ম্যারাডোনা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় কীসের জন্য? ‘হ্যান্ড অব গড’ নাকি ‘গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি’? কত বিতর্ক, কত রেকর্ড, তবু ম্যারাডোনা ম্যারাডোনাই থাকেন। কেউ চিনে তাকে ফুটবল ঈশ্বর নামে, কেউ বা চেনে ন্যাপোলির ত্রাতারূপে। বল পায়ে কত রেকর্ড গড়েছেন, বল ছেড়েও কীনা সেই একইরূপে ছিলেন তিনি। যেমন পায়ে তেমন মুখে। তাকে ন ইয়ে শেহশ ছিল না উদ্দীপনার। এই ম্যারডোনাকে ঠিক কতটুকু চেনেন আপনি? ম্যারাডোনাকে নিয়ে অজানা ফ্যাক্টগুলো নিয়ে আজকের লেখা।
ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনার জন্ম ১৯৬০ সালের ৩০শে অক্টোবর, আর্জেন্টিনার রাজধানী বুইনোস এইরেসের লেনুসের পিলক্লিনিক এভিতা হাসপাতালে।
ম্যারাডোনারা ছিলেন ৭ ভাই বোন। ৪ মেয়ে পর প্রথম ছেলে সন্তান হিসেবে পৃথিবীতে আগমন ম্যারাডোনার। এরপর আরো দুইটি ছোট ভাই হয় তার। তিন ভাই-ই পা রেখেছিলেন প্রফেশনাল ফুটবলে।
ডিয়েগোর প্রফেশনাল ফুটবলে অভিষেক হয় ১৫ বছর বয়সে। দিনটি ছিল বুধবার, অক্টোবর ২০, ১৯৭৬।
তার প্রথম দল ছিল আর্জেন্টিনা জুনিয়র্স। সেখানের ইয়ুথ দল থেকে উঠে এসে প্রথম ৫ বছর সেখানেই খেলেন ম্যারাডোনা।
৭৮ বিশ্বকাপে দলে নেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করেই ম্যারাডোনাকে জাতীয় দলে অভিষিক্ত করেন তৎকালীন কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ সালে ১৬ বছর বয়সেই আর্জেন্টিনার হয়ে অভিষিক্ত হন ম্যারাডোনা।
যদিও ১৯৭৮ বিশ্বকাপ থেকে সিজার মেনোত্তি তাকে বাদ দেন বয়স কমের অজুহাতে।
সিজার মেনোত্তিকে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় বাঁধা মনে করেন ম্যারাডোনা। তাকে নিয়ে সরাসরিই বলতেন, ‘আমি কখনোই মেনোত্তিকে ক্ষমা করবো না।’
আর্জেন্টিনার জার্সিতে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পান ম্যারাডোনা ১৯৭৯ সালে। জাপানে অনুষ্ঠিত ইয়ুথ ওয়ার্ল্ড কাপ জিতে আর্জেন্টিনা। সে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতাও ছিলেন ম্যারাডোনা।
আর্জেন্টিনার জার্সিতে ৯১ ম্যাচে ম্যারাডোনার মোট গোলসংখ্যা ৩৪।
আকাশি-সাদা জার্সিতে মোট ৩ বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছেন তিনি। যার মধ্যে জিতেছেন একটি, রানার্স-আপ একবার আর অন্যবার বিশ্বকাপের মাঝ থেকেই বিদায় বলতে হয়েছে নিষিদ্ধ ড্রাগস গ্রহণের জন্য।
বিশ্বকাপে আকাশি-সাদা জার্সিতে মোট ২১ বার মাঠে নেমেছেন ডিয়েগো।
অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ১৬টি ম্যাচ খেলার রেকর্ড তার।
আর্জেন্টিনার জার্সিতে পঞ্চম সর্বোচ্চ গোলদাতা ম্যারাডোনা। লিওনেল মেসি, গাব্রিয়েল বাতিস্ততা, সার্জিও আগুয়েরো ও হার্নান ক্রেস্পোর পরেই তার জায়গা।
এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশিবার ফাউলড হওয়ার রেকর্ডও ম্যারাডনার। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে মোট ৫৬ বার ফাউলের স্বীকার হয়েছেন ম্যারাডোনা।
বিশ্বকাপের এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি ফাউলড হওয়ার রেকর্ডও ম্যারাডোনার। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ইতালির বিপক্ষে মোট ২৩ বার ফাউলড হওয়ার রেকর্ড তার।
১৯৮৬ সালে বিতর্কিত গোল করে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘এটা শুধু একটা জাতীয় দলকে হারাইনি, বরং একটি দেশকে হারিয়েছি। এই জয়ের আনন্দ পুরো ইংল্যান্ডকে সমান আনন্দ।’
১৯৯০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন কোচকে ম্যাচের আগে একাদশ ঘোষণা করতে বললে কার্লোস বিলার্দো বলেন, ‘ম্যারাডোনা ও ১০ জন।’
