শতকের রুদ্ধদ্বার খুলেছিলেন তিনি

অপির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা আরও লম্বা হতে পারতো। হয়নি, বিতর্কে জড়িয়ে নিষিদ্ধ হওয়ায়। সেটা ২০০৩ সালের কথা। কর্পোরেট লিগে টাকার বিনিময়ে অংশ নেন, আবার প্রতিপক্ষ প্রতিষ্ঠানের সাথেও চুক্তিবদ্ধ হন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নেয়নি। তাই, সব রকম ক্রিকেটে তাঁর অংশগ্রহণ এক বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থা কাটিয়ে আবারও ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরলেও আর আন্তর্জাতিকে ফেরা হয়নি তাঁর।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকা করলে হয়তো তিনি সেরা দশেও থাকবেন না। ওপেনার হিসেবে হয়তো সেরা পাঁচেও থাকবেন না। তবে, কোনো ভাবেই তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস লেখাও যাবে না। টেস্ট কিংবা ওয়ানডে – দুই ফরম্যাটেই তিনি বাংলাদেশের হয়ে এমন কিছু কীর্তির মালিক, যা আসলে কখনোই ভাঙবে না।

বলছি মেহরাব হোসেন অপির কথা। এক কালে বাংলাদেশ দলের মারকুটে ওপেনার ছিলেন। তার ব্যাপারে সবচেয়ে পরিচিত রেকর্ডটি হল তিনিই বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান। সেটা ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চের ঘটনা। ত্রিদেশীয় সিরিজের ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ১১৬ বল খেলে করেছিলেন ১০১ রান। ম্যাচটা বাংলাদেশ তিন উইকেটে হেরেছিল বটে, কিন্তু অপির নামটা চলে গিয়েছিল ইতিহাসের পাতায়।

তখন অপির বয়স মাত্র ২০ বছর। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের একদম গোড়ায় বড় ক্রিকেটার হওয়ার সব রকম সম্ভাবনাই তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ক্যারিয়ারের প্রথম সাত ওয়ানডেতেই একটি সেঞ্চুরি ও দু’টি হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন। গড় ছিল ৩৯-এর ওপরে। এই পরিসংখ্যানে তৎকালীন বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে খুবই বিরল। অথচ, মাত্র ১৮ টি ওয়ানডেতেই থেমে যায় অপির ক্যারিয়ার। বাকি ১১ টি ওয়ানডেতে আর বলার মত কোন স্কোর গড়তে পারেননি তিনি।

মজার ব্যাপার হল, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম আন্তর্জাতিক হাফ সেঞ্চুরি মালিক হলেন তারই চাচা আজহার হোসেন। ১৯৯০ সালের ২৮ এপ্রিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শারজাহতে তিনি এই কীর্তি গড়েছিলেন।

আরেকটি কীর্তির সাথে জড়িয়ে আছে অপির নাম। বাংলাদেশ যখন ২০০০ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মত টেস্ট খেলতে নামে, সেদিন  ভারতের বিপক্ষে প্রথম রানটি এসেছিল তাঁরই ব্যাট থেকে। যদিও সেদিন ছয় রানের বেশি করতে পারেননি অপি।

অপির জন্ম ১৯৭৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। অমিত সম্ভাবনাময় এই ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বয়স কেবলই চার বছর – ১৯৯৯ থেকে ২০০৩। এই সময়ে ১৮ টি ওয়ানডে ছাড়াও নয়টি টেস্ট খেলেছিলেন তিনি।  টেস্টে ৭১ রানের একটা ইনিংস ছিল তাঁর। সেটা তিনি ২০০১ সালে করেছিলে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, হারারেতে।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে মানে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপে অপিই ছিলেন ওপেনার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৬৪ ও সেবারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪২ রান করেছিলেন। ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে সেই ইনিংসটা ছিল বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি।

যদিও, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার আগেই অপির নামটা ক্রিকেট বিশ্বের কাছে পরিচিত ছিল। কারণ তাঁর সাথে জড়িয়ে আছে ঢাকায় ক্লাব ক্রিকেটের ম্যাচ চলাকালে পাওয়া চোট থেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ভারতীয় ক্রিকেটার রমন লাম্বার নাম।

