দ্য গ্রেটেস্ট নাম্বার নাইন

সত্যিকথা বলতে, রোনালদো ছিলেন এমন এক ভয়ংকর স্ট্রাইকার যার নাম শুনলেই বিশ্বের কোটি কোটি নব্বইয়ের দশক জন্ম নেওয়া প্রতিটি ফুটবল অনুরাগীদের রক্তে নাচন ধরে। তাই সর্বকালের সেরা নাম্বার নাইনের তালিকায় তিনিই সেরা।

কুইজ কুইজ কুইজ।

ক্লাব ফুটবলে সবচেয়ে বড় দ্বৈরথ নি:সন্দেহে রিয়াল মাদ্রিদ বনাম বার্সেলোনা ক্লাসিকো। আচ্ছা, এবার বলুন তো, পৃথিবীর কয় জন ফুটবলার রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনা উভয় দলের হয়েই এল ক্লাসিকোতে?

আরেকটু সহজ করেই প্রশ্ন করি -পৃথিবীর কয়জন ফুটবলার এল ক্লাসিকোতে দুই দলের হয়ে এবং ইতালির মিলান ডার্বিতেও দুই দলের হয়েই গোল করেছেন?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর হয়তো কয়েক জনের নাম বলতে পারবেন। দুটো প্রশ্ন মেলালে একটি মাত্র নাম আসবে। আর তিনি হলেন রোনালদো ফেনোমেনন; রোনালদো লুইস নাজারিও দ্য লিমা! পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বকালের সেরা নাম্বার নাইন। অনেকের মতে, ফুটবলের সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকারও।

প্রায় ১৭ টি বছর প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে বোকা বানিয়ে একের পর এক গোল করে নিজেকে নিয়ে গেছেন ফুটবলের এক অনন্য উচ্চতায়। দু’টি বিশ্বকাপ, দু’টি কোপা আমেরিকা, দু’বার ব্যালন ডি’অর, তিন বার ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার পাওয়া রোনালদো নিজের ক্যারিয়ারে একমাত্র চ্যাম্পিয়নস লিগ ছাড়া সম্ভব্য সবই জিতেছেন।

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি। মেসিকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তাঁর চোখে সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার কে? কোনো চিন্তা না করেই বলে দেন-রোনালদো নাজারিও। সাথে আরো বলেন, ‘আমি তাঁর বিপক্ষে খেলতে পেরে ভাগ্যবান। আরো ভাগ্যবান এই জন্য যে আমি যখন খেলেছি তখন তিনি ইনজুরির কারণে তাঁর সেরা ফর্মে নেই। শুধু সেরা নাম্বার নাইন না, সর্বকালের সেরা তালিকায়ও উনি সামনের দিকেই থাকবেন।’

১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ সালে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেরিওর এক হত দরিদ্র দম্পতি বাবা নেলিও নাজারিও দি লিমা ও মা সোনিয়া দোস সান্তোস বারাতার ঘর আলো করে আসেন ফুটফুটে রোনালদো।

তার পরিবার এত দরিদ্র ছিল যে, জন্মের পর সন্তানের নাম রেজিষ্ট্রেশন করতে লিমার বাবা মায়ের দুইদিন অপেক্ষা করতে হয়। রোনালদোর বয়স যখন মাত্র ১১ বছর,পরিবারের দারিদ্রতা যখন চরম শিখরে,জীবনের সবচাইতে বড় অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটে-তার বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়!

টাকা পয়সার অভাবে খুব বেশি পড়াশোনাও করতে পারেনি! দু-মুঠো খাবারের তাগিদে রোনালদো স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে নেমে পড়েন জীবন সংগ্রামে। হ্যাঁ, এই ছোট্ট বয়সেই অর্থ উপার্জনের জন্য বেচে নেন রাস্তা রাস্তায় ফুটবলের প্রতিযোগিতা চালানো। বেচে থাকার তাগিদে ফুটবলের মধ্যেই ভালোবাসা খুজে পান। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই রোনালদো হয়ে যান স্থানীয় ক্লাবগুলোর নিয়মিত সদস্য!

একসময় স্থানীয় ক্লাব সাও ক্রিস্তোভাও-এ খেলার সময় ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগের বিখ্যাত ক্রুইজেরোর নজরে আসেন। জীবনের গতিপথ পালটে যায় এখানেই।

২৫শে মে, ১৯৯৩ সালে মাত্র ১৬ বছর ৩ মাস ২০৩ দিন বয়সে ‘মিনাস গেরিয়াস চ্যাম্পিয়ন্সশিপে’ ক্যালডেন্সের হয়ে পেশাদার ফুটবলে রোনালদোর অভিষেক হয়। রোনালদো প্রথম নজরে আসেন ৭ নভেম্বর ১৯৯৩ সালে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব বাহিয়ার বিপক্ষে এক ম্যাচে একাই ৫ গোল করে! ম্যাচটি দেখে ব্রাজিলিয়ান লিজেন্ডারি ডিফেন্ডার কাফু বলেন, ‘রোনালদোকে প্রথম দেখি ক্রুইজেরোর হয়ে খেলতে। সে তখনও অনেক ছোট ছিল! খেলায় সে একাই পাঁচ গোল করে এবং সে এটাই দেখায় যে, সত্যিকার ফেনোমেনন।’

ক্রইজেরোর হয়ে প্রথম মৌসুমেই জিতে নেন ক্লাব ইতিহাসে প্রথম ব্রাজিলের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট কোপা ডে ব্রাজিল। কোপা ডে ব্রাজিল ক্রুইজেরোর হয়ে ১৪ ম্যাচ খেলে করেন সর্বোচ্চ ১২ গোল। ক্রুইজেরোর হয়ে রোনালদো ৪৭ ম্যাচে করেন ৪৪ গোল। ১৯৯৪ সালে ব্রাজিলিয়ান লিজেন্ডারি ফুটবলার রোমারিওর পরামর্শে ক্রুইজেরোর পাট চুকিয়ে ইউরোপে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেন! পাড়ি দেন টোটাল ফুটবলের দেশ নেদারল্যান্ডসে।

ইউরোপে রোনালদো দুই বছর খেলেন নেদারল্যান্ডসের ক্লাব পিএসভি আইগুহোভেনের হয়ে। ১৯৯৪-৯৬ এই দুই মৌসুম পিএসভির হয়ে অবিশ্বাস্য ফুটবল খেলেন লিমা।

ক্লাবের হয়েছে  প্রথম মৌসুমেই ডাচ লিগে গোল করেন ৩০ টি। ১৯৯৫ সালে ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করেন। পরের মৌসুমে জিতে নেন ডাচ কাপ। পিএসভির হয়ে পরের বছর উয়েফা কাপে জার্মান ক্লাব লেভারকুসেনের বিপক্ষে দারুণ এক গোল করে সবাইকে চমকে দেন। এই ম্যাচ পর রুডলফ বুলার বলেন, ‘আমি কখনওই ১৮ বছর বয়সী কাউকে এভাবে খেলতে দেখি নাই।’

পিএসভির হয়ে ৫৮ ম্যাচে করেন রেকর্ড ৫৪ গোল! মাত্র ২০ বছর বয়সে জিতে নিন সবচাইতে কম বয়সে ফিফা বর্ষসেরার পুরষ্কার। এই পিএসভির হয়ে নজরকাড়া পারফরম্যান্সের পর ইউরোপে ইন্টার ও বার্সেলোনার মত বড় ক্লাবগুলো ট্রান্সফার যুদ্ধে নামে রোনালদোকে দলে বেড়াতে। অবশেষ ততকালীন রেকর্ড ১৭ মিলিয়নে পিএসভি থেকে বার্সেলোনায় যোগ দেন রোনালদো। বার্সেলোনায় যোগ দিয়ে প্রথম মৌসুমেই যা করলেন তা ছিল অবিশ্বাস্য!

বার্সেলোনা প্রথম সিজনেই করেন ৪৯ ম্যাচে ৪৭ গোল।তার মধ্যে কেবল লিগেই করেন সর্বোচ্চ ২৫ গোল। বার্সার হয়ে জিতেন উয়েফা কাপ,কোপা ডেল রে,সুপার কোপা ডি ইস্পানা।

১১ অক্টোবর ১৯৯৬ সাল, এসডি কম্পোস্টেলার সাথে দৃষ্টিনন্দন এক গোল করেন। ঐতিহাসিক গোলটির পর স্প্যানিশ পত্রিকা দ্যা মার্কা শিরোনাম করেন, ‘পেলে রিটার্নস।’ পরবর্তীতে গোলটি নিয়ে স্পোর্টস জায়ান্ট নাইকির বিজ্ঞাপনে ভয়েসকভার করে প্রশ্ন করা হয়, ‘Imagine you asked God to be the best player in the world, and he listened to you!’

পরের মৌসুমে একাই লা লিগায় করেন ৩৭ ম্যাচে ৩৪ গোল যা ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত রেকর্ড ছিল। টানা দ্বিতীয় বারের মত জেতেন ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার।

১৯৯৭ সালে বার্সেলোনার সাথে চুক্তিনামায় সমস্যা হলে রোনালদো পাড়ি দেন ইতালিতে। রেকর্ড ১৯ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ইতালিয়ান জায়ান্ট ইন্টার মিলানে যোগ দেন। সেখানেই প্রথম ফুটবলার হিসেবে টানা দুই বার ট্রান্সফার ফির ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করেন।

ইন্টারের হয়ে সিরি ‘এ’ লিগে প্রথম সিজনেই করেন সর্বোচ্চ ৩৭ ম্যাচে ২৫ গোল। প্রথমবারের মত জিতে নেন ব্যালন ডি’অর পুরষ্কার। নেস্তা থেকে মালদিনির মত লিজেন্ডারি ডিফেন্ডাররা একবাক্যে বলেন-রোনালদো ছিল  তখন অপ্রতিরোধ্য। ইন্টারের হয়ে অপ্রতিরোধ্য রোনালদো  গোল করেন ৯৪ ম্যাচে ৫৯।  মূলত তখন থেকেই রোনালদোর নাম ইতালিয়ান পত্রিকাগুলোয় ‘এল ফেনোমেনন’ পরিচিতি লাভ পায়। সেই সময় টাইমস অনলাইনে ইন্টারের সর্বকালের সেরা ২০ জন খেলোয়াড়ের একজন মনোনীত হোন।

২০০২ সালে ইন্টার মিলান ছেড়ে রোনালদো যোগ দেন রাজকীয় ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে। প্রথম মৌসুমেই ২৩ গোল করে রিয়ালকে জিতান লা লিগা। রিয়ালের হয়ে ইন্টার কন্টিনেন্টাল ও স্প্যানিশ সুপার কাপও জিতেন। ২০০৩-০৪ সিজনে ২৬ গোল করে হন লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং জিতে নিন পিচিচি ট্রফি। দ্বিতীয় বারের মত জিতেন ব্যালন ডি’অর।

২০০৩ সালের ২৩ এপ্রিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রথম লেগে সান্তিয়াগো বার্না ব্যু’তে কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও রিয়াল মাদ্রিদ। সেই ম্যাচে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ৪-৩ গোলে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে দেয়। কিন্তু দুই লেগ মিলিয়ে জয়ী হয় রিয়াল এবং টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পরে যায় ইউনাইটেড। আর ম্যানচেস্টারের এই বাদ পড়ার পেছনের মূল হোতা ছিলেন রোনালদো। ওল্ড ট্রাফোর্ডে সেদিন রোনালদো একাই রিয়াল মাদ্রিদের হয় তিন গোল করেন।

তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্যে প্রতিপক্ষ সমর্থকরাও বিমুগ্ধ হয়ে পরে। তাই হ্যাট্রিক পূরণ করার পরে যখন রোনালদোকে বদলি করা হয় তখন ওল্ড ট্রাফোর্ডে ইউনাইটেড সমর্থকরা তাকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায়। প্রতিপক্ষের মাঠে এরকম অভিবাদন পাওয়া ফুটবল ইতিহাসে খুবই বিরল। অথচ ম্যাচের শুরুতেই এই রোনালদোকে খোচা মেরে ফার্গুসন বলেছিলেন, রোনালদো থেকেও ইউনাইটেডের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি রাহুল গঞ্জালেস। আর রোনালদোর অতিমানবীয় পারফরম্যান্স মুগ্ধ হয়ে সেই স্যার ফার্গুসনই ম্যাচ শেষে বলে ফেললেন, ‘You can’t legislate for someone who produces moments like that.’

রিয়াল মাদ্রিদে সকল প্রতিযোগিতায় মোট ১২৭ ম্যাচ খেলে ৮৪ গোল করেন। ২০০৭ সালে রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে এবার ইতালির আরেক জায়ান্ট ক্লাব এসি মিলানে যোগ দেন। ক্যারিয়ারের পড়ন্তকালে শারীরিক অসুস্থতা ও ওজনের কারণে এসি মিলানের হয়ে খুব বেশি খেলতে পারে নাই।

দুই মৌসুমে মিলানের জার্সি গায়ে ২০ ম্যাচে ৯ গোল করেন। ২০০৮ সালে এসি মিলানে লিভোরনো ম্যাচে হাটুতে মারাত্মক আঘাত লেয়ে স্ট্রেচারে মাঠ ছাড়েন। ওই সিজনেই রোনালদোর এসি মিলান ছেড়ে নিজ দেশের ক্লাব করিয়ান্থাসে যোগ দেন। নিজ দেশের ক্লাবের হয়ে ৩১ ম্যাচে ১৮ গোল করেন। ২০০৯ মৌসুমে রোনালদো করিয়ান্থাসের হয়ে ১২ ম্যাচে ৯ গোল করেন। ক্লাবের হয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় বারের মত জিতেন কোপা ডি ব্রাজিল।

পৃথিবীর ইতিহাসে যেকজন ফুটবলার ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে সমানভাবে সফল হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম রোনালদো। আন্তর্জাতিক ফুটবলে খুব কম ফুটবলারই রোনালদোর মত এতটা সফল হয়েছেন। বিশ্বকাপ ও মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই সবজায়গায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ করেছেন।

ফুটবল বিশ্বকাপ ইতিহাসে মাত্র তিনজন ফুটবলার দুইটি ভিন্ন টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন। রোনালদো তাদের একজন। ফুটবলে মাত্র একজন খেলোয়াড়ই বিশ্বকাপের দুইটি ভিন্ন টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সেরা খেলোয়াড় হয়ে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়েও দুইটি ভিন্ন টুর্নামেন্টে টপ স্কোরার ও সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। জ্বি, তিনিও রোনালদো লুইস দ্য নাজারিও লিমাই।

১৯৯৪ সালের ২৩শে মার্চ মাত্র ১৭ বছর বয়সেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার সাথে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে ব্রাজিল দলের হয়ে রোনালদোর অভিষেক হয়। ৪ মে, ১৯৯৪ সালে আইসলেন্ডের সাথে রোনালদো ব্রাজিলের হয়ে প্রথম গোলের দেখা পান। সেই থেকে ব্রাজিলের জার্সি গায়ে রোনালদো দ্যা গ্রেট পেলের পর সর্বোচ্চ ৯৮ ম্যাচে ৬২টি গোল করেন। রোনালদো লিমার সবচাইতে বড় শক্তি ছিল, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিজের সেরা পারফরম্যান্স করা। হ্যা, রোনালদো ছিলেন বিগ ম্যাচ প্লেয়ার। ১৯৯৭ এবং ৯৯ দুই কোপা আমেরিকায় গোল করেছেন। ১৯৯৭ কোপা আমেরিকার সেরা খেলোয়াড় ছিলেন। ৯৯-এর কোপা আমেরিকার হয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা।

ব্রাজিলের তিনটি ইন্টারন্যাশনাল শিরোপা জয়ে জয়ে দুবারই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়, দুবার সর্বোচ্চ গোলদাতা, একবার রানার্স আপ, এবং যে তিনটি ফাইনাল খেলেছেন তাঁর প্রতেকটিতেই গোল করেছেন।

১৯৯৪ বিশ্বকাপের দলে রোনালদোর নাম থাকে! ১৯৯৪ বিশ্বকাপে দলের সঙ্গে গিয়েছিলেনও যুক্তরাষ্ট্রে। তবে কোনো ম্যাচ না খেলেই সেবার বাড়ি ফিরেছিলেন তরুণ রোনালদো। ১৯৯৮-এর ফ্রান্স বিশ্বকাপেই রোনালদো গিয়েছিলেন একজন পরিপূর্ণ ফুটবলার হিসেবে। চার গোল করেছিলেন, করিয়েছিলেন তিনটি। ব্রাজিলের মোট ১৪ গোলের ৫০ শতাংশেই ছিল রোনালদোর অবদান। কিন্তু ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে বিশ্ববাসী দেখেছিল এক ‘অন্য’ রোনালদোকে। রোনালদো লিমার নিষ্প্রভ উপস্থিতি সেদিন ব্রাজিলকে বঞ্চিত করে টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ-গৌরব থেকে।

অনেকেই বলেন, ফাইনালের ঠিক আগমুহূর্তেই অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত রোনালদো সেদিন ছিলেন আনফিট। কিন্তু তাঁর প্রবল আগ্রহে কোচ মারিও জাগালো সেদিন তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন প্রথম একাদশে। তাঁর মতো খেলোয়াড়ের একদিনের ব্যর্থতাও ঠাঁই পেয়েছে ফুটবল ইতিহাসের অমরত্বের অধ্যায়ে। রানার্স আপ হয়েও জিতেন টুর্নামেন্ট সেরা প্লেয়ারের পুরস্কার।

২০০২ বিশ্বকাপে আর কোনো ছাড় দেননি রোনালদো। পুরো আসরে কেবল ইংল্যান্ড ছাড়া ব্রাজিলের প্রতিটি ম্যাচেই গোল করেছিলেন। সেমিফাইনালে তুরস্কের বিপক্ষে তাঁর একমাত্র গোলেই ফাইনাল নিশ্চিত করে ব্রাজিল। ফাইনালেও রোনালদোর জোড়া গোলেই ব্রাজিল জিতে নেয় বিশ্বকাপে তাঁদের পঞ্চম শিরোপা।

ফাইনাল ম্যাচে রোনালদো লিমা বনাম অলিভার কানের রাইভালিটি বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম আইকনিক মুহুর্তগুলো একটি হিসেবে নিশ্চিতভাবেই জায়গা করে নিয়েছে। এই ম্যাচে লিজেন্ডারি গোলরক্ষক অলিভার কানের হিউমিলিয়েটেড ক্যারিয়ারের অন্যতম বাজে পারফরম্যান্সগুলোর একটি। পুরো আসরে তাঁর আটটি গোল তাঁকে এনে দেয় গোল্ডেন বুটের সম্মান। দুইটি বিশ্বকাপে মোট ১২ গোল নিয়ে পেলের সঙ্গে যৌথভাবে হয়ে যান ব্রাজিলিয়ান হিসেবে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা।

জার্মানিতে পরের বিশ্বকাপেও খেলেছেন। প্রথম দুই ম্যাচে ব্রাজিল জয় পেলেও কোনো গোল পাননি ‘মোস্ট কমপ্লিট স্ট্রাইকার’ রোনালদো। তাঁর কমে যাওয়া গতি আর বেড়ে যাওয়া স্বাস্থ্য নিয়ে তত দিনে শুরু হয়ে গেছে ফিসফাস। তবে নানা গুঞ্জন-সমালোচনার মধ্যেও কোচ কার্লোস আলবার্তো পেরেইরা ঠিকই আস্থা রেখেছেন রোনালদোর ওপর। এই আস্থার প্রতিদান দিতেই যেন তৃতীয় ম্যাচে জাপানের বিপক্ষে করেন দুই গোল। জার্ড মুলারের সঙ্গে যৌথভাবে হয়ে যান বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা। তিনটি বিশ্বকাপে গোল করা মাত্র ২০ জন ফুটবলারের ছোট্ট অথচ এলিট এক ক্লাবের সদস্যও বনে যান তিনি।

দ্বিতীয় রাউন্ডে ঘানার বিপক্ষে ম্যাচে গোলটি তাঁকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়। জার্ড মুলারকে ছাড়িয়ে তিনি হয়ে যান বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সর্বোচ্চ গোলদাতা। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ব্রাজিলের সাথে গোল করেই জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসা ১৬ গোল করে রেকর্ডটি ভেঙ্গে দেন! রোনালদো ইউর্গেন ক্লিনসম্যানের পর দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে টানা তিন বিশ্বকাপের প্রতিটিতেই কমপক্ষে তিনটি করে গোল করার রেকর্ড করেন। পরে অবশ্য ক্লোসা টানা তিন বিশ্বকাপে ৪ গোল করে এই রেকর্ডটিও ভেঙে দেন। রোনালদো ৪ বিশ্বকাপ খেলে ১৯ ম্যাচে ০.৭৯ গড়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫ গোল করেন।

২০১১ সালের ৭ জুন, ব্রাজিলের সাও পাওলোতে রোমানিয়ার সাথে এক আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলে আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানেন। বর্তমানে রোনালদো লা লিগার রিয়াল ভ্যালদোলিদের হয়ে কাজ করছেন। ২০১৮ সালে ৩০ মিলিয়নের বিনিময়ে ক্লাবটির ৫১ শতাংশ মালিকানা কিনে নেন। তার ইচ্ছে, ফুটবলে বড় অবদান রাখা।

১৯৯৮ থেকে ২০০২ একাই বিশ্বের মানুষকে ফুটবল অনুরাগী করতে তাঁর অবদানের কথা প্রথমেই আসবে। ফুটবল বিশ্বে রোনালদোর মত খুব কম খতরনাক স্ট্রাইকার জন্ম নিয়েছে – যারা প্রতিপক্ষের প্রতি ইঞ্চি জায়গা ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে ম্যাচের ফলাফল পাল্টে দিয়েছে, দুর্দান্ত সব ফিনিশিংয়ে একের পর এক গোল করেছে। সত্যিকথা বলতে,রোনালদো ছিলেন এমন এক ভয়ংকর স্ট্রাইকার যার নাম শুনলেই বিশ্বের কোটি কোটি ৯০’ এর দশক জন্ম নেওয়া প্রতিটি ফুটবল অনুরাগীদের রক্তে নাচন ধরে। তাই সর্বকালের সেরা নাম্বার নাইনের তালিকায় তিনিই সেরা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...