১৯৯৪ বিশ্বকাপ থেকে নিষিদ্ধ হওয়ার পর আর্জেন্টিনা থেকে অবসরের ঘোষণা দেন ম্যারাডোনা।
আর্জেন্টাইন ফেডারেশন থেকে আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর জার্সি একেবারের জন্য রিটায়ারমেন্টে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়েছিল ফিফার কাছে। ফিফা তা এক বাক্যে না করে দিয়েছিল।
ক্লাব ক্যারিয়ারে মোয় ৫ টি দলের হয়ে খেলেছেন ডিয়েগো ম্যারডোনা। ট্রফি জিতেছেন মোট ৯ টি।
ক্লাব কম্পিটিশনে ম্যারাডোনার গোল অ্যাভারেজ ০.৫২৬। অর্থাৎ প্রতি দুই ম্যাচে এক গোল করেছেন ম্যারাডোনা।
আর্জেন্টাইন জুনিয়র্স, ম্যারাডোনার প্রথম ক্লাবের স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। স্টেডিয়ামের পুরো নাম, স্তেডিও ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা।
প্রথম বার্সেলোনা খেলোয়াড় হিসেবে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে স্ট্যান্ডিং ওভেশন পেয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা।
ইতিহাসের সর্বপ্রথম খেলোয়াড় হিসেবে দুইবার রেকর্ড ট্রান্সফার ফি ভেঙ্গেছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। একবার বোকা জুনিয়র্স থেকে বার্সেলোনা যাওয়ার সময়ে (৫ মিলিয়ন পাউন্ড) অন্যবার বার্সেলোনা থেকে নাপোলি যাওয়ার সময় (৭ মিলিয়ন পাউন্ড)
নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নাপোলিকে সিরি ‘এ’ জয়ের স্বাদ দেন ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা। মোট ৭ বছরে জিতিয়েছেন ৫ শিরোপা।
ন্যাপোলিতে ব্রুনো গার্দিয়ানো, ম্যারাডোনা আর ক্যারেসা ত্রয়ীকে একত্রে বলা হলো ম্যা-জি-কা কিংবা ম্যাজিক।
ম্যারাডোনাকে ১৯৯১ সালে নাপোলি ছাড়তে হয় ড্রাগ টেস্টে দোষী প্রমাণিত হয়ে। ততদিনে ইয়িনি হয়ে উঠেছেন ন্যাপোলির ঈশ্বর।
২০০৯ সালে ইতালিয়ান অফিসিয়ালরা দাবি করে যে তারা ম্যারাডোনার কাছে ৩৭ মিলিয়ন ইউরো পায়। যার অর্ধেকের বেশিই এসেছে পাওনা টাকার সুদ থেকে।
আর্জেন্টাইন-বেসড কোনেক্স ফাউন্ডেশন তাকে ১৯৯০ সালে ‘ডায়মন্ড কোনেক্স অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত করে। যা স্পোর্টসপার্সন হিসেবে প্রথম।
২০০৫ সালে ম্যারাডোনাকে বোকা জুনিয়র্সের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়েছিল। একবছর পর সে পদ থেকে অব্যাহতি নেন ম্যারাডোনা।
২০০০ সালে ফিফা গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় হিসেবে যৌথভাবে পেলে ও ম্যারাডোনার নাম ঘোষণা করে।
২০০৫ সালে ম্যারাডোনা আর্জেন্টাইন একটি টিভি চ্যানেলে টক-শো শুরু করেন। আর সেখানে প্রথম অতিথি ছিলেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী পেলে।
২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ম্যারাডোনাকে আমন্ত্রণ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ওই পেলের হাঁটাহাঁটি দেখতে আর্জেন্টিনা থেকে জার্মানি যাবো না।’
২০০৮ সালের অক্টোবরে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের দায়িত্ব নেন ম্যারাডোনা।
আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে ফলাফলও এসেছে তার কোচিঙ্গয়ের সময়েই। বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে বলিভিয়ার বিপক্ষে ৬-১ গোলে হারার তেতো স্বাদ গ্রহণ করেন ম্যারাডোনা।
ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী পেলের সঙ্গে বাগযুদ্ধের একপর্যায়ে আর্জেন্টিনার চাকরি থেকে বরখাস্ত করার পর পেলে বলেছিলেন, ‘আসলে দোষটা ম্যারাডোনার নয়, বরং তাকে যারা চাকরিতে নিযুক্ত করেছে তাদের। কোন বোকা ম্যারাডোনাকে চাকরি দেয়?”