সেদিনটা ছিল ১৯৯৮ সালের ২০ ডিসেম্বর। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে চলছিল আবাহনী-মোহামেডান লড়াই।  ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীর হয়ে ফিল্ডিং করছিলেন রমন লাম্বা। প্রতিপক্ষ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান। মোহামেডানের হয়ে ব্যাট করছিলেন জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার মেহরাব হোসেন অপি।

হেলমেট ছাড়াই শর্টে ব্যাটসম্যানের খুব কাছাকাছি ফিল্ডিং করতে দাঁড়িয়েছিলেন লাম্বা। উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো আবাহনীর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট হেলমেট পরার জন্য লাম্বাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। লাম্বা সে কথায় কান দেননি।

বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিয়ান মেহরাব সজোরে ব্যাট চালালে বল এসে আঘাত করে লাম্বার মাথায়। তখন নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে ছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বুলবুল রমন লাম্বাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি ঠিক আছ?’।

রমন লাম্বা কৌতুক করে বলেন, ‘বুলি ম্যায় তো মার গ্যায়া ইয়ার’। সঙ্গে সঙ্গেই মাঠ থেকে বেরিয়ে যান তিনি। ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ ফেব্রুয়ারি মারা যান রমন লাম্বা। ৩৮ বছর বয়সেই জীবন নদীর ওপারে চলে যান তিনি।

ঘটনার শোক কাটিয়ে উঠতে অপিরও আড়াই মাসের মত সময় লেগেছিল। এরপর যখন ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচে শন অ্যাবটের বাউন্সারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ফিলিপ হিউজ, তখন সরব হয়েছিলেন অপি।

শন অ্যাবটের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘বন্ধু, তুমি বর্তমানে যেই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করছো, এক সময় আমিও এর মধ্য দিয়ে গিয়েছি। যাই ঘটুক না কেন, এটা দুর্ঘটনা। তোমার বর্তমান এই অবস্থায় পরিবার, বন্ধু, ক্রিকেট বোর্ডসহ পুরো ক্রিকেট বিশ্ব পাশে রয়েছে। আমরা সবাই চাই তুমি আবারও ক্রিকেটে ফিরে এসো। এটা তখনই সম্ভব হবে, যখন তুমি নিজে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকবে।’

অপির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা আরও লম্বা হতে পারতো। হয়নি, বিতর্কে জড়িয়ে নিষিদ্ধ হওয়ায়। সেটা ২০০৩ সালের কথা। কর্পোরেট লিগে টাকার বিনিময়ে অংশ নেন, আবার প্রতিপক্ষ প্রতিষ্ঠানের সাথেও চুক্তিবদ্ধ হন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নেয়নি। তাই, সব রকম ক্রিকেটে তাঁর অংশগ্রহণ এক বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থা কাটিয়ে আবারও ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরলেও আর আন্তর্জাতিকে ফেরা হয়নি তাঁর।

ফিরে পরবর্তীকালে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেটে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। এক রকম অবসরেই চলে গিয়েছিলেন। তবে, সবাইকে চমকে দিয়ে ২০১১ সালে তিনি আবারও ফিরেছিলেন। ঢাকা মেট্রোপলিসের হয়ে দু’টো প্রথম শ্রেণির ম্যাচও খেলেছিলেন।

এখানেই থামলে হত। কিন্তু থামেননি অপি। ২০১৪ সালে তিনি আবারও মাঠে নেমে পড়েন। এবার মোহামেডানের হয়ে একটা ম্যাচ খেলেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে। সেই ম্যাচে তিন রান করার পর আর প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলেননি তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেটে মেহরাব হোসেন অপির অধ্যায় এখানেই শেষ!

এখনও তাঁকে কখনো কখনো মাঠে দেখা যায়। সিনিয়রদের প্রদর্শনী ক্রিকেট, কিংবা লিজেন্ড ক্রিকেটে মাঠে নামেন। সেখানে যখন একের পর এক শট খেলেন – তখন তাতে যতটা না মুগ্ধতা থাকে তাঁর চেয়েও বেশি থাকে হতাশা!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...