আন্ডারআর্ম ও চ্যাপেল ভাইদের লজ্জার অধ্যায়

গ্রেগকে উদ্দেশ্যে করে পরবর্তীতে তাঁরই বড় ভাই ইয়ান চ্যাপেল বলেছিলেন, ‘গ্রেগ তুমি ৩৫ হাজার ডলার জেতার জন্য কতটুকু উৎসর্গ করতে পারো? কারণ, ভাই, তুমি অনেক কিছুই উৎসর্গ করে ফেলেছো ৫২ হাজার ৮২৫ জন টিভি দর্শকদের সামনে!’

চ্যাপেল ভাইদের কথা আসলেই সবার আগে মেলবোর্নের সেই কলঙ্কিত ঘটনাই ভেসে ওঠে। ১৯৮১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মেলবোর্নে গ্রেগ চ্যাপেলের নির্দেশে ছোটভাই ট্রেভর চ্যাপেলের সেই আন্ডারআর্ম ডেলিভারিটি ক্রিকেট ইতিহাসের এক লজ্জাজনক ঘটনা হিসেবেই জায়গা পেয়েছে। অনেকেই ওই দিনটিকে ‘ব্ল্যাক ডে’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন। এমন লজ্জাজনক কান্ডে গ্রেগ চ্যাপেল ও ট্রেভর চ্যাপেলের ক্যারিয়ারে লাগে কালো দাগ। বড় ভাই ইয়ান চ্যাপেল কমেন্ট্রি বক্সে বসে সাক্ষী হয়েছিলেন ছোট ভাইদের ঘৃন্য সেই কাণ্ডে!

১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১।

বেনসন অ্যান্ড হেইজেস ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপের তৃতীয় ফাইনালে মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। প্রথম দুই ম্যাচে ১-১ সমতা। শেষ ম্যাচে জয়ী দলের হাতেই উঠবে শিরোপা। এমন এক উত্তেজনাকর ফাইনালের শেষ ওভারের শেষ বলে নিউজিল্যান্ডের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ৭ রানের। যা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ব্যাপারই।

তাও আবার স্ট্রাইকে ছিলেন ব্রায়ান ম্যাকেচনি। যিনি তখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছক্কাই হাঁকাতে পারেননি ! তার উপর সেদিনের উইকেট ছিল যথেষ্ট স্লো এবং বাউন্ডারিও ছিল বেশ বড় ! তাই নিউজিল্যান্ডের পরাজয় প্রায় নিশ্চিতই ছিল।

অবশ্য দুর্ভাগ্যবশত পুরো ওভারেই স্ট্রাইক পাননি আরেক প্রান্তে ১০২ রানে অপরাজিত থাকা কিউই ওপেনার ব্রুস এডজার। যা হোক শেষ ডেলিভারিটি করতে বল হাতে প্রস্তুত ছিলেন ট্রেভর চ্যাপেল। কিন্তু শেষ বলের আগে বড় ভাই অজি অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেল তাঁকে ডেকে বললেন, ‘আন্ডারআর্ম ডেলিভারির অভিজ্ঞতা আছে তোমার?’

জবাবে ট্রেভর বললেন, ‘না তো, এমন কেনো জিজ্ঞেস করছো?’

গ্রেগ তখন ট্রেভরকে বললেন, ‘এই ম্যাচ জয়ের কোনো সুযোগই হাতছাড়া করতে চাই না। তাই তুমি গড়িয়ে বল করো!’

গ্রেগ তখন অন ফিল্ড আম্পায়ার ডন ওয়েসের কাছে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানালেন। ওয়েস বললেন, ‘ক্রিকেটের নিয়মবহির্ভূত কিছু নয় এটি।’

ওয়েস সাথে সাথে স্ট্রাইকে থাকা ম্যাকেচনিকে গ্রেগের পরিকল্পনার কথা জানালেন। ম্যাকেচনি এই কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়েছেন! তিনি ওয়েসকে বললেন, ‘তুমি কি মজা করছো আমার সাথে?’ কমেন্ট্রি বক্স থেকে চ্যাপেলদের বড় ভাই ইয়ান চ্যাপেল বলছিলেন, ‘না, গ্রেগ না; এটা তুমি করতে পারো না!’

দর্শকরাও তখন বুঝে উঠতে পারছিলেন না ঠিক কি ঘটতে চলেছে! সবাইকে অবাক করে দিয়ে শেষ বলটি মাটিতে গড়িয়েই করলেন ট্রেভর! ম্যাকেচনি স্লগে হিট করতে চেয়েও বোল্ড হয়ে অপমানিত হওয়ার চেয়ে ডিফেন্স করাই শ্রেয় মনে করলেন। আর সেই গড়িয়ে আসা বলটা ডিফেন্স করেই তিনি ব্যাট ছুঁড়ে মারলেন মাটিতে। চ্যাপেল ভাইদের উদযাপন-উল্লাসের মাঝে সেদিন মেলবোর্ন সাক্ষী হয়েছিল কলঙ্কিত এক অধ্যায়ের!

নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক জিওফ হাওয়ার্থ দ্রুত মাঠে প্রবেশ করলেন। চোখে-মুখে বিরক্তি আর রাগ স্পষ্ট। আম্পায়ারকে এ ব্যাপারে বলতেই আম্পায়াররা জানালেন এটি নিয়মের মধ্যেই ছিলো। এমন কাণ্ডের পর ড্রেসিং রুমে এক ব্ল্যাকক্যাপ প্লেয়ারতো কফির মগ দেওয়ালেই ছুঁড়ে মেরেছিলেন!

ট্রেভর ওই বলটি আন্ডারআর্ম ডেলিভারি করে জন্ম দিয়েছিলেন এক বিতর্কিত অধ্যায়ের। ওই ঘটনায় পুরো ক্রিকেট বিশ্বেই সমালোচনার ঝড় উঠে। এমনকি বাউন্ডারির পাচিল টপকে অনেকেই গ্রেগ ও ট্রেভরের দিকে মারমুখি ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে। পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে গ্রেগ অবশ্য বলেছিলেন, ‘এক মেয়ে তার কলার চেপে ধরে পড়েছিলেন, তুমি প্রতারক।’

গ্রেগ বলেন ওই সময় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর চিন্তার বাইরে ছিল বিষয়টা। এতো বড় ঘটনা ঘটে যাবে তিনি নিজেও সেটি ভাবেননি।

গ্রেগকে উদ্দেশ্যে করে পরবর্তীতে তাঁরই বড় ভাই ইয়ান চ্যাপেল বলেছিলেন, ‘গ্রেগ তুমি ৩৫ হাজার ডলার জেতার জন্য কতটুকু উৎসর্গ করতে পারো? কারণ, ভাই, তুমি অনেক কিছুই উৎসর্গ করে ফেলেছো ৫২ হাজার ৮২৫ জন টিভি দর্শকদের সামনে!’

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মালডুন অবশ্য এই ঘটনার সময় ছিলেন ফ্লাইটে। এরপর ঘটনা জানতে পেরে তিনি বলেছিলেন, ‘ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য একটা ঘটনা এটি।’ ওই ঘটনার পরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা (আইসিসি) থেকে আন্ডারআর্ম ডেলিভারি নিষিদ্ধ করা হয়।

কলঙ্কিত সেই ফাইনালে টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে গ্রায়েম উড ও অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেলের জোড়া ফিফটিতে ৪ উইকেটে ২৩৫ রান সংগ্রহ করে অজিরা। পরবর্তীতে রান তাড়া করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ২২৯ রান সংগ্রহ করে নিউজিল্যান্ড। কলঙ্কিত সেই শেষ ডেলিভারিতে ৬ রানের জয়ে ২-১ এ সিরিজ জেতে অজিরা।

পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়া তখন নিউজিল্যান্ড সফরে। প্রথম ওয়ানডেতে গ্রেগ চ্যাপেল যখন ব্যাট করতে নামছিলেন, চ্যাপেলকে লজ্জা দিতে দর্শকদের মাঝ থেকে একটি টেনিস বল মাঠে গড়িয়ে মারা হয়! শুধু ওই সময়ই না পরবর্তীতে পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই দর্শকদের নিন্দা পেয়েছিলেন গ্রেগ ও ট্রেভর চ্যাপেল।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...