ম্যারাডোনা তার উত্তরে বলেছিলেন, ‘পেলের বয়স হয়েছে। তাকে উচিত যাদুঘরে রেখে আসা।’
বিশ্বে ম্যারাডোনার নামে একটি ধর্মও রয়েছে। এই ধর্মের অনুসারী আনুমানিক প্রায় দেড় থেকে দুই লক্ষ।
১৯৯৮ সালে ম্যারাডোনার নামে এই ধর্মপ্রচার শুরু হয়। ম্যারাডোনার জন্মদিনকে তারা বছরের শুরু ধরে উপাসনা করে। তাদের ধর্মমত অনুযায়ী এখন 60 A.D (After Diego)।
ম্যারাডোনা মতো দেখতে একটি পাপেট শো রয়েছে ফ্রান্সে। যার নাম ‘লেস গুইনলো দে লিনফো’।
স্কটিশ ফ্যানগ্রুপ ‘দ্যা টার্টান আর্মি’ ম্যারাডোনার উদ্দেশ্যে একটি গান রচনা করে শুধুমাত্র প্রতিবেশী ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দেওয়ার জন্য।
ম্যারাডোনার সম্মানে অ্যাজটেক স্টেডিয়াম, যে মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘হ্যান্ড অব গড’ ও ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ করেছিলেন, একটি স্ট্যাচু তৈরি করা আছে। প্রবেশপথেই তা চোখে পরবে আপনার।
সার্বিয়ান ফিল্মমেকার এমির কুস্তুরিকা ম্যারাডোনাকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেন, যা ২০০৮ কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল।
২০১৯ সালে ম্যারাডোনাকে নিয়ে আরেকটি বায়োপিক ‘ম্যারাডোনা’ বের করেন আসিফ কাপাদিয়া।
ম্যারাডোনা ছিলেন তীব্র ইমপেরিয়ালিজম বিরোধী ও বামধারার রাজনীতির সমর্থক।
কিউবার সাবেক রাস্ট্রপতি ফিদেল ক্যাস্ট্রো ছিলেন তার অন্যতম বড় ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী। ম্যারাডোনার কাছে কাস্ট্রো ছিলেন আইডল।
ম্যারাডোনার বাম হাতে চে গুয়েভারার ও ডান পায়ে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ট্যাটু রয়েছে।
আইডল ফিদেল কাস্ট্রোর মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে তিনি কোচিং ছেড়েই চলে এসেছিলেন কিউবায়। শেষবারের মতন তাঁর মৃতদেহ ছুঁয়ে দেখতে।
২০০০ সালে তার লেখা আত্মজীবনী ‘Yo Soy El Diego’, অর্থাৎ ‘আমি ডিয়েগো’ প্রকাশ করেন ম্যারাডোনা।
নিজের আত্মজীবনী থেকে পাওয়া রয়্যালিটির একটি বড় অংশ কিউবান জনগনের জন্য দান করে যান তিনি।
২০১৩ সালে ভেনিজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্টে হুগো চ্যাভেজের মৃতদেহ সামনে রেখে বলেছিলেন, ‘এই সংগ্রাম সফল হোক।’
১৯৯৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘আমি মাদকসেবী ছিলাম, আছি, এমনকি আজীবন থাকবো। যে একবার মাদকের রাস্তায় পা বাড়ায়, তাকে আজীবন এই পথে থেকেই এর বিপক্ষে যুদ্ধ করতে হয়।’
১৯৮৬ বিশ্বকাপ শেষে ইংলিশ ম্যানেজার স্যার ববি রবসন বলেছিলেন, ‘ম্যারাডনা দলে থাকলে আর্সেনালও বিশ্বকাপ জিততে পারবে।’
ফ্রাঙ্কো বারেসি আর পাওলো মালদিনির মতে ম্যারাডোনা তাদের বিপরীতে খেলা সেরা খেলোয়াড়।
২০১৫ সালে আলি বিন নাসেরের বাড়ি গিয়ে তাকে তার জার্সি উপহার দিয়ে আসেন ম্যারাডোনা। যিনি ছিলেন ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ইংল্যান্ড বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচের রেফারি।
ম্যারাডোনার জীবনে প্রথম ভালোবাসা ছিলেন ক্লাউদিয়া ভিলাফেন। ৭ নভেম্বর ১৯৮৯ সালে বুইনোস এইরেসে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ম্যারাডোনা। ২০০৪ সালে এই জুটির ছাড়াছাড়ি হয়।
ম্যারাডোনা বৈধভাবে দুই সন্তান ডামলা ও জিয়ান্নিনার পিতা। বাকি বাকি যারা নিজেদের দাবি করেছেন, তাদের তিনি আখ্যা দিয়েছেন ‘আমার পয়সা আর ভুলের মাশুল’ হিসেবে।
১৯৮৬ থেকে ২০০০ এর মধ্যে জন্ম নেওয়া আর্জেন্টিনার প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ শিশুর নাম ডিয়েগো। এমনকি ব্রাজিলেও ২০ ভাগ শিশুর নাম রাখা হয়েছিল ডিয়েগো অথবা আর্মান্ডো।
অবশেষে ৬০ বছর বয়সে ২০২০ সালের ২৫ নম্ভেম্বর না ফেরার দেশে চলে গেলেন সর্বকালের সেরা আর্জেন্টাইন ফুটবলার ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা।