কিউই বিপ্লবের নেতা

ক্রো ছিলেন একজন জাত নেতা। জন রাইটের শেষ দিকে এসে তাকে ভবিষ্যত অধিনায়ক হিসেবে ঘোষনা করা হয়। আর এরপর থেকে একটার পর একটা বৈপ্লবিক কাজ করেন তিনি। ১৯৯২ বিশ্বকাপে ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন কাজে লাগানোর জন্য পিঞ্চ হিটার ব্যবহার করা বা স্পিনার দিয়ে ইনিংস শুরু করানোর মত কাজ করিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ক্রো। এখানেই শেষ নয়, নব্বই দশকের ওই সময়ে ব্ল্যাক ক্যাপদের ব্যাটিংয়ের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।

মার্টিন ক্রোকে আপনি কেনো মনে রাখবেন?

এক সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান তরুষ ব্যাটসম্যান, নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান, নিউজিল্যান্ডের দুর্দান্ত অধিনায়ক, দারুণ ধারাভাষ্যকার, অসাধারণ বিশ্লেষক ও লেখক। কোন পরিচয়টা মনে রাখবেন? সম্ভবত এটা বলাই সবচেয়ে ভালো যে, তিনি ছিলেন ক্রিকেটে কিউই বিপ্লবের নেতা।

ক্রো ছিলেন একজন জাত নেতা। জন রাইটের শেষ দিকে এসে তাকে ভবিষ্যত অধিনায়ক হিসেবে ঘোষনা করা হয়। আর এরপর থেকে একটার পর একটা বৈপ্লবিক কাজ করেন তিনি। ১৯৯২ বিশ্বকাপে ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন কাজে লাগানোর জন্য পিঞ্চ হিটার ব্যবহার করা বা স্পিনার দিয়ে ইনিংস শুরু করানোর মত কাজ করিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ক্রো। এখানেই শেষ নয়, নব্বই দশকের ওই সময়ে ব্ল্যাক ক্যাপদের ব্যাটিংয়ের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।

মার্টিন ক্রো স্কুল জীবনে ক্রিকেটের পাশাপাশি রাগবি, টেনিস এবং গলফও খেলতেন। তবে তার শক্তির জায়গা ছিলো ক্রিকেট। নিউজিল্যান্ডে বয়সভিত্তিক দলে খেলার সময়ে নজর কাড়েন মার্টিন ক্রো।

১৯৭৯ সালে অকল্যান্ডের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে মার্টিন ক্রোর। প্রথম ম্যাচেই অকল্যান্ডের হয়ে আহফ সেঞ্চুরি করেন তিনি। এরপর লর্ডসে এমসিসি তরুন ক্রিকেটারদের বৃত্তি নিয়ে লর্ডসেও খেলেন তিনি। এর ফলে নিজেকে আরো ভালো ভাবে শাণিত করেন তিনি।

১৯৮২ সালে দূর্দান্ত পারফর্ম করে ১৯৮১-৮২ মৌসুমে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে জাতীয় দলে ডাক পান মার্টিন ক্রো। এই সিরিজেই ওয়ানডে এবং টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে মার্টিন ক্রোর।

কিন্তু দুই সংস্করণেই দলে নিজের প্রভাব রাখতে ব্যর্থ হন তিনি। দলে থাকা ওপেনার ব্রুস এডগার এবং জিওফ হাওয়ার্থ ভালো ফর্মে থাকার কারণে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি তিনি।

মার্টিন ক্রো তার ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি করেন ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে। ওয়েলিংটনে ক্রো এবং জেরেমি কোনেই এর সেঞ্চুরিতে ভর করে দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৩৭ রান করে নিউজিল্যান্ড। এর ফলে ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার ওয়েলিংটন টেস্ট ড্র হয়।

একই বছর কঠিন শ্রীলঙ্কা সফর শেষ করে কাউন্টি দল সামারসেটে যোগ দেন মার্টিন ক্রো। তিনি দলে আসেন ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান ভিভ রিচার্ডসের পরিবর্তে। জাতীয় দলের হয়ে খেলার জন্য সামারসেট ছেড়ে যান তিনি। দলে যোগ দেবার পর থেকেই খাদ্য বিষক্রিয়ায় ভুগছিলেন। এছাড়াও অদ্ভুত পরিবেশ, ঘরে ফেরার জন্য ব্যকুলতা এবং দুশ্চিন্তার কারণে সামারসেটের হয়ে ফর্মে ফিরতে পারছিলেন না। মে মাসে টানা পাঁচ ম্যাচে এক অঙ্কের ঘর পার করতে না পেরে দেশে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন।

কিন্তু এরপরই অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।

জুনে তিনি সামারসেটের হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করা শুরু করেন। মে মাসে করা বাজে পারফর্মেন্সকে পিছনে ফেলে জুনে দূর্দান্ত পারফর্ম করা শুরু করেন। ক্রিকেটীয় টেকনিক এবং স্কিলের ব্যবহার করে কাউন্টিতে টানা চার সেঞ্চুরিতে করেন ৭১৯ রান। এই সময়ে তার ব্যাটিং গড় ছিলো ১৪৩.৮। ক্রো মনে করেন লেচস্টারশায়ারের বিপক্ষে করা সেঞ্চুরি ছিলো তার সেরা ইনিংস।

