মিরপুরে কাটেনি বিপিএলের রেশ, তখনো বাকি ছিলো ফাইনালের আনুষ্ঠানিকতা। ফাইনালের আগের দিন খবর এলো — চলতি বিপিএলে সেঞ্চুরি দিয়েও জায়গা হয়নি মোহাম্মদ আশরাফুলের শ্রীলঙ্কা সফরে। গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশিত ২৫ সদস্যের প্রাথমিক দলে নেই আশরাফুলের নাম। সংবাদটি মেনে নেওয়া ছিলো চরম আক্ষেপ ও হতাশার আশরাফুল ভক্তদের জন্য। আশরাফুল তো নিজের হতাশা গণমাধ্যমেই জানিয়েছিলেন। ইনজুরির কারণে অস্ট্রেলিয়ায় সাকিব আল হাসান। দু’জন তারকা ক্রিকেটারের অনুপস্থিতে কেমন করবে বাংলাদেশ দল! প্রশ্ন সবার মনেই ছিলো।
বিপিএলের ফাইনাল শেষ হলো। ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স আবারও শিরোপা ঘরে আনলো। ঢাকার উল্লাসের মাঝেও নিস্প্রভ ছিলেন ঢাকা দলের একজন। বিপিএলে ভালো করেও জাতীয় দলের স্কোয়াডে ডাক না পাওয়ার হতাশা পুড়িয়ে যাচ্ছিলো তাঁকে। ভক্তদের মাঝেও ছিলো হতাশার বর্হিঃপ্রকাশ। আশরাফুলের দলে না থাকা নিয়ে জন্ম নেয় হাজারো প্রশ্ন। প্রধান নির্বাচক আকরাম খান এক জবাবেই পরিস্থিতি শান্ত করেন, ‘আমরা বিসিএলের পারফরম্যান্স অনুযায়ী দল বাছাই করেছি।’ যদিও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আশরাফুলের অতীতের সাফল্য তার দলে থাকা যৌক্তিক বলে প্রমাণ করে। ক্রিকেটে অতীত বলে কিছুই নেই, যা কিছু বিদ্যমান তার সব-ই বর্তমান। এই কারণেই দলে ঠাঁই হয়নি আশরাফুলের।
সময় বরাবরই আশরাফুলের পক্ষে কথা বলে আসছিলো প্রথম থেকেই। তাই বারংবার আশরাফুলের নাম উচ্চারিত হচ্ছিলো চতুর্দিক থেকে। ঠিক এমন সময় একই সফরে ডাক পাওয়া আশরাফুলের বন্ধু শাহরিয়ার নাফিস আকস্মিক ছিটকে যান দল থেকে। শাহরিয়ার নাফিসের আকস্মিক ছিটকে যাওয়ায় আশরাফুলের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। কোটি মানুষের ভালোবাসা ও প্রার্থনার ফলাফল বোধহয় এটাকেই বলে। তাই প্রাথমিক দলে না থাকা আশরাফুল ডাক পেয়ে গেলেন মূল সফরে। দলের সাথে পাড়ি জমালেন প্রিয় প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কার ডেরায়।
প্রথম টেস্টের পূর্বে তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে নির্বাচক দের সিদ্ধান্ত কে ভুল প্রমাণ করে দেন আশরাফুল। প্রত্যাশা বেড়ে যায় আশরাফুলের উপর। প্রিয় প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রত্যাশা বেশী থাকাই তো স্বাভাবিক আশরাফুল কে ঘিরে। তাই গলের সবুজ গালিচায় অনুষ্ঠিতব্য প্রথম টেস্টে নিজের সর্বোচ্চ উজাড় করে দেওয়ার ক্ষুধার আভাস পাওয়া গিয়েছিলো প্রস্তুতি ম্যাচে। নিখুঁত ব্যাটিংয়ে স্থানীয় দর্শকরা মুগ্ধ তার শতকে। যদিও শ্রীলঙ্কার ব্যাটিংয়ের বিপক্ষে বোলিং দিয়ে লড়াই করা দূরূহ ব্যাপার হয়ে যাবে বাংলাদেশের জন্য তা তো অনুমান করাই যাচ্ছিলো।
যা যা অনুমান করা হচ্ছিলো, মাঠে ঠিক তাই ঘটেছে — শ্রীলঙ্কার দলীয় সংগ্রহ প্রায় ছয়শো। সাঙ্গাকারা, থিরিমান্নে, চান্দিমালের দানবীয় ব্যাটিংয়ে দিশেহারা বাংলাদেশ দল। ইনিংস ঘোষণা করার পর ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ সুবিধা করতে পারেনি। শুরুতেই জহুরুলের বিদায়। পরবর্তী ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে আসেন প্রস্তুতি ম্যাচে শতক হাঁকানো আশরাফুল। উৎসুক বাংলাদেশী দর্শকদের তখন টিভি স্ক্রিনে তৃষ্ণার্ত চোখ। ফর্মে থাকা আশরাফুলের কাছ থেকে অতিচমকপ্রদ কিছুই আশা করা হচ্ছিলো।
আশরাফুলও পুনরায় নিজেকে প্রমাণের সুযোগ পেয়ে শুরু থেকেই খেলে যাচ্ছিলেন দেখেশুনে। দশম ওভারের চতুর্থ বলে কুলাসেকারা কে কাভার ড্রাইভে চার মেরে নিশ্চিত করেন আজ কিছু ভিন্ন হতে যাচ্ছে। বিজয়ের বিদায়ের আগ পর্যন্ত দলের খাতায় যোগ হয় ৬৫ রান। বিজয়ের বিদায়ে দুই উইকেট হারানো বাংলাদেশ আশা বুনে যাচ্ছিলো আশরাফুলের ব্যাটে। প্রথম বল থেকেই অফ সাইডের প্রতিটা শটেই আত্মবিশ্বাসী আশরাফুলের দেখা মিলছিলে । আশা বুনে যাওয়াটাই তো যৌক্তিক।
সঙ্গী হিসেবে মাঠে আসেন মমিনুল। ছোটখাটো গড়নের মুমিনুল দেখেশুনে মাঠে সময় পার করতে থাকেন বড় ভাই আশরাফুলের সাথে। ত্রিশতম ওভারের প্রথম বলে অজান্তা মেন্ডিস কে অন ড্রাইভে বল বাউন্ডারি ছাড়া করে ৬৭ বলে অর্ধশতক আদায় করে নেন আশরাফুল। তখন পর্যন্ত এই শট কেই আশরাফুলের সেই ইনিংসের সেরা শট হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন ধারাভাষ্যকেরা। অপরপ্রান্তে থাকা মমিনুল এগিয়ে গিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। মমিনুল নিজের রানের খাতা দীর্ঘ করার প্রয়াস চালাতে থাকেন। স্কয়ার কাট, কাভার ড্রাইভ ও স্ট্রেইড ড্রাইভে পার্টনারশিপ বড় করার স্বপ্ন দেখাতে থাকেন। দিলশানের করা ৪৫ তম ওভারের শেষ বলে ডিফেন্স করে দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ করেন আশরাফুল। দলীয় স্কোর গিয়ে দাঁড়ায় দুই উইকেটে ১৩৫। মমিনুল ও আশরাফুল অপরাজিত থাকেন যথাক্রমে ৩৫ ও ৬৫ রানে।
তৃতীয় দিনের শুরুতে কিছুটা দ্রুতগতির ব্যাটিং করেন মমিনুল। কুলাসেকারা কে কাভার ড্রাইভে চার মেরে শতরানের পার্টনারশিপ পূর্ণ করেন তিনি। এর পূর্বে নিজের অর্ধশতকও তুলে নেন। দলীয় ১৭০ রানে মমিনুলের বিদায়ে অবসান ঘটে ১০৫ রানের পার্টনারশিপের। এরপর মাঠে আসলেন রিয়াদ, রানের খাতা না খুলেই ৪ বলে বিদায় নিলেন। দায়িত্ব নিতে মাঠে আসেন অধিনায়ক মুশফিক। তখনও চলছে আশরাফুলের ক্ষুরধার ব্যাটিং, দমিয়ে রাখা যাচ্ছিলো না কোনো বলেই তাকে। কোনো চিত্রশিল্পী যেন রঙতুলি তে আশরাফুলের ব্যাটিং চিত্রায়িত করে যাচ্ছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটে অধিক স্লিপ ফিল্ডার রেখে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে বল করে যাওয়া স্বাভাবিক নিয়ম। যদিও এই নিয়মে আটকে রাখা যায়নি আশরাফুলকে। নিয়মিত বিরতিতে অফ সাইডে ব্যাট চালিয়ে যান। বেশীরভাগ বাউন্ডারি ও স্ট্রাইক রোটেটের ক্ষেত্রে অফ সাইড কেই বেশি ব্যবহার করেছিলেন তিনি। এই ইনিংস কে অফ সাইডেড ইনিংস বললেও ভুল হবেনা।
