ফিলিস্তিনি ক্রিকেট স্বপ্ন

বোনরা তাঁকে ‘টমবয়’ বলে ডাকে। মরিয়ম ওমর সেসব নিয়ে খুব বেশি তোয়াক্কা করেন না। তিনি তাঁর বোনদের মত সারাদিন রুপচর্চা, ফ্যাশন নিয়ে ব্যস্ত সেখানে মরিয়ম ব্যস্ত তাঁর পছন্দের খেলা নিয়ে। তিনি যে ক্রিকেট খেলতে ভালবাসেন। তবে আর বাকিদের মত একেবারে ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেনি তাঁর।

মরিয়ম একজন ফিলিস্তিনি। তবে তাঁর বেড়ে ওঠা মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ কুয়েতে। সেখানেই প্রথম তাঁর পরিচয় ঘটে ক্রিকেটের সাথে। জীবনের প্রথম ১৭ বছর তিনি জানতেনই যে ক্রিকেট বলতেও একধরণের খেলার অস্তিত্ব রয়েছে। কুয়েত আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর একটি। তাই ক্রিকেটের খুব বেশি প্রচলন সেখানে ছিলনা এক যুগ আগে। সুতরাং একজন স্কুল পড়ুয়া কিশোরির জানার কথাও নয়।

তবে ছেলেবেলা থেকেই মরিয়ম আরও বিভিন্ন খেলাধুলার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি নিয়ম করে বাস্কেটবল খেলতেন, মার্শাক আর্ট অনুশীলন করতেন, আরও কত কি। ঠিক মুক্ত কোন এক পাখি। তবে বাবার কড়া নির্দেশ ছিল, পড়ালেখায় দেওয়া যাবে না ফাঁকি। তাই তিনি সাম্যতা বজায়ের চেষ্টা করে যান। বেশ ভালই কাটছিল তাঁর কৈশর।

তবে হঠাৎ করেই ক্রিকেট নামক খেলাটার সাথে পরিচয় হয় তাঁর। অনূর্ধ্ব-১৯ নারী এশিয়া কাপের জন্য দল ঘটন করতে কুয়েত ক্রিকেট বোর্ড একটা প্রচারণা চালায় কুয়েতের সব স্কুলগুলোতে। মরিয়ম তখন এক পাকিস্তানি স্কুলের ছাত্রী। সে স্কুলেই স্বাভাবিকভাবেই কুয়েত ক্রিকেট বোর্ডের নজর পড়ে। যেহেতু পাকিস্তানের জাতীয় খেলা ক্রিকেট, সুতরাং একটু হলেও ক্রিকেট সম্পর্কে ধারণা ছিল সেখানকার শিক্ষার্থীদের।

তবে সে ধারণা ছিল একদমই ভুল। খোদ মরিয়মও জানতেন না যে ক্রিকেট খেলাটা আসলে কি। তিনি দেখতেন যে ছেলেরা হাত ঘুরিয়ে কিছু একটার প্রতিচ্ছবি আঁকার চেষ্টা করে। সেটা আর কিছুই নয়,বোলিং করার ‘স্যাডো প্র্যাকটিস’। তবে যেহেতু নানা ধরণের খেলাধুলার সাথে মরিয়মের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তাই তাঁর মা উদ্বুদ্ধ করেন তাঁকে ক্রিকেটটাও একটি বার খেলে দেখতে।

তবে ক্রিকেটে আসার আগে থেকেই মরিয়ম হিজাব পরিধান করতেন। তিনি স্বেচ্ছায় হিজাব পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ক্রিকেটে এসেও নিজের সে হিজাব পরিধানের সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি তিনি। বরং সে হিজাব পড়েই তিনি দিব্যি ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন। এখন অবধি কুয়েতে হয়ে প্রায় ডজনের বেশি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন মরিয়ম।

অথচ প্রথম দুই বছর তিনি ক্রিকেটের ব্যাকরণ সম্পর্কে ছিলেন একেবারেই অজ্ঞ। তিনি ক্রিকেটের কিছু না বুঝেই খেলে যেতেন। দারুণ অ্যাথলেট হওয়ার সুবাদে তিনি ভাল ফিল্ডিং করতে পারতেন। তিনি তাঁর ধরা প্রতিটা ক্যাচ নিজের নেওয়া উইকেটের মত করেই উদযাপন করতেন। হিজাবের কারণে যাতে ফিল্ডিংয়ে কোন সমস্যা না হয় সে জন্যে তিনি শক্ত করে হিজাব পরিধান করতেন।

হিজাব কখনোই ক্রিকেট এবং তাঁর মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তিনি বরং ধীরে ধীরে ক্রিকেটকে ভালবাসতে শুরু করেছিলেন। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি ক্রিকেটেই মনোনিবেশ করবেন। তাইতো উচ্চতর ডিগ্রি আর ক্রিকেটের তালিম নিতে তিনি গিয়ে হাজির হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়াতে। বাবার নির্দেশে পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন। আর নিজের পছন্দে ক্রিকেট অনুশীলন করেছেন নিয়ম করে।

তবে নিজেকে ক্রিকেটে পুরোপুরি সপে দিতে পারছেন না ২৯ বছর বয়সী এই ব্যাটিং অলরাউন্ডার। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার একটি কম্পানিতে চাকরি করার পাশাপাশি কুয়েত নারী দলের হয়ে ক্রিকেট খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছেন মরিয়ম। তিনি রীতিমত ক্রিকেটের জন্যে লড়াই করে যাচ্ছেন। তিনি নিজেকে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করে যেতে চাইছেন।

তিনি যেন বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর মেয়েদেরকে দেখিয়ে দিতে চাইছেন হিজাবের মধ্যে থেকেও ক্রিকেট খেলা যায়। তিনি বিশ্বের মেয়েদের এই দীক্ষাটা দিচ্ছেন যে কাজের ফাঁকেও নিজের সখ, নিজের প্যাশনকে অনুসরণ করা যায়। তিনি একজন ‘রোল মডেল’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link