জেমি ডে তাহলে টিকে যাচ্ছেন!

বাংলাদেশের ফুটবলে অনেক নতুনের মিশেল ঘটিয়ে কোচ হিসেবে নিজের যাত্রাটা শুরু করেছিলেন জেমি ডে। এই ইংলিশম্যানকে শুরুতে অনেকেরই পছন্দ হয়নি। কারণ বাংলাদেশে যারা কোচ হিসেবে বিগতদিনে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে ছুটিতে বছরের বেশিরভাগ সময়ে দেশে থাকার একটা প্রতিযোগিতা চলত। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) জাতীয় দল ব্যবস্থাপনা কমিটি কোচকে কাজ দিতে না পারায় তারা একে অপরের সাথে ছুটি নিয়ে একরকম খেলায় মেতে উঠত।

বেশিরভাগ কোচকেই দেখা গেছে দেশি কারো সহায়তা নিয়ে কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের আগে দল ঘোষণা করে দিতেন। ফুটবলাররা ক্যাম্প শুরু করার পর কোচের দেখা মিলত সবার শেষে। বর্তমানেও এর ব্যতিক্রম খুব একটা দেখা যাচ্ছেনা। তবুও দেশের ফুটবলের উন্নতি সাধারণের চোঁখে পড়ছে। সেটি ফুটবলবোদ্ধারাও অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন। জেমি ডে কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিবর্তন কিছুটা হলেও হয়েছে।

একজন কোচ মাঠে গিয়ে খেলে দিয়ে আসতে পারেন না। কিন্তু খেলোয়াড়দের মধ্যে জয়ের স্পৃহা তৈরি করার পাশাপাশি মাঠের বাইরে থেকে যতটা সম্ভব উজ্জীবিত করাই থাকে তাদের কাজ। সেই কাজে জেমি দারুণ সিদ্বহস্ত। কিন্তু মাঝে মধ্যেই প্রশ্ন উঠে কোচের মান নিয়ে। গত বছর তো ইংল্যান্ডে বসে নিজের চাকুরি চলে যাবার মতো অনেক খবরই পেয়েছেন। পেশাদার কোচ হিসেবে এসব নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে দেখা যায় না তাঁকে।

কারণ, বাংলাদেশের জাতীয় দলের কোচদের শুরু ও শেষটা থাকে পুরোপুরি উল্টো। শুরুতে ডাক-ঢোল পিটিয়ে কোচকে বরণ করে নেওয়া হলেও শেষটা হয়ছে তিক্ততায় ভরা। শিরোপা জিতিয়ে তার ঠিক পরপরই চলে যাবার মতো ঘটনাও কম নয়। এই যেমন ২০১০ সালে বাংলাদেশের মাটিতে বসে এসএ (সাউথ এশিয়ান) গেমসের খেলা। ফুটবলে অনুর্ধ্ব-২৩ দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জোরান দর্দেভিচকে। আফগানিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জিতলেও তার বিদায়টা হয়েছে বেশ নাটকীয়ভাবে। কোন প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বিদায় নিতে হয়েছে। যদিও সারা দুনিয়ায় এভাবে অনেক দেশে কোচকে বিদায় করে দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে।

তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ফিফা পর্যন্ত নালিশ করার রেকর্ডও কম নয়। শুধু কি জাতীয় দল, ক্লাব দলের কোচকেও এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। পরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জরিমানা দিয়ে মুক্তি পেতে হয়েছে। যদিও গত বছর দ্বিতীয় মেয়াদে দুই বছরের জন্য চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে জেমি। কিন্তু একজন পেশাদার কোচ হিসেবে যে কোন সময় চাকরি চলে যাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। জেমিও সেটি জানেন।

