ঠিক আমারই মত…

ট্যাঙ্গো হলো ছোট পাস। ডিয়েগো বুয়েনস আয়ার্স। কেউ বলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নাৎসিদের কেউ কেউ পালিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। কেউ বলে ইহুদীরা ওখান থেকেই শুরু করে নব পথচলা। আমরা শুনেছি কালো মানুষের আর্তচিৎকার ও ক্যানভাস থেকে সরে যাওয়ার আর্জেন্টিনা। আমরা দেখেছি ফকল্যান্ড যুদ্ধ।

ফকল্যাণ্ড যুদ্ধের পর, মানুষ ধারণাটির সাথে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ অথচ সমার্থক শব্দ, যুদ্ধ, তার পর – ফকল্যান্ড যুদ্ধের পর আমরা জেনেছি, ম্যারাডোনা।

আবার ধরুন ন্যাপলস। বলা হয় পৃথিবীতে ৬০০০ এর মত ধর্ম আছে বা ছিল। ন্যাপলস নগরের বেশ কাছাকাছি রোম বা ভ্যাটিক্যান হলেও, লোকে সেখানে ক্রুশ গলায় ঝোলালেও, অন্ধ কোনো প্রকোষ্ঠে কেউ লুসিফারের চরণে সপ্তম বর্ষীয় বালকের  মুণ্ডু কর্তন করে রক্ত ছড়িয়ে দিলেও, ন্যাপলসের ঈশ্বর একজনই।

এবারে আমরা বুঝতে শুরু করছি ধর্ম ও যুদ্ধের ইতিহাস। বিশুদ্ধ স্যাক্সন পিটার শিলটন ঝাড়া ছ ফুটের অধিক লম্বা। এবারে আমরা শুনছি ভ্রাতৃহত্যার কথা ভুলতে না পেরে পৃথিবীতে জন্মায় দ্য হ্যান্ড অফ গড! নৈতিকতার পাঠে যা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, তাই জন্ম দিল ধরিত্রীর বুকে এক ঈশ্বরের। বোধকরি, সে থেকেই আমরা নতুন করে দুশ্চরিত্র জিউসের অন্য চেহারা আবিষ্কার করতে শুরু করি। ঈশ্বরতত্ব ততোটাই সুন্দর, যতোটা সে হয়ে উঠতে পারে মানবীয়।

বলছিলাম, ট্যাঙ্গো হলো ছোট পাস। উপরে নীচে নামা। দ্রুত ও ধীরলয়ে। যেন আলাপ থেকে তানের দিকে যাওয়া। যেন কানের লতি ছুয়ে চুম্বনের পালা শেষ হলে তিরতির করে কম্পিত তলপেটের আন্দোলন। সে থেকেই তো এলো, টোটাল ফুটবল। কেউ ভিন্ন নয়, কেউ রাজা কেউ প্রজা নয়, মহামতী ক্রুইফ জানালেন, ঈশ্বর একজনই হয়, আমরা হবো সকলে সমান। সকলে মিলে প্রতিরোধ, সকলে মিলে অর্জন।

সে ঈশ্বর এসেছিলেন কাতালোনিয়াতেও। রক্ত দিয়ে লেখা ইতিহাসের কাতালোনিয়া। বলছিলাম ঈশ্বরতত্বের মানবীয় হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে অমরত্বের দিকে যাবার গাথা। বলছিলাম, নেপলস শহরের ঈশ্বরের কথা। বলছিলাম, বুয়েনস এইরেসে কালো মানুষের রক্তের ইতিহাসের পরও ইতিহাস রচিত হয়েছে  বস্তিতে-রাস্তায় – কাগজের বল পায়ে ঈশ্বরের জন্ম হয় – বুয়েনস আয়ার্স সেদিন হয়ে ওঠে ফুটবলের বেথেলহেম, জন্মান ঈশ্বরের পুত্র নন, স্বয়ং ঈশ্বর, ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা।

তারপর যদি ঝট করে আপনার কাঁধ চেপে ধরে টেনে নিয়ে আসি বছর ত্রিশেক আগের হাভানায়। ধরুন কখনও ড্রাগ বা গুটখা না চিবোলেও একটা চুরুট ধরাবার সাধ আপনার গেলো না! ধরুন আমি বলছি, যদি বলি মেনে নেবেন তো মশাই? যদি বলি, আজকে ফিদেলেরও প্রয়ানদিবস? কী বিচিত্র এইসব কাকতাল!

আমার ভালো লাগে মিঠে সারসের মত, বা ভাদ্রের কুকুরের মত বা মোহাম্মদ আলী বা জর্জ বেস্ট বা ভিভ রিচার্ডস বা ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনার মতন একটা পৃথিবী। ভায়োলিনের মত যেখানে শ্রমিকেরা কাজ যায়, আসে। কমরেড ফিদেল, যেখানে অজর মানুষের মুখ হয়ে গোটা নর্দান প্যাসিফিক ফ্লিটের সামনে দন্ডায়মান। যেখানে ইউএস মার্শালের ছোট মেয়ে ঘুমোয় এই নির্ভরতায়, হাওয়াইয়ে ম্যারাডোনা আসতে পারলে, একদিন ফিদেলও আসবেন।

অপদার্থ এসব ভাবনা, ভাবনার পাখনা বড় বেয়াড়া, এসবে নাইবা পাত্তা দিই – তারচেয়ে আসুন, আমরা ফিরে যাই সেই সময়রেখায়, যেখানে একজন ছোটখাট মানুষ এসে বললন, এভাবেই  কেন? কেন ওভাবে নয়? পৃথিবী বা আর যে কোনোখানের মানুষ যতদিন প্রশ্ন করবে, উন্মাদ কবি রুদ্র শহীদুল্লাহ বা খ্যাপা নজরুল ইসলাম বা সাহেবদের অস্বস্তি চার্লস বুকোস্কিকে দেখে চমকাবে, জানি ঈশ্বরকে খারিজ করে দেয়া লোকটিও, ততোদিন, ঈশ্বরেরই অস্তিত্বে অস্বীকার করতে পারবেন না।

হ্যাঁ, আমরা ঈশ্বরকে দেখেছি চর্মচোক্ষে। যিনি ঠিক আমাদের মত৷ যেন কোনো দেবতা। ঠিক তেমনি তিনি। যদিও নেপলস ও বুয়েনস আয়ার্সের, তবুও যেন আরও ব্যাপৃত সে নাম, তাঁর নাম – ম্যারাডোনা।

লোকে বলতেই পারে, এ থরোথরো ন্যাকা ফুটবল পাগল বাঙালির আবেগের অতিশোয়াক্তি। আমি বলি, হ্যা, ঠিক ধরেছেন মশাই। আমি ভেতো বাঙালি। আবেগ ও প্রতিভার সাথে বেশ খানিকটা অসচেতনতার মিশেলে – আমার ঈশ্বরও তো আমার মতোই হবেন, নাকি? আমার প্রার্থনাও। শৈশব ও বার্ধক্যের মাঝে সুতো, ঠিক আমার মত, তিনি আমার ম্যারাডোনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link