২০১৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। এই দিনেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে সেবারের বিশ্বকাপের ‘প্রথম’ দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিল স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড। অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে দুই চিরচেনা ট্রান্স তাসমান প্রতিবেশীর লড়াইটা রূপ নিয়েছিল এক রূদ্ধশ্বাস লো স্কোরিং থ্রিলারে।
টস জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৩২.২ ওভারে মাত্র ১৫১ রানেই থেমে যায় অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস। ব্যাটিং সহায়ক পিচেও বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটিং লাইনআপে ধস নামান বাঁহাতি পেসার ট্রেন্ট বোল্ট। মাত্র ২৭ রান খরচায় তুলে নিয়েছিলেন অজি ইনিংসের মহামুল্যবান পাঁচটি উইকেট।
অজিদেরকে অল্প রানে বেধে রাখতে বোল্টের পাশাপাশি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন টিম সাউদি আর ড্যানিয়েল ভেট্টোরি। কিছুটা খরুচে বোলিং করা সাউদি ৯ ওভারে ৬৫ রান দিয়ে দুই উইকেট পেলেও সমান সংখ্যক উইকেট সংগ্রহে ১০ ওভারের স্পেলে অভিজ্ঞ ভেট্টোরি খরচ করেছিলেন মাত্র ৪১ রান।
তবে ইনিংসের শুরুতে দুই ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার আর অ্যারন ফিঞ্চের ৩০ রানের উদ্বোধনী জুটি বড় সংগ্রহেরই ইঙ্গিত দিয়েছিল। ব্যক্তিগত ১৪ রানের মাথায় ফিঞ্চ সাউদির বলে বোল্ড হয়ে ফিরে গেলে ক্রিজে আসেন শেন ওয়াটসন। ওয়ার্নার-ওয়াট্টোর ৫০ রানের জুটিটা দেখেও মনে হচ্ছিল অনেক দূর যাবে অজিদের ইনিংস।
১৩ তম ওভারের শেষ বলে ওয়াটসনকে (২৩) সাউদির ক্যাচ বানিয়ে ক্রমশ বিপজ্জনক হতে থাকা জুটি ভাঙেন ড্যানিয়েল ভেট্টোরি। নেক্সট ওভারের প্রথম বলেই লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে বাঁহাতি ওয়ার্নারকে (৩০) বিদায় করেন সাউদি। কিছুক্ষণ পর মাত্র ৪ রান করা স্টিভেন স্মিথ ভেট্টোরির দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হলে ৯৫/৪ স্কোর নিয়ে কিছুটা চাপের মুখে পড়ে যায় অজিরা।
এরপর দ্বিতীয় স্পেলে বল করতে এসেই রীতিমত ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠেন বোল্ট। প্রথম স্পেলে ৫ ওভার বল করে বিনা উইকেটে ২৪ রান দেয়া এই বাঁহাতি সুইং বোলার দ্বিতীয় স্পেলে এসে প্রথমেই ক্লিন বোল্ড করে ফিরিয়ে দেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে (১)।
এরপর খালি হাতে ফিরিয়ে দেন মিচেল মার্শকেও (০)। তিনিও হয়েছিলেন সরাসরি বোল্ড। বোল্টের পরের দুই ওভারে একে একে ফিরে যান ইনজুরির কারণে আগের ম্যাচগুলোতে বিশ্রামে থাকা অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক (১২), মিচেল জনসন (১) এবং মিচেল স্টার্ক (০)।
সাউদি, ভেট্টোরি আর বোল্টের সম্মিলিত শিকারে ৯ ওভারে মাত্র ২৬ রানের ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়া হারিয়েছিল ৮ উইকেট! বোল্টের দ্বিতীয় স্পেলের ফিগারটা ছিল দেখার মত, ৫-৩-৩-৫!
তবে এরপরই শুরু হয় অজিদের শেষ উইকেট জুটির প্রতিরোধ। উইকেটরক্ষক ব্র্যাড হ্যাডিন আর প্যাট কামিন্স মিলে শেষ উইকেট জুটিতে ৪৫ রান যোগ করে দলের স্কোরটাকে নিয়ে যান দেড়শ’র ওপর। বাঁহাতি পেসার কোরি অ্যান্ডারসনের একমাত্র শিকারে পরিণত হবার আগে হাডিন খেলেন ৪ বাউন্ডারি ও ২ ছক্কায় ৪১ বলে ৪৩ রানের দারুণ এক ইনিংস। তাঁকে যোগ্য সঙ্গ দেয়া কামিন্স অপরাজিত ছিলেন ৭ রানে।
জয়ের জন্য টার্গেট মাত্র ১৫২ রান। জবাব দিতে নেমে শুরুতেই ওপেনার মার্টিন গাপটিলকে (১১) হারালেও অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ঝড়ো ফিফটিতে মাত্র ৭.২ ওভারেই ৭৮ রান তুলে নেয় নিউজিল্যান্ড! ‘ম্যাককালাম’ নামের প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়টা সবচেয়ে বেশি গিয়েছিল বাঁহাতি পেসার মিচেল জনসনের ওপর দিয়ে। পুরো ইনিংসে উইকেটশূন্য থাকা জনসনের ৬ ওভার থেকে ৬৮ রান নিয়েছিল কিউইরা যার বেশিরভাগই ছিল ম্যাককালামের কৃতিত্ব।
কামিন্সের পেসে স্টার্কের হাতে ধরা পড়ার আগে ৭ চার এবং ৩ ছয়ে সাজানো ২৪ বলে ৫০ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস খেলে জয়ের ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছিলেন ম্যাককালাম। অস্ট্রেলিয়ার জন্য ক্রমেই প্রতিকূল হতে থাকা পরিস্থিতিকে অনুকূলে আনতেই কিনা দৃশ্যপটে আগমন ঘটে মিচেল স্টার্কের। তরুণ এই বাঁহাতি পেসারের জোড়া আঘাতেই নিষ্প্রাণ ম্যাচ যেন হঠাৎ প্রাণ ফিরে পায়। পর পর দুই বলে দারুণ দুটি ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কারে রস টেলর (১) ও গ্রান্ট এলিয়টের (০) স্টাম্প উপড়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়াকে দারুণভাবে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন স্টার্ক।
পঞ্চম উইকেটে উইলিয়ামসন-অ্যান্ডারসনের ৫২ রানের পার্টনারশিপের সুবাদে ২০তম ওভারে ব্ল্যাক ক্যাপসদের স্কোর দাঁড়ায় ৪ উইকেটে ১৩১। ম্যাক্সওয়েলের বলে ব্যক্তিগত ২৬ রানে অ্যান্ডারসন ফিরে গেলেও ৫ উইকেট হাতে নিয়ে নিউজিল্যান্ডের জয়টা নিশ্চিতই ছিল। কিন্তু তখনও যে ম্যাচের নাটকীয়তার অনেকটাই বাকি! কেননা নিজের সেরাটা যে তখনো জমিয়েই রেখেছিলেন মিচেল স্টার্ক!
কিউইদের জয়ের পথে কাঁটা বিছিয়ে দিতে আরও একবার জ্বলে উঠলেন এই বাঁহাতি স্পিডস্টার। ফ্লাট পিচে গতির ঝড় তোলা স্টার্কের ভয়ংকর রুদ্রমূর্তির সামনে মাত্র ৭ রানের ব্যবধানে রনকি (৭), মিলনে (০) আর সাউদির (০) বিদায়ে নাটকীয়ভাবে ম্যাচে ফিরে আসে অস্ট্রেলিয়া। অপরপ্রান্তে কামিন্সের আঘাতে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন ‘দু:সময়ের কান্ডারী’ হিসেবে সুপরিচিত ড্যানিয়েল ভেট্টোরিও (২)।
১৪৬ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে কিউই শিবিরে তখন চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। জয়ের জন্য ২৭ ওভারে মাত্র ৭ রান লাগলেও হাতে উইকেট যে মোটে একটাই বাকি ছিল! এই অবস্থা থেকে যে কেউই জিততে পারত ম্যাচটা।
১৩১ থেকে ১৪৬ — মাত্র ১৫ রান এবং ১৯ বলের ব্যবধানে কিউইরা হারায় ৫ উইকেট! এমন ভয়াবহ ব্যাটিং কলাপ্সের পরও একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন কেন উইলিয়ামসন। শেষ পর্যন্ত আর কোন বিপর্যয় ঘটতে দেন নি তিনি। তীরে এসে তরী ডোবার হাত থেকে দলকে উদ্ধার করে তবেই মাঠ ছাড়েন তিনি। ৪২ বলে অপরাজিত ৪৫ রানের ‘ম্যাচ উইনিং’ নক খেলা উইলিয়ামসন ম্যাচ শেষ করেন ডানহাতি পেসার কামিন্সের মাথার উপর দিয়ে বিশাল এক ছক্কা হাঁকিয়ে।
আগুন ঝরানো পেস বোলিংয়ে ৯ ওভারের স্পেলে মাত্র ২৮ রান দিয়ে স্টার্ক তুলে নেন ছয়টি উইকেট। যার মধ্যে চারটিই ছিল ক্লিন বোল্ড! গতি, সুইং, ইয়র্কার আর বাউন্সারের বুদ্ধিদীপ্ত মিশেলে স্টার্ক দেখিয়েছিলেন ক্লাসিক ফাস্ট বোলিংয়ের এক অনুপম প্রদর্শনী! তবে ১ উইকেট কম নিয়েও শেষ হাসিটা হেসেছিলেন ট্রেন্ট বোল্ট! হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা।