১৯৯৯ সাল। বছর তেরোর ছোট্ট ছেলেটা মায়ের কোলে নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে লখনৌয়ের স্পোর্টস হোস্টেলের বাসিন্দা। হোস্টেলটিতে ক্রিকেট থেকে শুরু করে অ্যাথলেটিক্সসহ সকল প্রকার খেলাধুলার শিক্ষানবীশকে খুঁজে এনে রাখা হত। শুরু থেকেই ছেলেটার ক্রিকেটীয় স্কিল কোচেদের নজর কেড়েছিল। আর এটাই অ্যাথলেটিক্স বিভাগের ছেলেদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নাম তাঁর সুরেশ রায়না – নাম তো সুনা হি হোগা!
একদিকে ছেলেটার ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি পরার এক বুক স্বপ্ন অপরদিকে অ্যাথলেটিক্স বিভাগের ছেলেদের স্বপ্ন সীমাবদ্ধ ছিল খেলার দৌলতে ভারতীয় রেলে একটা চাকরি জোটানোতেই।
স্বপ্নের আসমান – জমিন ফারাক থেকে জন্ম নেওয়া ঈর্ষা খুদে সুরেশ রায়নার উপর নিয়মিতভাবে মানসিক এবং এমনকি শারীরিক নিগ্রহ রূপে আছড়ে পড়তো। ছেলেটা বাঁধা দিতে গেলে প্রতিবাদের মাশুল আরও কয়েকগুণ বেড়ে যেত। এইভাবে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে তলিয়ে যেতে থাকা ছেলেটা এমনকি বার কয়েক আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিল।
ঠিক এমনই এক অন্ধকার কঠিন সময়ে আচমকা একটা আলোর সোনালী রেখা দেখা দিল এয়ার ইন্ডিয়ার হয়ে খেলার জন্য ক্রিকেট নগরী মুম্বাই থেকে ডাক এল। রায়না যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ভারতীয় ক্রিকেটের মক্কার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো।
মুম্বাই গিয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ কোচ প্রবীন আম্রের সাহচর্য পেয়ে ছেলেটা হারিয়ে যাওয়া মনোবল ফিরে পেল। সৌভাগ্যক্রমে, বিমান সংস্থাটি সেই রায়নার জন্য মাসিক দশ হাজার টাকার স্কলারশিপের বন্দোবস্ত করল। উত্তর প্রদেশের বাড়িতে মাসে আট হাজার টাকা করে পাঠানো শুরু করল। ফলে খুবই হিসাব করে ছেলেটা মুম্বাইয়ে স্ট্রাগল করতে লাগল।
এমনকি সে সময় এসটিডি কলের ক্ষেত্রে মিনিট পিছু চার টাকা মূল্য থাকায়, পরিবারের লোকেদের সাথে ঠিক দু মিনিট কথা বলেই কল কেটে দিত। কৈশোর থেকেই এই অমানুষিক মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক লড়াইটাই যে পরবর্তীতে ছেলেটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনে যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দাঁতে দাঁত চেপে শেষ পর্যন্ত লড়ে জয় ছিনিয়ে আনতে শিখিয়েছে সেটা সুরেশ রায়নার কথাতেই স্পষ্ট – ‘ওই সব কিছুই আমাকে অর্থের অর্থ বুঝতে শিখিয়েছিল।’
আসলে, দেশের জার্সিতে যেকোনো পরিস্থিতিতে ব্যাট হাতে হোক বা বল হাতে বা শরীর ছুঁড়ে প্রায় অসম্ভব ক্যাচ লুফে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সুরেশ রায়নার মুখে লেগে থাকা ভুবন ভোলানো হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা লড়াইটা তার মুখে প্রকাশ না পেলেও ব্যাটে, বলে, ফিল্ডিংয়ে বারেবারে ধারাবাহিকভাবে প্রায় দেড় দশক ধরে দেশের জার্সিতে প্রকাশ পেয়েছে।