অধিনায়ক মুশফিক কে সাথে নিয়ে দলীয় সংগ্রহ ও নিজেদের জুটির রান বাড়াতে থাকেন। অর্ধ শতকের মত শতকের কৌটায় পৌঁছাতেও ব্যবহার করলেন মেন্ডিসের বল কে। তবে এবার দিক পরিবর্তন করে বল ঠেলে দিলেন কাভার অঞ্চল দিয়ে বাউন্ডারিতে, ছিষোট্টি তম ওভারের দ্বিতীয় বল সাক্ষী হয়ে থাকলো আশরাফুলের ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ ও শ্রীলংকার বিপক্ষে নিজের পঞ্চম সেঞ্চুরীর। ডাগআউটে ক্যামেরায় সবার প্রথমেই ধরা পড়লো রুবেলের চেহারা, দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছিলেন। স্বভাবসুলভ উদযাপনে গলের মাঠে সেজদায় অবনত হোন মোহাম্মদ আশরাফুল। জড়িয়ে ধরেন অধিনায়ক মুশফিক। প্রথম সেশনেই পরিবর্তনের সুবাস ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আশরাফুল। শতকের পথে একমাত্র ছয়টি আশরাফুল রঙ্গনা হেরাথ কে ইনসাইড আউটে এক্সট্রা কাভারের উপর দিয়ে হাঁকিয়েছিলেন। ধারাভাষ্যে রাসেল আর্নোল্ড আশরাফুলের সেরা শতক বলে আখ্যায়িত করেন। নিখুঁত ও নিয়ন্ত্রিত ইনিংসের বিশেষণও যুক্ত করেন।
পরবর্তী গল্পে মুশফিক কে সাথে নিয়ে ব্যাটিং কে উৎসবে পরিণত করে নেন। আশরাফুল-মুশফিক জুটি এগিয়ে নিতে থাকে বাংলাদেশ কে। একের পর এক চোখ ধাঁধানো শটে লঙ্কান বোলারদের নাস্তানাবুদ করতে ব্যস্ত থাকেন দুজন। কেডসের স্পাইক যেন পিচে পেরেকের মত কাজ করতে শুরু করে দুজনের। আশরাফুলের দেখানো পথেই এগুতে থাকেন মুশফিক। অফসাইডে দমিয়ে রাখা যায়নি অধিনায়ক কেও। দিনের প্রথম সেশনের অষ্টম ওভার থেকেই সময় পার করতে শুরু করেন। মাঠে নিজেদের স্থায়িত্ব বাড়াতে থাকেন। রানের চাকা সচল থাকে স্ট্রাইক রোটেটে। মাঝে ম্যাথিউস কে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট ও কাভারের উপর দিয়ে দারুণ দুই শটে চার মেরে রানের চাকার গতিতে শক্তি যোগান আশরাফুল। অন্যপ্রান্তে বোলারদের চরম শাসন করে অর্ধশতকের ঘর পার করে ফেলেছেন মুশফিক।
১০৫ তম ওভারে মেন্ডিসের দ্বিতীয় বলে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ারে চার হাঁকিয়ে দু’জনের দেড়শো রানের জুটি পূর্ণ করেন মুশফিক। প্রস্তুতি ম্যাচের ফর্ম কে কাজে লাগিয়ে মূল ম্যাচে শতকের পর ১০৮ তম ওভারের শেষ বলে দিলশান কে লেগ সাইডে ঠেলে দিয়ে ১৫০ রান পূরণ করেন আশরাফুল। স্বস্তিতে তখন দলীয় সাজঘর। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে সবাই অভিবাদন জানালেন মাঠে থাকা আশরাফুল কে।
