ধ্যানী এক ক্রিকেট সাধক

২০১৫ সালের কথা।

বাংলাদেশ সফরে এসে দক্ষিণ আফ্রিকার বেহাল দশা; অধিনায়ক হিসেবে তিনিও অস্বস্তিতে।

মিরপুর অ্যাকাডেমিতে সেদিন জোর অনুশীলন করছে দক্ষিণ আফ্রিকা দল। এক পাশে ফাফ ডু প্লেসির সাথে কথা বলছেন তিনি। পরনে প্র্যাকটিস কিট। মুন্ডিত মস্তক, শস্রুমন্ডিত মুখায়ব নিয়ে নিষ্পলক চেয়ে আছেন ডু প্লেসির দিকে; যেন ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারছেন।

দূর থেকে সব কথা শোনা যাচ্ছে না। সব শেষে একটা কথা কানে ভেসে এলো। ডু প্লেসির কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘যাই ঘটুক শান্ত থাকতে হবে। যা নিয়ন্ত্রন করতে পারবে না, তা নিয়ে চিন্তা করো না। যা নিয়ন্ত্রন করতে পারবে, সেটাতে সময় দাও।’

আহ!

যেন একজন ঋষি তার শিষ্যকে জীবনে চলার পথে জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। সেই মুহুর্তে একবার মনে হলো, মিরপুর অ্যাকাডেমি নয়; কোনো নির্জন নদী তীরে শিষ্যর দিকে চেয়ে থাকা একজন সাধককে দেখছি।

হ্যাঁ, তিনি একজন সাধক। ক্রিকেটের সাধক হাশিম মোহামেদ আমলা। আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রেটেস্ট ব্যাটসম্যান হাশিম আমলা।

টেস্টে ৯ হাজারের ওপরে, ওয়ানডেতে ৮ হাজারের ওপরে রান করা আমলার গ্রেটনেস নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আমরা বরং আমলার ব্যাটিং দর্শন এবং জীবন দর্শন নিয়ে বিস্মিত হতে পারি। বোঝার চেষ্টা করতে পারি যে, আজকের এই যুগে এমন স্রষ্ঠায় সমর্পিত একজন মানুষ কী করে ক্রিকেটের সুন্দরতম খেলোয়াড়দের একজনে পরিণত হলেন।

হাশিম আমলা ভারতীয় বংশোদ্ভুত প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকান আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটার।

হাশিমের বাবা-চাচারা ভারতের গুজরাট থেকে বিশ্বের তিন প্রান্তে গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা যায়, তার এক চাচা ঢাকায় স্থায়ী আছেন সপরিবারে। আর ডক্টর মোহামেদ আমলা স্থায়ী হয়েছিলেন ডারবানে। এখানেই জন্ম হাশিম ও আহমেদ আমলাদের দুই ভাইয়ের।

দুই ভাই একসাথেও খেলেছেন কাওয়াজুলু-নাটাল দলের হয়ে। তবে বড় জন, আহমেদ আমলা খুব বেশিদূর যেতে পারেননি। হাশিম নিজের নামটা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন যুব পর্যায়ে খেলার সময়েই। ওই পর্যায়েই তাকে রান মেশিন মনে করা হতো। তবে মূলত লংগার ভার্শনের উপযোগী বলে বিবেচিত হতেন তিনি।

ডারবান হাই স্কুলেই ক্রিকেটের হাতে খড়ি আমলার। এই স্কুল থেকে ল্যান্স ক্লুজনার, ব্যারি রিচার্ডসদেরও পেয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট। ২০০১-০২ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা যুব দলের অধিনায়ক হিসেবে নিউজিল্যান্ড সফরের পর ২০০২ যুব বিশ্বকাপ তাকে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে নিয়ে আসে।

ডলফিনের হয়ে প্রথম ৮ ইনিংসের মধ্যে ৩টি সেঞ্চুরি করে আমলা নিজের আগমনের খবরটা দক্ষিণ আফ্রিকায় ছড়িয়ে দেন। ২০০৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ভারত সফরের দলে ডাক পান এবং কলকাতায় অভিষেক হয়।

এরপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজও খেলেন। কিন্তু একটাও ফিফটি পাননি এই দুই সিরিজে। ফলে বাদ পড়েন দল থেকে। আর নিজেকে স্থায়ী করেন ২০০৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের জন্য দলে ডাক পেয়ে। কেপ টাউনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪৯ রানের ইনিংস খেলে কেবল নিজেকে চেনালেন, তাই নয়; হারতে বসা ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকাকে ড্র করিয়ে দিলেন।

এরপর টেস্টে অন্তত আর আমলাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছিল লিমিটেড ওভার ক্রিকেটে। বারবারই বলা হচ্ছিল, আমলা ঠিক লিমিটেড ওভারের ‘ম্যাটার’ নন। তার ব্যাটিংটা এই মারকাটারি যুগের সাথে যায় না।

