টেস্ট ক্রিকেটে উপেক্ষিত। প্রায় ৫০ বছর আগের একটা হেডলাইন। যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে মা। ওই পেপার কাটিং এর নিচেই বাবার একটা ছবি। খেলোয়াড়ি জীবনের। সকালে স্নান করে ঠাকুর আর বাবার ছবিতে প্রণামের সময় চোখ অজান্তে চলে যায় ওই শব্দগুলোর দিকে। টেস্ট ক্রিকেটে উপেক্ষিত। আমার বাবা, প্রয়াত সমর চক্রবর্তী, মানে চাকুদাকে যারা চিনতেন তারা জানবেন কথাটা কতটা সত্যি।
দেশ তখনো স্বাধীন হয়নি। এখনকার বাংলাদেশের বাহ্মণবাড়িয়া ঘিরে ফেলেছে হানাদার বাহিনী। দপদপ করে জ্বলছে মশাল। কানে আসছে আজ কাইট্টা ফেলুম। শ্যাষ কইরা দিমু। এদিকে গ্রামের পুরুষ রা তৈরি। বৌমা আমাগো প্রাণ থাকতে তোমাগো কুনো ভয় নাই। আর আমার ঠাকুমা? এক হাতে বিষের কৌটো। অন্য হাতে সন্তানদের নিয়ে ঝোপের ভেতর লুকিয়ে। হানাদারের হাতে পড়ার চেয়ে সবশুধু বিষ খেয়ে।
কোনো সিনেমা নয়। এটাই আমার বাবার ছোটবেলা। সেই লোকটাকেই যখন ২০১৩ এর এক পড়ন্ত বিকেলে ইডেনে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের (সিএবি) জীবন স্বীকৃতি সম্মান তুলে দেন কপিল দেব, তখন মনে হয় বাবার জীবনটাই গল্পের মতো। গল্প, তবে গল্প হলেও সত্যি।
এমনই এক মুহূর্তের সাক্ষী আমি নিজে। তখনও ফুল প্যান্ট পরার বয়েস হয়নি। ইডেনে রিলায়েন্স কাপ চলছে। ক্লাব হাউসের ভিআইপি বক্সে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষাকৃত খর্বকায় এক ক্রিকেটার। গোটা পৃথিবী তাঁকে চেনে সুনীল মনোহর গাভাস্কার নামে। অনেক ছোট তো, তাই খুব বেশি মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে গাভাস্কার বলেছিলেন, ‘তোমার বাবা প্রায় আমার ক্যারিয়ারটা শেষই করে দিয়েছিলেন।’
গাভাস্কার আর সমর চক্রবর্তীর বাইশ গজের প্রথম ডুয়েল এর কথায় পরে প্রবেশ করবো। কিন্তু ঘটনাটা একটা দাগ কেটে গিয়েছিল। পরদিন আজকালে ছোট্ট ডরিকে হেডিং ছিল বিরাট বাবা। সঙ্গে ঘটনার ছোট্ট বর্ণনা। যাই হোক, এখন চলুন আবার ফিরে যাই শুরুর সময় গুলোতে।
বাবা গল্প করতেন, ‘জানিস চুনীদা আর আমি, দুজনেই ময়মনসিংহের।’ পরে, অনেক পরে সেই চুনী গোস্বামীই এলেন আমাদের রাজচন্দ্রপুরের গ্রামের বাড়িতে। সার্ভিসেস আর রেলের হয়ে খেলে বাবা তখন রীতিমতো স্টার। গোটা ভারত জেনে গেছে চক্রবর্তীর কথা। চুনী এসেছিলেন মোহনবাগানে সই করানোর জন্য।
বাড়ির অনেকটা আগে গাড়ি রেখে। মাটির রাস্তা, ঝিঝি আর শেয়ালের ডাক। এখনকার দিন হলে মিডিয়ার ফ্লাশ বাল্বের আলোয় মুছে যেত সব অন্ধকার। সেদিন চুনিদাই বাবাকে নিয়ে গেছিলেন মোহনবাগানে। বাবা বলতেন চাকরির বন্দোবস্ত টাও নাকি চুনী গোস্বামীই করে দিয়েছিলেন।
সমর চক্রবর্তী। মানুষটার জীবনটা বড় অদ্ভুত। একটা উপন্যাসের মতো। সোসাল সাইটে লিখি মাঝে মাঝে। অনেকেই জানতে চাইতেন বাবার কথা। বাবা আজ নেই। তবু গল্পগুলো তো আছে অনেকটা ‘ফেলে আসা স্মৃতিটাই সম্বল’ এর মত।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহে জন্মেছিলেন বাবা। চার ভাই। এক বোন। ওই দাঙ্গার সময়টাই ঠাকুরদা রেঙ্গুনে কর্মরত ছিলেন। বাবাদের গ্রাম বিখ্যাত বিপ্লবী ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী র গ্রাম। বাবা বলতেন ত্রৈলোক্য জ্যাঠা মশাই। অজ গ্রাম বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। দেশ স্বাধীন হবার পর খবর পৌঁছেছিল, ‘ইন্ডিয়া হইসে। আমরা স্বাধীন হইয়া গেছি।’
বাতাবি লেবু (জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা, ঝড়ের মধ্যে আম পাড়ার গল্প) বাবার খুব প্রিয় ছিল। আর ওই দাঙ্গা র কথা। আমার মনে হয়েছে ওই ‘বাঁচতে হবে’ তাগিদটাই বারুদে আগুন জ্বালানোর কাজটা করেছিল। সমর চক্রবর্তী হয়ে ওঠার সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল।
