ইয়র্কশায়ারের ‘ব্লুয়ি’ বয়!

মাথাভর্তি লাল রঙের রঙিন চুল ও নীল চোখের জন্য পরিচিত ছিলেন। ওই চুল আর চোখের জন্যই ইয়র্কশায়ারের সতীর্থদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন ‘ব্লুয়ি’ (Bluey) নাম।

ব্লুয়ি নামের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিলো তার আসল নামটা। এই যেমন আজকের যুগেও আমরা তার নামটা ঠিক মনে করতে পারি না। তবে ছেলের কথা বললে চিনতে পারবেন। তার ছেলে জনি বেয়ারস্টো। ইংল্যান্ড দলের হয়ে সাড়া জাগানো এক উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। হ্যাঁ, আমরা বলছি জনির বাবা ডেভিড বেয়ারস্টোর গল্প।

ডেভিড বেয়ারেস্টো ছিলেন উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান। ইয়র্কশায়ারের ব্যাট ও গ্লাভস উভয়দিকের নির্ভরতার প্রতীক ও বহু রেকর্ডের মালিক। ইয়র্কশায়ারের সমর্থকদের আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিলো তার অবস্থান।

খেলাধুলার জগতে ছিলেন তুখোড় মেধাবী। ইংল্যান্ডে ক্রিকেট-ফুটবল উভয়ের জনপ্রিয়তা চিরকাল-ই তুঙ্গে। ইংল্যান্ড দুই খেলাতেই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তকমা গায়ে জড়িয়েছে। আর ডেভিড জড়িয়েছিলেন দুই খেলাতেই পারদর্শীতার তকমা।

তুমুল জনপ্রিয় এই ক্রীড়া ব্যক্তি ইয়র্কশায়ারের ব্র‍্যাডফোর্ডে জন্ম নেন ১৯৫১ সালে। স্কুলের ফুটবল ও ক্রিকেট দুই দলেই ছিলো তার দাপুটে অবস্থান। ব্র‍্যাডফোর্ড সিটির হয়ে খেলেছেন অসংখ্য ফুটবল ম্যাচ। পরবর্তীতে নিজেকে স্থায়ী করে নেন ক্রিকেট। ১৯৭০ সালে প্রথমবারের মত কাউন্টি ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ঘটান গ্লস্টাশায়ারের বিপক্ষে। পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই ইয়র্কশায়ারের জার্সি গায়ে খেলেছেন। তাই নিজ ঘর আর ইয়র্কশায়ারের ড্রেসিংরুমের মাঝে কোনো তফাৎ ছিলোনা তার কাছে।

তেজি ক্রিকেটারদের তালিকা করা হলে ডেভিডের নাম জায়গা করে নিবে খুব সহজে। মাঠে তার অবস্থান এই কারণেই সর্বদা প্রশংসিত ছিলো ইয়র্কশায়ারের দর্শকদের কাছে। ক্রিকেট মাঠে সার্বক্ষণিক আক্রমণাত্মক থাকার মানসিকতাই তার সফলতার মূলমন্ত্র। দল কে চাঙা রাখতেই এমন দৃঢ়চেতা মনোবলে উইকেটের পেছনে দাঁড়াতেন। হার না মানা মানসিকতা তাকে জনপ্রিয় করে তোলে।

এমন শরীরি ভূমিকাই ১৯৮২-৮৪ পর্যন্ত তার উপর ক্লাবের অধিনায়কত্বের ভার বইয়ে আনে। ব্যাট হাতে লোয়ার-অর্ডারে তো ছিলেন ব্যাপক বিধ্বংসী। সবমিলিয়ে অধিনায়ক হিসেবে একেবারে কমপ্লিট প্যাকেজ। তিন মৌসুম দিয়েছেন ক্লাব কে নেতৃত্ব। দলের সাথে ছিলেন সর্বোমোট ২১ মৌসুম।

উইকেটের পেছনে ১৯৮১ তে স্কার্বরো তে ডার্বিশায়ার বিপক্ষে এক ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে ১১ ডিসমিসালের রেকর্ড গড়েন। বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপে ১৯৮১ তে ইয়র্কশায়ার যখন ৮০ রান দূরে জয়ের বন্দর থেকে — ঠিক তখন-ই ত্রানকর্তার ভূমিকায় নয়টি ছক্কা হাঁকিয়ে দল কে জয়ের স্বাদ পাইয়ে দেন। সবশেষ সঙ্গী হিসেবে ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান মার্ক জনসন ছিলেন অভিষিক্ত। তাই একাই নেন এই পাহাড়সম রানের চাপ। ম্যাচশেষে ডেভিড অপরাজিত থাকেন ১০৩ রানে।

এই ম্যাচের দুই বছর পূর্বেই ইংল্যান্ডের জাতীয় টেস্ট দলের ক্যাপ তার দখলে আসে। ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হওয়া টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৯ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস খেলেন। জাতীয় দলে উইকেট কিপারের জায়গা নিয়ে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও দলে নিজের জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হননি। যদিও জাতীয় দলে প্রথম অভিষেক ঘটে ওয়ানডে দলের সদস্য হয়ে।

ইয়র্কশায়ারের নিয়মিত সদস্য হয়ে কুঁড়িয়েছেন সুনাম। ভক্তদের কাছে ছিলেন আশা-ভরসার একজন। যাকে ঘিরে ভক্তদের ছিলো অগাধ বিশ্বাস। সহসা প্রশংসায় যার মুখ খোলেনা, সেই জিওফ বয়কট অনায়াসেই করেছেন ডেভিডের ক্রিকেট মাঠে পেশাদারিত্বের প্রশংসা। সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার লেন হাট্টন ছিলেন ডেভিডের অন্যতম ভক্ত। ব্যাট, কিপিং গ্লাভস ও নেতৃত্বে নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাই অভিজ্ঞদের প্রশংসায় নিজেকে ভাসিয়ে তাদের বানিয়েছেন নিজের ভক্ত। একজন সফল ক্রীড়াব্যক্তিত্বের সবচেয়ে গুণ সম্ভবত এটাই।

ডেভিড মুখের দাঁড়ি কামানোর ব্যাপারে নিয়মিত ছিলেন না। একবার দলের ম্যানেজারের আদেশেই ইলেকট্রিক ট্রিমারে নিজের দাঁড়ি কাটতে গিয়ে অস্বাভাবিক এক দূর্ঘটনার শিকার হন। অনিয়মিত দাঁড়ি কামানো ব্যক্তি নিজের দাঁড়ি নিজে কাটতে গিয়ে অদ্ভুত এক বিপদ ডেকে আনেন। মুখের ইনজুরিতে পড়তে হয় তাঁকে।

ইয়র্কশায়ারের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৪৫৯ ম্যাচে প্রায় ১৪ হাজার রান করেন ২৬ গড়ে। ৯৬১ টি ক্যাচের বিপরীতে রয়েছে ১৩৭ টি স্টাম্পিং। ৪২৯ লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার রান করেন।

ব্যক্তিজীবনে তিনি দু’বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। দুই পরিবার মিলিয়ে তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তার প্রথম স্ত্রীর সন্তান এন্ড্রু বেয়ারেস্ট্রো কাউন্টি ক্রিকেটের অংশ হয়েছেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান জনি বেয়ারেস্টো বর্তমান সময়ের ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। ছেলে জনি ছিলেন ২০১৯ বিশ্বকাপজয়ী সদস্য।

ডেভিড অবসরের পর ১৯৯০ এর দিকে রেডিওতে নিয়মিত ধারাভাষ্যকারের দায়িত্ব পালন করেন। খেলোয়াড়ি জীবন থেকে অবসর নিলেও ছেড়ে যাননি ক্রিকেটকে। জীবনের আষ্টেপৃষ্টে তার ক্রিকেট-ই ছিলো। আর  অস্তিত্বজুড়ে ছিলো ইয়োর্কশায়ার ক্লাবের অবস্থান। একবার ক্লাব কর্তৃপক্ষের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন।

একই সময়ে তিনি ডিপ্রেশনেও ভুগছিলেন। ১৯৯৭ এর শেষদিকে একদিন অতিমাত্রায় ওষুধ সেবন করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। যদিও এর পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে গেলেও কয়েক সপ্তাহ পর নিজের ঘরে গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেন ডেভিড বেয়ারেস্ট্রো। ডেভিডের স্ত্রী শোক ভুলতে সন্তানদের নিয়ে অন্য শহরে পাড়ি জমান।

ইয়োর্কশায়ারের জনপ্রিয় একজন ক্রিকেটার হয়েও তাকে আত্মহত্যা পথ বেছে নিতে হয় ডিপ্রেশনে ভুগে। ছেলে জনি বেয়ারেস্ট্রো তাই জার্সির পেছনে ৫১ নম্বর টা লাগিয়েছেন বাবার জন্মসাল কে স্মরণ করেই। শতকের পর আকাশের পানে চেয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন নিয়মিত, বাবার স্মৃতি কে সম্মান করতেই।

ছেলে জনি বেয়ারেস্ট্রোও নিয়মিত খেলে যান ইয়র্কশায়ারের হয়ে। বাবা ডেভিড বেয়ারেস্ট্রোর পদচিহ্ন সফলভাবেই অনুসরণ করেছে ছেলে জনি বেয়ারেস্টো। কিন্তু ডেভিডের মত ভালোবাসা, জনপ্রিয়তা আর কেউ কি পাবে ইয়োর্কশায়ারের সমর্থকদের কাছে থেকে?

হয়তো পাবে। আবার হয়তো পাবেও না হতে পারে। তবে ডেভিড বেঁচে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইয়র্কশায়ার ক্লাবের ইতিহাসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link