অন্যপ্রান্তে প্রতিপক্ষের সাজঘরে তখন চলছে সুনশান নীরবতা। কিছুতেই ম্যাচের হিসেব মিলছিলো না, মাঠে সকল পরিকল্পনাই ব্যর্থ আশরাফুল-মুশফিকের নিয়ন্ত্রিত ব্যাটিয়ে। চিন্তার ভাঁজ ক্ষণে ক্ষণে ধরা দিচ্ছিলো প্রতিপক্ষ শিবিরে। অভিজ্ঞ আশরাফুলের এমন ব্যাটিং নতুন নয় লঙ্কান ক্রিকেটের কাছে। লঙ্কান বোলিং গ্রেট মুরালি-ভাস দের পরাজিত করেই তো অভিষেকে ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান হয়েছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। আশরাফুলের ক্ষুরধার উইলোর কাছে লঙ্কান দের নতুন পরাজয় নয় এই ম্যাচ।
আশরাফুলের ব্যাটে আজ জাদুকরী মন্ত্রের ছোঁয়া লেগেছে। প্রতি শটেই যেন মুগ্ধতা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিলো মাঠের চারদিকে। শ্রীলংকা পেরিয়ে এই মন্ত্র বঙ্গেও আশার বাণী দিয়ে যাচ্ছিলো। নিজের গড়া রেকর্ড নিজেই ভাঙার পথে এগুচ্ছিলেন। নতুন ইতিহাস তৈরির পথও সুগম করে ফেলেছিলেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটে যা কিছু প্রথম সব-ই তো মোহাম্মদ আশরাফুল। ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে সর্বাধিক তার নিজের করা ১৫৮ রানের ইনিংস কেও এবার পেছনে ফেলে দেন।
মধ্যাহ্ন বিরতি ও চা বিরতি পেরিয়ে গেলেও তৃতীয় দিনে থামছেনা আশরাফুল-মুশফিকের ব্যাটিং। সবার উৎসুক নজর যেন আশরাফুলের দিকই। সবার মুখেই এই কথা! আশরাফুল কি পাবেন প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে দ্বিশতকের দেখা ? তৎকালীন সময়ে মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকের এক বিজ্ঞাপনে সস্তায় কোনোকিছু ক্রয় করা কে বাংলালিংক দামে ক্রয় বলে আখ্যায়িত করা হতো। আশরাফুলের সাবলীল আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিংয়ে রান সংগ্রহ অত্যন্ত সহজ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সমর্থকদের অনেকের মুখে আশরাফুলের ইনিংসের রানগুলো কে বাংলালিংক দামে ক্রয় করা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো।
দিনের শেষ সেশনেও আশরাফুল ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বাইশ গজে। মুশফিকের মাঠে আবির্ভাবের পর অনেকখানি স্বস্তিতে ব্যাট চালাতে থাকেন আশরাফুল। মুশফিক কিছুটা দ্রুত রান সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকেন আর আশরাফুল স্ট্রাইক রোটেট করে মুশফিক কে সঙ্গ দিতে থাকেন। এটাকেই বলা হয় সময়ের সঠিক ব্যবহার। মাঠে সময় পার করতে হতাশা ধরিয়ে দেন প্রতিপক্ষের দূর্গে। অথচ আশরাফুল-মুশফিক একজনকেও ক্লান্ত হতে দেখা যায়নি। শ্রীলঙ্কানদের একের পর এক কৌশল ব্যর্থ হতে থাকে।
