গায় আরো এক সম্ভাবনাময়ী স্পিনার ছিলেন মন্টি পানেসার। জাইলসের ইনজুরিতে সুযোগও পেয়ে গেলেন! ওই বছর এপ্রিলে এক সাক্ষাৎকারে জাইলস জানান তার ক্যারিয়ার সম্ভবত হুমকির মুখে! তবে ওই বছরের শেষে আবারও দলে ফেরেন তিনি।
২০০৬ অ্যাশেজের মাঝপথেই স্ত্রীর পাশে থাকতে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে পাড়ি জমান জাইলস। ব্রেইন টিউমারে জাইলসের স্ত্রী তখন বেশ অসুস্থ। এর বছর খানেকের মাঝেই ২০০৭ সালের আগস্টে সব ধরণের ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন জাইলস!