২০০৮ সালে ওয়ানডে অভিষেক হলেও শরীর থেকে তাই ‘টেস্ট প্লেয়ার’ তকমাটা যাচ্ছিল না। এরপর এলো ২০১০ সাল; ২০১০ সালের ভারত সফর।

এই এক সফর আমলার ব্যাটিং, টেকনিক, সৌন্দর্য এবং অল ফরম্যাট খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃতি এনে দিলো। এই বছরটাকে বলা যায় ক্রিকেট ইতিহাসের কোনো ব্যাটসম্যানের বৃহত্তম রূপান্তরের বছর।

২০১০ সালের আগে আমলা রান করতেন না, তা নয়। অনেক রান করতেন। কিন্তু সেই রানটা করতেন নিতান্তই নিরস একটা ভঙ্গিতে। তার ব্যাটিংয়ে দর্শনীয় কোনো ব্যাপার ছিল না। এই মৌসুমের আগে আমলা ব্যাটিং নিয়ে কাজ করলেন। মূলত ওয়ানডে ব্যাটিং নিয়ে কাজ করলেন। তারপর ভারত সফরে যখন মাঠে নামলেন, আবিষ্কার করা গেলো একেবারে নতুন ব্র্যান্ডের এক হাশিম আমলা।

এই আমলা চোখ ধাঁধানো গ্লান্স করছেন, ফ্লিক করছেন, কাভার থেকে মন জুড়িয়ে দেওয়া ড্রাইভ করছেন। দেখে হতভম্ব সবাই। সেই হতভম্ব কুলের একজন আরিফুল ইসলাম রনি স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন, ‘এই রূপান্তরটা বিষ্ময়কর ছিল। ব্যাটসম্যান তার ব্যাটিং নিয়ে কাজ করে টেকনিক উন্নত করতে পারে, অনেক রান করার ক্ষমতা বাড়াতে পারে। কিন্তু কেউ তার ব্যাটিং সৌন্দর্য বদলে ফেলতে পারে, এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ব্যাটিং সৌন্দর্যটাকে জন্মগত বলেই মনে করা হত। কিন্তু আমলা এই ধারণাটা বদলে দিয়েছেন। তিনি ক্যারিয়ারের ওই পর্যায়ে এসে নতুন করে বিউটিফুল হয়ে উঠেছেন।’

এর ফল এলো হাতেনাতে।

সেই ভারত সফর তো আমলার জন্য ইতিহাস। টেস্টে ও ওয়ানডেতে রান বন্যা বইয়ে দিলেন। সেই বছরে একই সাথে টেস্টে ও ওয়ানডেতে এক হাজারের ওপরে করে রান করলেন। এই শুরু হলো আমলার রেকর্ডের পেছনে ছোটা।

দ্রুততম ব্যাটসম্যান হিসেবে ২, ৩, ৪, ৫ হাজার ওয়ানডে রানের মালিক হলেন আমলা। তখন তাকে আর কে আটকায়।

ভারত সফরে, নাগপুরেই ২৫৩ রানের অপরাজিত ইনিংস খেললেন। এই ভারত সফরে আমলাকে ব্যর্থ করার জন্য এমন কোনো চেষ্টা নেই যে, করা হয়নি। কিন্তু নির্বিকার আমলা সব সামলে নিলেন। এরপর ওভালে ২০১২ সালে প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি করলেন। প্রায় ১৩ ঘন্টা তার সেই ব্যাটিং প্রদর্শনী ছিল একাধারে এক ক্লাসিক বিনোদন এবং শিক্ষাসফর।

২০১১ সালে প্রথম শর্টার ফরম্যাটে, পরে টেস্টেও অধিনায়কত্ব করেছেন। অধিনায়ক হিসেবে খুব বড় কোনো অর্জন নেই। ২০১৫ সালে আবার অধিনায়কত্ব নিয়েছিলেন। পরের বছরই সেটা ছেড়ে দেন। ততোদিনে ব্যাটসম্যান হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছেন।

এই হলো ব্যাটিং গ্রেট আমলার গল্প। এতে কী আপনি হাশিম আমলাকে চিনতে পারলেন?

না, পারলেন না। কারণ, ব্যাটিংটা আমলা বিশাল জীবন দর্শনের তুলনায় ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। আমলা হলেন সেই মানুষ, যিনি ধর্মে নিষেধ বলে জার্সিতে কোনো মাদকের লোগো ছোঁয়াতে দেন না; সে জন্য বোর্ডকে ক্ষতিপূরণ দেন। আমলা হলেন সেই মানুষ, যাকে ডিন জোন্স ‘সন্ত্রাসী’ বলে গালি দিলেও তিনি ক্ষমা করে দেন।

আমলা হলেন সেই মানুষ, যার কাছে জীবনটা স্রেফ সমর্পনের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link