দেনাগামাগে প্রবোধ মাহেলা ডি সিলভা জয়বর্ধনে নিজের ব্যাটিং জীবনে একটি প্রহেলিকা ছিলেন, অন্তত আমার কাছে। এমন কী তাঁর পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই টেস্ট গড়ও আমাকে বিশ্বাস করাতে পারেনি যে তিনি তাঁর প্রতিভার প্রতি সম্পূর্ণ সুবিচার করতে পেরেছেন। শুনেছিলাম, সুরজিৎ সেনগুপ্ত যখন ফুটবল মাঠে নামতেন, তাঁর বরফ-শীতল মস্তিষ্কটি নামিয়ে আনতেন পায়ে।
থিঙ্কিং প্লেয়ার। মাহেলা ছিলেন ঠিক তাই। ফুল-ফ্লোতে বয়ে চলা (হ্যাঁ, বয়েই যেতেন, এতই মসৃণ ছিল তাঁর ব্যাটিং) মাহেলার ব্যাটিং দেখে মনে হত, তাঁর ব্যাটের আলাদা চিন্তাশক্তি রয়েছে। ইন্টেলিজেন্স! ফিল্ডিংয়ের নতুন-নতুন ফাঁকফোকর কোথায় তৈরি হচ্ছে, বোলারের মনের মধ্যে কী চলতে পারে— এসব আগে থেকেই যেন ওই উইলো-খণ্ডের অদৃশ্য রাডারে ধরা পড়ত।
সুরিয়াকুমারের উইকেটের চতুর্দিকে খেলা শট, বিশেষ করে বলের গতিকে তারই বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মুন্সিয়ানা দেখে যাঁরা হতবাক হয়ে যাচ্ছি, তাঁদের একবার চট করে ২০১১-র বিশ্বকাপ ফাইনালে মাহেলার ইনিংসটি মনে করে নেওয়ার অনুরোধ জানাই। শক্তির বিস্ফোরণে হয়তো সমতুল নয়, কিন্তু নিপুণ-অভিজ্ঞ শল্য-চিকিৎসকের মতো ফিল্ডিংয়ের জাল চিরে-চিরে ব্যবচ্ছেদ করার যে ঐশ্বরিক ক্ষমতা, তার সর্বোত্তম নিদর্শন দেখতে পাবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
আজকে আমরা যারা সূর্য কুমার যাদবের অতিমানবীয় ব্যাটিং বিস্ফোরণ দেখতে দেখতে চেয়ারের হাতল চেপে ধরছি, নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছি, তাঁর কব্জির নমনীয়তা এবং শক্তি দেখে বিস্ফারিত হয়ে যাচ্ছে চোখ, আসুন, তাঁরা একটা ছোট্ট ধন্যবাদ জানিয়ে রাখি এই ভদ্রলোককে।
ঘরোয়া ক্রিকেটে ৪০-এর আশেপাশের পথচারী মার্কা গড়, মেজাজ হারানো নিয়ে সমস্যা, অফ-স্টাম্পে শট খেলার অপেক্ষাকৃত দুর্বলতা এসব নিয়ে সূর্য কুমার যাদব নামের সম্ভাবনাময় নক্ষত্রটি যখন মাঝপথেই উল্কার মতো জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়ার পথে, সে সময়ই মাহেলা জয়বর্ধনের স্পর্শ লাগে তাঁর ক্যারিয়ারে।
জয়াবর্ধনে সূর্যকে ব্যাটিং শেখাননি; সেভেন্থ স্টাম্প থেকে ইয়র্কার-লেংথের বলকে ডিপ-স্কোয়ার লেগের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার ঔদ্ধত্য কেউ কাউকে শেখাতে পারে না। কিন্তু শ্রেষ্ঠতম গুরু ছাত্রকে উদ্বুদ্ধ করেন, নতুন-নতুন উড়ান দেওয়ার সাহস ভরে দেন তার ডানায়! বলেন, ‘ব্যাটিং অর্ডারের ওপরে উঠে এসো। দায়িত্ব নাও, পালন কর।’
জয়াবর্ধনে ঠিক সেই কাজটিই করেছেন, মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের এই ব্যাটারটির জন্য। আজকে, আমরা যাঁরা সূর্যকুমার যাদবকে দেখে শিহরিত হচ্ছি, বিস্ফারিত হচ্ছি, হতবাক হচ্ছি— আসুন, সেই সঙ্গে ধন্যবাদ জানাই, শ্রদ্ধাবনত হই ভদ্র, বুদ্ধিমান এবং কম কথার এই মানুষটির প্রতিও। থ্যাঙ্কিউ মাহেলা জয়াবর্ধনে!