শুরু থেকে লড়াই। দেশ ভাগ হচ্ছে। ঠাকুমা ওপারে। দাদু রেঙ্গুনে। 8 বছরের বাবা। সঙ্গে কয়েক বছরের বড় জেঠু। মানিকতলার কাছে বাগমারিতে এক আত্মীয়ের খুপরি ঘর। মার মুখে শুনেছি বিয়ের পর বাবা মা কে নিয়ে দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল ওই বাগমারীর পাড়া। প্রতিটা ইটে লেখা লেখা জীবন সংগ্রামের কথা।
অদ্ভুত গুলির টিপ। বাগমারিতে বাবা র নাম ছিল ‘টিপ্পুস’। গুলি খেলাই জিতে ভর্তি হতো বড় বড় কাঁচের বয়াম। আমি ছোটবেলায় দেখেছি সেগুলো। হাতে পয়সা নেই। শুনেছি এক বৃদ্ধা ঝুড়িভাজা বানাতেন। বাবা ওগুলো ঠোঙায় ভরে দিত। বিনিময়ে অল্প পয়সা। কখনো জুটে যেত ভাঙা টুকরো। পরে শুনেছি অভাবের তাড়নায় বাস কন্ডাকটর হবে ঠিক করে ফেলেছিল বাবা।
১৮ বছরে পা দিতে না দিতেই চাকরির চেষ্টা। ততদিনে রাজচন্দ্রপুরে উঠে এসেছে পরিবার। রেঙ্গুন থেকে ফিরে এসে পোস্ট মাস্টারের কাজ নিয়েছেন দাদু। ওপার থেকে ভাই বোনদের নিয়ে চলে এসেছেন ঠাকুমা। ছেড়া সুতোগুলো আবার জোড়া লাগছে। জীবন সংগ্রাম ও চলছে। একদিন খবর এলো আর্মি তে লোক নেয়া হবে। সাত সকালেই বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে ১৮ বছরের সমর চক্রবর্তী।
কোনো চেনা জানা পরিচিতি কিছুই নেই। মাঝে মাঝে আর্মি অফিসার এসে কড়া ধমক লাগিয়ে যাচ্ছেন, যাতে বিশৃঙ্খলা না হয়। কিন্তু অতো ভিড়ের মাঝেও আলাদা নজর টেনে নিয়েছিল ৬ ফিট ১ ইঞ্চির ছিপছিপে চেহারাটা। বাবার পরবর্তী ঠিকানা আর্মি বেস ক্যাম্প। সেকেন্দ্রাবাদ।। নদীর বাঁকের মতো জীবনের এক একটা টুইস্ট।। বাক্স, বিছানা বেঁধে সমর চক্রবর্তী সেকেন্দ্রাবাদের দিকে। পড়ে রইলো পরিবার। সামনে অজানা ভবিষ্যৎ। ওই যে বাঁচতে হবে। ওটাই তাগিদ।
এইখানে ছোট্ট একটা তথ্য জুড়ে দিতেই হবে। টেনিস বল হাতে তখন বাবার বেশ নাম ডাক হয়েছে। ফুটবলে স্টপার এর জায়গাটা পাকা। ছয় ফুট এক ইঞ্চি লম্বা চেহারাটা হেড করতে উঠলে সবার ওপরে জেগে থাকে। এভারেস্টের চূড়ার মতই। কিন্তু ক্রিকেটার হবো, এই স্বপ্ন বাবার আশেপাশেই নেই!
এমনকি হায়দ্রাবাদ আর্মির হয়ে নিয়মিত লিগ খেলত বাবা। আর্মি তে ফুটবলার চক্রবর্তী। ক্রিকেট না খেললে হয়তো ফুটবলার হওয়াটা বাধা ছিল। তবু ক্রিকেট এলো। একটা নাটকীয় মোচড় জীবনটা পাল্টে দিলো। কি সেই ঘটনা?
খবর এলো ক্রিকেট ট্রায়াল হবে। দলে জায়গা পেলে হয়ত প্রতিদিনের হাড়ভাঙা ট্রেনিং এর ধকল কিছুটা কমতে পারে। টেনিস বলে বল করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বাবা হাজির নেটে। পায়ে ফুটবলের বুট। লাল বল হাতে উঠলো জীবনে প্রথম বারের জন্য। তার পরের অন্তত ১৬ টা বছর বাবা যে দলে, ওই লাল বলটা কেড়ে নেবার সাধ্য হয়নি কারোর।
আর্মি র হাড়ভাঙা ট্রেনিং। একটা গল্প শোনানোর লোভ সামলাতে পারছি না। এত খাটুনি, বাবা একদিন আর না পেরে চলে যায় ক্যাপ্টেন গিল এর ঘরে। আমি কলকাতা ফিরে যাবো। ক্যাপ্টেন ড্রয়ার থেকে বার করে এনেছিলেন একটা রিভলবার। বলেছিলেন এই কথাটা আর একবার বললে তোমার লাশ ফিরবে কলকাতায়। আমার মনে হয়েছে এটাই হয়তো টার্নিং পয়েন্ট ছিল। আর্মি তে না থাকলে সমর চক্রবর্তী কে হয়তো পাওয়া যেত না
এইখানে আমাকে একটু থামতে হচ্ছে। মনে পড়ছে ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ এর দৃশ্য। স্পেশাল ডায়াট মিলবে। তাই মিলখা সিং চললেন লম্বা দৌড়ের ট্রায়ালে। মিলখা সিং হওয়ার দৌড় শুরু। আমার মনে হয়েছে বাবার জীবনেও এটাই ছিল সমর চক্রবর্তী হয়ে ওঠার সূচনা।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রয়াত কিংবদন্তিতুল্য ক্রিকেটার সমর চক্রবর্তীর ছেলে