দিনের শুরুতে ক্যারিবিয়ান পেসার অ্যান্ডি রবার্টসকে সামলাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো সামারসেটের ব্যাটসম্যানদের। এই সময়ে অকল্যান্ডের ব্যাটসম্যান মার্টিন ক্রো নিজের ব্যাটিং টেকনিক সামলে বেশ ভালোভাবে নিজেকে সামলেছেন অ্যান্ডি রবার্টসকে।

এই কঠিন উইকেটে সামারসেটের ব্যাটসম্যানরা মাত্র ১৫১ রান করেন, যার মধ্যে ৭০ রানই করেছিলেন মার্টিন ক্রো। এই ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে পিটার রোবাকের সাথে ৩১৯ রানের জুটি গড়েন। এর জুটির মাধ্যমে নটিংহামশায়ারের বিপক্ষে ৮৭ ওভারে ৩৪১ রানের লক্ষ্য তাড়া করে সামারসেট। এই জুটিতে ১৯০ রান করেছিলেন ক্রো।

১৯৮৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরেন মার্টিন ক্রো। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের কাউন্টি ক্রিকেটের ফর্ম টেনে নিয়ে আসেন। ব্রিসবেন টেস্টে রিচার্ড হ্যাডলির বোলিং তোপে ১৭৯ রানে গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস।

রিচার্ড হ্যাডলির বোলিং তোপের পর মার্টিন ক্রো এবং জন এফ রেইড তৃতীয় উইকেট জুটিতে ২২৪ রান যোগ করেন। এই ইনিংসে ক্রো ২৬ টি চারের মাধ্যমে ১৮৮ রানের ইনিংস খেলেন। আর এই দূর্দান্ত ইনিংসের জেরে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথমবারের মত অস্ট্রেলিয়াকে হারায় নিউজিল্যান্ড।

এছাড়াও তৃতীয় টেস্টে ৭১ এবং ৪১ রানের দুইটি ইনিংস নিউজিল্যান্ডকে টেস্ট জিততে সাহায্য করে। আর এই টেস্ট জয়ের মাধ্যমে দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট জয় করে নিউজিল্যান্ড। আর এই দূর্দান্ত পারফর্মেন্সের স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯৮৫ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন মার্টিন ক্রো।

হ্যামস্ট্রিং, পিঠ এবং অন্যান্য ইনজুরি থাকা সত্ত্বেও বেশ নিউজিল্যান্ডের হয়ে মনে রাখার মত অনেক পারফর্ম করেছেন। তার প্রিয় স্টেডিয়াম বেসিন রিজার্ভে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দূর্দান্ত সেঞ্চুরি করেন। এই সেঞ্চুরি করার পথে ম্যালকম মার্শালকে বেশ কয়েকটি হুক শট খেলেন মার্টিন ক্রো। এই শট খেলার সময়ও নিজের শটের উপর বেশ নিয়ন্ত্রণ ছিলো তার।

তার ক্রমাগত ইনজুরি তার ক্যারিয়ারকে ছোটো করে দেয়। ১৯৮৬ সালে কাউন্টি দল সামারসেট ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার ভিভ রিচার্ডস এবং জোয়েল গার্নারকে না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এই মৌসুমে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় মার্টিন ক্রো। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়া তার ব্যক্তিগত জীবন ক্যারিবিয়ান তারকাদের সাথে বিতর্কিত ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসে। এমন সময়ই, একটি ফ্রাকচার তাকে মাঠের বাইরে সরিয়ে দেয় এবং তার পরিবর্তে দলে নেওয়া হয় তরুন স্টিভ ওয়াহকে।

১৯৯১ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অ্যান্ড্রু জোন্সের সাথে ৪৬৭ রানের জুটি গড়ে তোলেন মার্টিন ক্রো। তিনি এই ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বোলিংকে তুলোধনা করে ছাড়েন। ৪৬৭ রানের এই রেকর্ড নিউজিল্যান্ডে ক্রিকেটে প্রায় ২২ বছর টিকে ছিলো। এই ম্যাচে মার্টিন ক্রোর সংগ্রহ ছিলো ২৯৯ রান। রিচার্ড হ্যাডলির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের কারণে চাপ বেড়ে গিয়েছিলো মার্টিন ক্রোর। অনেক ইনজুরি থাকা সত্ত্বেও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।

১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড দলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিলো মার্টিন ক্রোর। এই বিশ্বকাপেই তিনি উদ্ভাবনী অধিনায়কত্ব দিয়ে সবাইকে চমকে দেন। এমনকি ধারণা করা হয়েছিলো বিশ্বকাপ সম্ভবত ঘরে তুলবে নিউজিল্যান্ড। এই বিশ্বকাপে পিঞ্চ হিটার মার্ক গ্রেটব্যাচকে দিয়ে ওপেনিং করান। কারণ যাতে সে ১৫ ওভারে ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন অনেক ভালো ভাবে ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও বিশ্বকাপেই মাঝে মাঝে বোলিং শুরু করিয়েছিলেন স্পিনার দীপক প্যাটেলকে দিয়ে।

