ক্রিকেটের রাজপুত্র একজনই। ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিশাল রানের এবং মহাকাব্যিক ইনিংস সম্ভবত তিনি ছাড়া আর কেউ খেলতে পারেননি। ২৭৭, ৩৭৫, ৫০১*, ৪০০* এরকম সব অবিশ্বাস্য ইনিংস তিনি টেস্ট ও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অনায়াসে খেলেছেন। একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ম্যাচের এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের বিশ্বরেকর্ড দুবার করেছেন। কিন্তু তাঁর সর্বোত্তম ইনিংসটি সম্ভবত ১৯৯৯ সালের ৩০ মার্চ।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বার্বাডোসে তৃতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৪৯০ রানের বিশাল ইনিংস গড়ার পরে একটা সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৯৮/৬ হয়ে গেছিল। কিন্তু শেরউইন ক্যাম্পবেল (১০৫) রিডলি জেকবস (৬৮) কে নিয়ে লড়াই করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে লড়াই করার মতো ৩২৯ রানে পৌঁছে দেন।
দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া মাত্র ১৪৬ রানে অলআউট হয়ে যায়। ওয়ালশ দারুন বোলিং করে ৩৯ রানে ৫ উইকেট দখল করেন। অ্যামব্রোস আর পেড্রো কলিন্স ২ টি করে উইকেট ভাগাভাগি করে নেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৩০৮। ওপেনিং জুটিতে ৭২ রান উঠলেও, এরপর নিয়মিত উইকেট হারাতে থাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ১০৫/৫ হয়ে যায়। ম্যাকগ্রা ও গিলেসপি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানদের নাকানি চুবানি খাইয়ে তোলেন।
একা লারা যিনি পাঁচ নম্বরে নেমেছিলেন পেড্রো কলিন্স নৈশপ্রহরী হিসেবে নেমেই ম্যাকগ্রার বলে বোল্ড হওয়ায়, লড়াই করতে থাকেন। গোটা ইনিংসে আর কেউ ৪০ রানের গণ্ডিও পেরোতে পারেননি। জিমি অ্যাডামস কে নিয়ে লারা দলের স্কোর ২৩৮ অবধি নিয়ে যান ( ১৩৩ রানের জুটিতে অ্যাডামস এর অবদান মাত্র ৩৮)। কিন্তু এরপর জেকবস আর পেরি দ্রুত আউট হতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৫০ তোলার আগেই ৮ উইকেট খুইয়ে বসে। এই সময় অস্ট্রেলিয়ার জয় সময়ের অপেক্ষা মনে হচ্ছিল।
কিন্তু, এবার লারার পাশে দাঁড়ান অ্যামব্রোস। লারার সঙ্গে ৫৪ রানের অমুল্য একটি জুটি গড়েন যেখানে তিনি মাত্র ১২ রান করেন। অন্যদিকে লারা প্রতিটি বল যেনো ম্যাচের শেষ বল এইভাবে একের পর এক চোখজুড়ানো স্ট্রোক নিচ্ছিলেন। তাঁর সেঞ্চুরিও অনেকক্ষণ আগেই পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু দলের জয়ের আগে সম্ভবত তিনি অন্য কিছু ভাবছিলেন না।
অবশেষে অ্যামব্রোস আর মাত্র ৬ রান বাকি থাকতে আউট হলেও, ওয়ালশ কে নিয়ে লারা সম্ভবত নব্বই এর দশকের অন্যতম সেরা একটি জয় এনে দেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। জয়সূচক বাউন্ডারি মেরে তিনি ১৫০ রানের মাইল স্টোনে পৌঁছান এবং ১৫৩ নট আউট থেকে উল্লাসে ফেটে পড়েন। তাঁর এই ইনিংস উইজডেন এর বিচারে সর্বকালের সেরা টেস্ট ইনিংসের লিস্টে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে ( ব্র্যাডম্যানের অলৌকিক ২৭০ এর পরেই)। পরবর্তীকালে একমাত্র কুশল মেন্ডিস ও বেন স্টোকস এই ইনিংসের সমতুল্য ইনিংস খেলতে পেরেছেন।
কাকতালীয় একটা ব্যাপারও আছে। ক্রিকেটের রাজপুত্রের প্রিয় বন্ধু এবং গড অব ক্রিকেট নামে পরিচিত শচীন টেন্ডুলকারের জন্যও ৩০ মার্চ দিনটা খুবই মনে রাখার মত। ২০১১ সালের এই দিনে পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল ম্যাচ খেলতে নামেন। এর আগে ২০০৩ সালে সেঞ্চুরিয়ান এর গ্রুপ লিগ ম্যাচের আগে শচীর ১২ রাত না ঘুমিয়ে ছিলেন। এবারে অবশ্য ততটা সময় তাঁকে দিতে হয়নি। তবে দেশের মাঠে ৯৬ কোয়ার্টার ফাইনালের পরে এত বড়ো ইন্ডিয়া পাক ম্যাচ আর সম্ভবত হয়নি।
শচীন ৯৯ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি করে ১০০ নম্বরের লক্ষ্যে ছিলেন, পাকিস্তান হুংকার দিয়েছিল ১০০ তম সেঞ্চুরি তারা শচীনকে করতে দেবে না এই ম্যাচে। পাকিস্তান তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল নিজেদের দেওয়া কথা ভুল প্রমাণ করার, কিন্তু পাঁচটা মিসড ক্যাচ এবং একটা ক্লোজ এলবিডব্লিউ থেকে বেঁচে গিয়ে শচীন অবশেষে ৮৫ রানে আউট হন। পাকিস্তানের সামনে ২৬১ রানের লক্ষ্যমাত্রা হয়তো খুব বড়ো ছিলনা, কিন্তু ভারতীয় বোলারদের আঁটোসাঁটো লাইন লেংথ এর সামনে পাকিস্তানের দমবন্ধ অবস্থা হয় এবং মিসবাহ উল হকের মন্থর ইনিংসও ভারতকে সাহায্য করে। অদ্ভুতভাবে তিনি ডিফেন্ড করতে থাকেন যখন পাকিস্তানের ওভার পিছু প্রায় ১০ রান দরকার! অবশেষে ২৯ রানে জয়ী হয়ে ভারত বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠে, এবং আর তিনদিন পরে ইতিহাস হয়।
শচীনের এই ইনিংসটি গুণমানের বিচারে হয়তো তাঁর প্রথম ১০০ টি ইনিংসের মধ্যেও আসবে না। কিন্তু গুরুত্বের বিচারে এই ইনিংসটি অপরিসীম মূল্য রাখে। সচিন অল্পরানে আউট হলে ভারত ২৩০-২৪০ এ শেষ হয়ে যেত এবং পাকিস্তান হয়তো সহজেই সেই রানটি তুলে ফেলতে সক্ষম হতো।