রূপকথার গল্প ততক্ষণে লেখা শেষ। ব্রিটিশ রাজপুত্রের হাত থেকে শিরোপা নিয়ে উদযাপনও শেষ দলের সকলের। এখন বাকি শুধু উৎসবের।
এর মাঝেই ট্রফি ছেড়ে গ্যালারির দিকে দৌড় দিলেন অধিনায়ক ক্যাস্পার স্মাইকেল। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে গতকাল বসেছিল দর্শকের মেলা। আর তার মধ্য থেকেই হাত ধরে টেনে একজন লোককে বের করে আনলেন ড্যানিশ গোলরক্ষক। ছোটখাটো গড়নের এশিয়ান এই ভদ্রলোকের নাম আইয়াত শ্রীভাধানাপ্রভা।
ক্যাস্পার স্মাইকেলের হাত ধরে মাঠে দৌড়াতে দৌড়াতে মুখে স্পষ্ট হয়ে আসা চওড়া হাসি যেকোনো ফুটবল সমর্থকের মনই ভড়িয়ে দিতে বাধ্য। সেই সাথে জুম ইন করা হলো ওয়েম্বলির গ্যালারিতে, যেখানে বিশাল ব্যানার তার বাবা ভিচাই শ্রীভাধানাপ্রভার। যাতে লেখা, ‘Our dreams can come true… if we have the courage to pursue them.’লেস্টারের গল্পটা শুধু রূপকথা বললে ভূল হবে। ২০১৬ সালে প্রিমিয়ার লিগ জেতাটা সকলের কাছে ছিল ফ্লুক। ৫০০০/১ অডের বিপরীতে প্রিমিয়ার লিগ তুলে ধরা যে অসম্ভবের কাছাকাছি। কিন্তু সেই অসম্ভবের পেছনে খেলোয়াড়-কোচ বাদেও একটা লোকের নাম বড় বড় করে লেখা থাকবে। লোকটার নাম ভিচাই শ্রীভাধানাপ্রভা। ভিচাই ছিলেন কিং পাওয়ারের মালিক। লেস্টার কিনেছিলেন ভালোবাসার জায়গা থকে। তখন লেস্টার নিয়মিত ঘুরপাক খেত সেকেন্ড ডিভিশনে। সেখান থেকে প্রিমিয়ার লিগ, এরপর প্রিমিয়ার লিগ জয়।
ক্লাউডিও রানেইরির হাত ধরে যখন প্রথমবারের মতন শিরোপার ছোঁয়া পায় লেস্টার সেদিন লেস্টারের প্রতিটা লোক একবার করে হলেও নাম নিয়েছেন এই থাই বিলিওনারের। লেস্টারের প্রায় ম্যাচেই থেকেছেন স্ট্যান্ডে। সব বাঁধা ভেঙ্গে খেলোয়াড়দের সাথে যোগ দিয়েছেন বাস প্যারেডে। দিনে দিনে লেস্টারের একজন হয়ে উঠেছিলেন ভিচাই।
কিন্তু কথায় আছে সবার কপালে সুখ সয় না। ভিচাই তার জীবনের সর্বোচ্চ সুখ পেয়েছিলেন লেস্টারের জার্সি গায়ে। তার জীবনের শেষটাও লেস্টারের সাথেই লেখা। লেস্টারের ম্যাচ দেখে থাইল্যান্ড ফিরছিলেন ভিচাই। কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামেই রাখা হয়েছিল তার জন্য বরাদ্দ হেলিকাপ্টার। আর সেই হেলিকাপ্টার মাটি থেকে উড়তে না উড়তেই আছড়ে পড়ল স্টেডিয়ামের পার্কিং লটে। লেস্টারের মানুষটা নিজের শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন নিজের প্রাণের ক্লাবের পাশেই।লেস্টার রূপকথার প্রতিটি মানুষ সেদিন ভেঙ্গে পরেছিলেন। ইংলিশ ফুটবল ক্লাবের মালিকানা অনেক ভিনদেশি মালিকের হাতেই গিয়েছে। কিন্তু ভিচাইয়ের মতন করে ক্লাবকে ভালোবাসতে পেরেছেন খুব কম মানুষই। সেকেন্ড ডিভিশনে ঘুরপাক খেতে থাকা দলটাকে প্রিমিয়ার লিগ জায়ান্টে পরিণত করেছেন। টাকা-পয়সা, ভালো ম্যানেজার; কোনোদিক দিয়ে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি তিনি। দু:খ ভারাক্রান্ত মনে সেই লেস্টারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ছোট ছেলে আইয়াত শ্রীভাধানাপ্রভা। বাবার স্বপ্ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য যার।
ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো ট্রফিতে লেস্টারের ইতিহাস বেশ কাঁচা। শেষ ষাটের দশকে ফাইনালে উঠেছিল তারা। চার ফাইনালেই চারটিতে হেরেই মাথা নিচু করে মাঠ ছেড়েছে লেস্টার। কিন্তু এবারের লেস্টারের গল্প অন্যরকম, এই লেস্টার জিওতেতে এসেছে নিজেদের জন্য নয়, বরং ভিচাইয়ের জন্য। ম্যাচ শুরু আগে প্রতিটি খেলোয়াড় নিজের জার্সির নিচে ভিচাইয়ের ছবি নিয়ে শুরু করেছিল। বুকের মাঝে প্রয়াত মালিকের ছবি দিয়ে যেন তাকেই স্মরণ করার চেষ্টা ছিল লেস্টারের। সেটা করেও দেখিয়েছে।
শুধু মালিক নয়, লেস্টার খেলেছে নিজেদের সমর্থকদের জন্যও। লেস্টারের এক সমর্থকের কথা ছিল ওয়েম্বলিতে খেলা দেখার। অথচ ম্যাচের আগেরদিন হঠাৎ করেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ৬৩ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যাওয়া সমর্থকের জন্য ৬৩তম মিনিটে আয়োজন করে রেখেছিল লেস্টারের সমর্থকেরা। কিন্তু সেই ৬৩ মিনিটেই তার জন্য সেরা উপহার এনে দিয়েছেন ইউরি তিলেমান্স। দূরপাল্লার এক শটই হয়ে গিয়েছে শিরোপা নির্ধারণী। চেলসিকে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতন এফএ কাপ জেতার স্বাদ পেয়েছে লেস্টার। আর সেটা আজ ভিচাইয়ের জন্যই।শুধু ভিচাই বললে ভুল হবে, শিরোপাটা ব্রেন্ডন রজার্স, জেমি ভার্ডির জন্যও কম আনন্দের নয়। ব্রেন্ডন রজার্স হতে পারতেন লিভারপুলের দু:খভাঙানিয়া পাখি। প্রিমিয়ার শিরোপা হাতছোঁয়া দূরত্বে রেখে ফেরত এসেছেন তিনি।
লিভারপুল থেকে বরখাস্ত হয়ে চলে গিয়েছিলেন সেল্টিক, তাদের তিন লিগ জিতিয়ে আবার ফিরেছেন। আইয়াতের হাত ধরে আবার ফিরেছেন প্রিমিয়ার লিগে। গত মৌসুমে সামান্যর জন্য বাদ গিয়েছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে, কিন্তু এই মৌসুমে আর তা হচ্ছে না।
আর জেমি ভার্ডি তো রেকর্ড গড়লেন এফএ কাপের। এফএ কাপের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি রাউন্ডে খেলা একমাত্র খেলোয়াড় এখন জেমি ভার্ডি। টপ লিগে খেলা একজন খেলোয়াড় এফএ কাপের শেষ ছয় রাউন্ডে খেলার সুযোগ হয়। কিন্তু এর আগে নন-প্রফেশনাল লিগে খেলবার কারণে এফএ কাপের ১৩ তম রাউন্ডেও পা পরেছে তার। আর সেখান থেকে আজ তিনি এফএ কাপ শিরোপাজয়ী। সময় বোধহয় এভাবেই পালটায়।কিছুদিন আগেই ইউরোপিয়ান ফুটবল তোলপাড় হয়ে গিয়েছে ইউরোপিয়ান সুপার লিগ নিয়ে। মালিকেরা নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতীক হিসেবে চালু করেছিল এক বিদ্রোহী লিগ। খেলোয়াড়, সমর্থক আর মালিকদের পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সেদিন। ক্যাস্পার স্মাইকেলের হাত ধরে আইয়াতের মাঠে প্রবেশ করাটা যেন সেই গল্পের মুখে ঝামা ঘষে দিল। মালিক-খেলোয়াড়ের সম্পর্ক তো এমনই হওয়া উচিত।