তার এই ট্যাকটিক্স বেশ ভালোভাবে কাজ করেছিলো। তিনি নিউজিল্যান্ডকে সেমি ফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। এই বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে ৪৫৬ রান করেন। সেমি ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯১ রানে ইনজুরির কারণে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন মার্টিন ক্রো। এরপর আর এই ম্যাচে মাঠে নামতে পারেননি তিনি। মাঠে তার পরিবর্তে কেউ ভালো ভাবে অধিনায়কত্ব করতে না পারায় সেমি ফাইনালে হেরে বিদায় নিতে হয় নিউজিল্যান্ডকে।

১৯৯৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে স্টাইলিশ সেঞ্চুরি করার পরও ক্রো আর ক্রিকেটে থাকতে পারেননি। কারণ ঘন ঘন ইনজুরি আক্রান্ত হওয়া এবং স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের মত তারকাদের উত্থানের কারণে আস্তে আস্তে সরে যেতে শুরু করেন তিনি। এছাড়াও শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাধায় আগের মত খেলতে পারছিলেন তিনি।

অবশেষে ১৯৯৫ সালে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের মাধ্যমে সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি। ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে ১৭ তম সেঞ্চুরি করেন মার্টিন ক্রো।

মার্টিন ক্রো নিউজিল্যান্ডের হয়ে ৭৭ টেস্টে ৫,৪৪৪ রান করেন। তিনি আরো দীর্ঘ সময় নিউজিল্যান্ডকে সাফল্যা এনে দিতে পারতেন। কিন্তু শরীর আর সায় না দেয়ায় সেটা করে উঠা সম্ভব হয়ে উঠেনি তার পক্ষে।

ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে বিদায় জানানোর পর ধারাভাষ্যকার , ক্রিকেট লেখক এবং কোচ হিসেবে কাজ করেছেন মার্টিন ক্রো। তিনি আইপিএলে কোচিং করিয়েছিলেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর। কিন্তু তার অধীনে ব্যাঙ্গালুরু ভালো খেলতে না পারায় চাকরি থেকে ছাটাই হন তিনি। এছাড়াও তিনি মার্টি গাপটিল, রস টেইলর এবং কেন উইলিয়ামসনের মেন্টর হিসেবেও কাজ করেছিলেন।

২০১২ সালে ৪৯ বছর বয়সী মার্টিন ক্রো টূইটারে ঘোষণা দেন তিনি ক্রিকেটে ফিরবেন। আর এর জন্য তিনি নিজের ফিটনেস নিয়ে কাজ করছেন। তিনি ২৫০ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ থেকে ৩ ম্যাচ এবং ২০ হাজার রান থেকে ৩৯২ রান পিছনে ছিলেন।

৪৯ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ফেরার জন্য গ্রেড ক্রিকেটেও খেলা শুরু করেছিলেন তিনি।

১৫ অক্টোবর,২০১২ সালে জানা যায় তিনি লিমফোমাই আক্রান্ত। তিনি জানান এটি তার ইমিউনিটি কমে যাওয়ায় তিনি লিম্ফোমায় আক্রান্ত হয়েছেন। মার্টিন ক্রো ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশক থেকেই শরীরে বিভিন্ন রোগ নিয়েই খেলে বেড়াচ্ছিলেন।

৫ জুন,২০১৩ তে জানা যায় তিনি ক্যান্সার থেকে সেরে উঠেছেন। ক্যান্সার থেকে সেরে উঠে তিনি জানান তিনি ক্রিকেটের সাথে সম্পর্ক ছেদ করবেন। আর এই সম্পর্ককে তিনি অ্যালকোহলের থেকেও মারাত্মক বলে আখ্যায়িত করেন। জানান, মাত্র ২২ বছর বয়স থেকে উচ্চাকাঙ্খার কারণে ক্রিকেটে এসেছেন। এখন ৫১ বছর বয়সে ক্রিকেটের সাথে সম্পর্ক ছেদ করে তার বেশ ভালো লাগছে।

প্রথমবার ক্যান্সার থেকে ছেড়ে উঠার পর ভাবা হয়েছিলো তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু ২০১৪ সালে আবারো ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। এই সময়ে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন  তার ১২ মাসের থেকে বেশি সময় বেচে থাকার সম্ভাবনা মাত্র ৫ শতাংশ। তিনি শেষ ইচ্ছা হিসেবে ২০১৫ সালে বিশ্বকাপ দেখতে চান। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের প্রায় এক বছর পর ৩ মার্চ, ২০১৬ তারিখে পরলোক গমন করেন এই কিংবদন্তি ক্রিকেটার।

একটা ভিন্নধর্মী তথ্য দিয়ে শেষ করি। অস্কারজয়ী অভিনেতা রাসেল ক্রো হলেন মার্টিন ক্রো, জেফ ক্রোদের চাচাতো ভাই।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...