স্কুলে পড়াকালীন জীবনে ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ডের মধ্যে থাকতে না পেরে এক অদ্ভুত শূন্যতা ভেতরে কাজ করত। কেন জানি না মনে হত, এটা জীবন নয়। হতেই পারে না। যেখানে তাবড় তাবড় কুশলীদের ভীড়ে নিজেকে পোডিয়ামে দেখতে পাচ্ছি না, মায়ের বকুনি আর পরীক্ষার খাতায় প্রণাম যার কিছুই ঠিক করতে পারছে না সে আবার কীসের জীবন!
এই চালচিত্র থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছে অনেকটা। ততদিনে স্কুল শেষ, কলেজ শুরুর দিকে। যারা পড়তে আসছে তাদের বেশিরভাগই সমুদ্রের অথৈতে পড়ে কুল হারাচ্ছে। এই একান্তে জীবনের প্রথম পর্যায়ের শেষে মনে হল আরেকটু বাঁচলে ভাল হয়।
এখানেই জীবন শেষ নয়। পড়াশোনা থাকবে, আছে। কিন্তু জীবনের কোনও কোনও মূহূর্ত হয়তো আসবে না। তাই জীবনকে নিয়ে খুব একচোট বেঁচে নিতে হবে। সে যেভাবেই পারি। মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাঁচতে হবে। ডায়াবেটিসের ওষুধের আগে একপ্লেট মটন বিরিয়ানি সাঁটাতে হবে, বুক ধড়ফড় করার আগে স্কুবা ডাইভিং করতে হবে, মাথা ঘুরে পড়ার আগে স্লাইডিং ট্যাকলটা করতে হবে। গিভ আপ করার সময় এখনও আসেনি, আসবে না।
খুব মনে পড়ে, আমাদের হালিশহরে একসময় প্রচুর শেয়াল ডাকত। সে অনেক ছোটবেলার কথা। এখন আর ডাকে না। তেমন কিছুই হয়তো নয় কিন্তু এটুকু ডাক শুনেই যে কচি বয়সের বাড়ন্ত মনে রোমাঞ্চ জাগত, ওইটাই জীবন – দ্য লাইফ!
যে সময় আমরা বাড়ছি, সে সময় জিদান-রোনাল্ডোরা অবসর নিয়েছে আর তার জায়গায় বিশ্বত্রাস হয়ে ফুটবল মঞ্চে হানা দিচ্ছে স্পেন। প্রত্যেকটা পজিশনে শ্রেষ্ঠ ফুটবলাররা পা ফেলছে। ঠিক এইসময় চুপিসাড়ে দিনেমো জাগ্রেব থেকে টটেনহ্যামে যোগ দিচ্ছে লুকা মদ্রিচ।
কী আছে কপালে অদৃষ্ট জানেন, অতএব পারফরমেন্স দাও সবার আগে। যেমন ভাবা তেমন কাজের ‘ক’ও ফোটেনি, ওদিকে রিয়ালে কাকার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখেই ওজিলকে কেনার পর কী অমোঘ কারণে টটেনহ্যামের মদ্রিচের দিকে হাত বাড়াল রিয়াল। শোরগোল পড়ে গেল! যে প্লেয়ার সাপ্লাই লাইনের উপযুক্তই নয় তাকে কিনছে মাদ্রিদ! সমর্থকদের বুলি পড়ল – The worst signing of Real in this season!
ঠিখ যেখানে A পয়েন্ট থেকে B পয়েন্টে ট্র্যাভার্স শেষ, সেখান থেকেই আসে B থেকে A-তে ট্র্যাভার্সের গল্প। সবাই কনজারভেশন ফোর্সের কাজ জানি। জীবনটাও তাই। পৃথিবীতে কারোর বুকে আগুন জ্বালাতে নেই। কারণ জল তোমার কাছে সবসময় নাও থাকতে পারে। এই পৃথিবীর তিনভাগ জল হলেও, নাও থাকতে পারে। তখন সেই আগুনকে নেভানোর কোনও পন্থা তোমার জানা নেই। হেয় করা যত সহজ, যত সহজে ব্যান্ডেট করে দেওয়া যায় একজনকে পুরোটা না জেনে, তার সাফল্য দেখতে পাওয়াটা তার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি কঠিন। বলা ভাল, পৃথিবীর কঠিনতম কাজ!
কিন্তু মদ্রিচ তো এসবের জন্য আসেননি। আমরা ভাবি এসব প্রতিবাদ-বদলার কথা। মদ্রিচ না এসেছে প্রথম-দ্বিতীয় হতে, না এসেছে তাকে নিয়ে করার অজস্র মজার প্রতিবাদ করতে, না এসেছে নিজেকে অদ্বিতীয় প্রমাণ করতে। মদ্রিচ সেসব অন্তঃসারশূন্য আলোচনায় থাকেনই না। এই বিরাট দুনিয়ার এককোণে ঘাপটি মারা শিল্পীগুলোকে মদ্রিচ নিজের কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছে গোটা ইউরোপ জুড়ে।
কখনও তা ক্রোয়েশিয়ার হয়ে আউস্টেপে সেতার বাজিয়ে গোল করছে, কখনও মাদ্রিদের গালিচায় মাখন লাগানো পাউরুটি সাজিয়ে দিচ্ছে সতীর্থের মুখের একদম নিকটে! মদ্রিচ সূর্যাস্তের আলোয় হেঁটে যাওয়া পথিকের মতো পথ খুঁজে ফিরছে সেই আদি-অনন্তকাল থেকে। পথেঘাটে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে যায় এক মুখ দাড়িওয়ালা, মুখে বিড়ির ধোঁয়া ওড়ানো পাগলদের।
খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে একদিস্তে না ছাপা কবিতারা অবহেলায় পড়ে আছে চটের ব্যাগের মাঝে। কেউ যাদের খেতে দেয়নি অনেকদিন। সেই কবিতাদের ব্যাগ থেকে বার করে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে পড়েন মদ্রিচ। কখন যে কোন পংক্তিতে ভেসে ওঠে আমার হারিয়ে যাওয়া সেই মরীচিকার দিশা। কারণ? Giving up is not an option