কারণ, স্পেশাল ওয়ান হিসেবে পরিচিত হোসে মরিনহোও লিগের মাঝপথে চাকরি হারিয়েছেন। সর্বশেষ লিগে কোন শিরোপা জিততে না পারলেও গত কয়েক বছরে রিয়াল মাদ্রিদকে স্বরণীয় সাফল্য এনে দিয়েছিলেন জিনেদিন জিদান। এবার তার বিদায়টাও হয়েছে তিক্ততার মাধ্যমে। নিজে খোলা চিঠি লিখে চলে যাওয়ার বিষয়টা খোলাসা করেছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কোন পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। তবে বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বের শেষ তিনটি ম্যাচের একটি খেলে ফেলেছে বাংলাদেশ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে পিছিয়ে থেকেও ১-১ গোলে ড্র করে এক পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়তে পেরেছে জামাল ভুইয়ার দল। আপাতত এটাই জেমি ও বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির খবর।

কিন্তু জেমি কি স্বস্তি পাচ্ছেন? কারণ সামনের দুটি ম্যাচে ভারত ও ওমানকে মোকাবেলা করতে হবে। ম্যাচ দুটি যে সহজে জিতে যাবে বাংলাদেশ এমন ভাবনা করা অনেকটাই অমূলক। কিন্তু কোচ হিসেবে কিছুটা হলেও ক্যারিশমা দেখিয়েছেন জেমি ডে। নয়তো দেশে একমাত্র শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের মতো দলের বিপক্ষে একটিমাত্র প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে বাছাইপর্বের মতো এতটা কঠিন জায়গায় খেলাটা যে আরও কঠিন।

শীষ্যদেরকে নিয়ে সেই কাজটিই দারুণভাবে প্রথম ম্যাচে করেছেন জেমি। এক পয়েন্ট পাওয়ার পর নিজের উপর কোন কৃতিত্ব না দিয়ে সব খেলোয়াড়দের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি ঝুকি নিয়েও সফর হয়েছেন। দ্বিতীয়ার্ধে ১-০ গোলে পিছিয়ে থেকে বাংরাদেশ কোচ ঝুকি নিয়েছেন বলে মনে করেন আফগানিস্তান কোচ আনোস দস্তগীর। ৪৭ মিনিটে গোল হজমের পর বাংলাদেশ রক্ষনাত্বক খোলস ছেড়ে আক্রমনাত্বক খেলতে থাকে। যার ফলস্বরুপ একাধিক আক্রমন তৈরি করে। তা থেকেই ৮৪ মিনিটে তপু বর্মনের দারুণ এক গোলে পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়তে পেরেছিল বাংলাদেশ। পেছন থেকে যে সবকিছু নিয়ন্ত্রন করেছেন কোচ জেমি।

কোচের এই টেকনিক্যাল পরিবর্তনই বাংলাদেশকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনে। বিষয়টি স্বীকার করে আফগান কোচ বলেন, ’আমরা এক গোল করে যখন আরেকটি গোল করে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম ঠিক সে সময়ই বাংলাদেশ আমাদের উপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে। গোল আদায় করে নিলেও আমাদের লক্ষ্য ছিল ম্যাচটা জেতা। কিন্তু দুই দলের শক্তি সমান না থাকলেও মাঝে মধ্যে পয়েন্ট হারাতে হয়, এই ম্যাচ বাংলাদেশ সেটাই করে দেখিয়েছে।’

২০১৮ সালে কোচ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর কোচ জেমি’র প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল প্রাক বাছাই থেকে মূল পর্বে জায়গা করে নেওয়া। লাওসকে হারিয়ে সেই জায়গাটা করে নেওয়ার আগে খেলোয়াড়দের খাদ্যাভাসে দারুণ পরিবর্তন আনে। মেদ ঝেড়ে ফেলতে খাদ্যতালিকা থেকে ভাতের পাশাপাশি বাদ দেওয়া হয় সব ধরনের তেল।

খেলোয়াড়দের ফিট করে তুলতে যা দারুণ কাজে দিয়েছে। সে কারণে এখন পুরো ৯০ মিনিট একই তালে খেলতে পারে বাংলাদেশ। সাফল্য পেতে হয়তো আরও সময় লাগতে পারে। তবে পরিবর্তন যা তার বেশিরভাগই জেমি ডে’র আমলে। এ যাত্রা টিকে গেছেন কিনা সেটি জানতে হলে আরো কিছুটা সময়ের অপেক্ষা করতে হবে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমী দর্শকদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link