অন্যদিকে অধিনায়ক মুশফিকের দৃষ্টিনন্দন শটেও দিশেহারা লঙ্কান বোলিং লাইন-আপ৷ তৃতীয় সেশনের অলস দুপুর পেরিয়ে বিকেলের সূর্য যখন হেলতে শুরু করে তখনও পিচের দু’প্রান্তে চলছে আশরাফুল-মুশফিকের শাসন। ১৩৫ তম ওভারের শেষ বলে রঙ্গনা হেরাথ কে ডিফেন্স করে দিন শেষ করেন মুশফিক। তৃতীয় দিনে ৯৩ ওভার ব্যাটিং করে দুই উইকেট হারিয়ে ৩০৩ রান সংগ্রহ করে বাংলাদেশ। দলীয় স্কোর গিয়ে দাঁড়ায় তৃতীয় দিন শেষে ৪ উইকট হারিয়ে ৪৩৮। আশরাফুল অপরাজিত থাকেন ১৮৯ রানে। দীর্ঘদিন পর দেখা মিলে আশরাফুলের চিরচেনারূপের।
দিনশেষে মাঠ ছাড়ার পূর্বে হাত মিলিয়ে আশরাফুল ও মুশফিক কে অভিবাদন জানাতে থাকে লঙ্কান ক্রিকেটাররা। মাঠ ছেড়ে আসার সময় চোখেমুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠছিলো দুজনের চেহারায়। মুশফিক বারবার আশরাফুলের মাথায় হাত বুলিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন। ক্যামেরার লেন্স বারবার ঘুরেফিরে আশরাফুলের দিকেই। দেশের আনাচে-কানাচে, শহর, মফস্বল, গ্রামে-গঞ্জে সেই সন্ধ্যার আড্ডার একমাত্র আলোচনাই ছিলো আশরাফুল কে ঘিরে। প্রথম দ্বি-শতক থেকে মাত্র ১১ রান দূরে থাকা আশরাফুলের সেই রাত হোটেলে কেটেছে নির্ঘুম।
সারারাত দ্বি-শতকের কথা ভেবে অস্থিরতায় ঘুমানো আর সম্ভব হয়নি। খুব ভোরে হোটেলের সুইমিংপুলে দেখা মিলে আশরাফুলের। দ্বি-শতকের উত্তেজনায় অশান্ত মন কে শান্ত করতে একাই সুইমিংপুলে হাজির আশরাফুল। বাংলাদেশ ক্রিকেটে যা কিছু প্রথম তার সব-ই আশরাফুল এই উক্তি আরেকবার প্রমাণের সুযোগে মাঠের উদ্দেশ্যে হোটেল ছাড়েন আশরাফুল দলের সাথে।
আগেরদিনের সঙ্গী অধিনায়ক মুশফিক কে সাথে নিয়েই বাইশ গজে এগিয়ে যান। নির্ঘুম রাতের উত্তেজনা সত্য করার প্রয়াসে দিলশান কে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ব্যর্থ হোন। ব্যাট মিস করে প্যাডে লেগে বল লেগ স্লিপে ম্যাথিউসের তালুবন্দি হলে ক্যাচ ও লেগ বিফোর উভয়ের জন্য আবেদন করেন শ্রীলঙ্কানরা। আশরাফুলের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিলো সেই আবেদন। আশরাফুল কে স্বস্তিতে ফেরান আম্পায়ার রিচার্ড ইলিনওর্থ নট আউট ঘোষণা দিয়ে। আগের দিন অনেকবার রিভার্স সুইপ খেলার ইচ্ছা জাগলেও জায়গামত ফিল্ডার থাকায় তিনি সাহস করেননি।
চারশোর অধিক বল মোকাবেলা করে দ্বি-শতকের চেয়ে মাত্র ১০ রান দূরে থাকা আশরাফুলের আর তর সইছিলো না। চতুর্থ দিনের প্রথম ৩-৪ ওভারের মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের আশায় আগের দিনের মতোই অফসাইডে ইনসাইড আউট শট করতে গিয়েই বিপদ ডেকে আনেন। রঙ্গনা হেরাথ কে ডাউন দ্যা উইকেটে ইনসাইড আউট শট করার প্রচেষ্টাতেই আউটসাইড এইজ হয়ে ম্যাথিউসের হাতে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে আক্ষেপ নিয়েই সাজঘরের পথ ধরেন আশরাফুল।
আশরাফুলের বিদায়ে ক্ষণিকের জন্য থেমে গিয়েছিলো সমর্থকদের হৃদস্পন্দন। টিভি স্ক্রিনে ২০১৩ সালের ১১ই মার্চ যেন শোক নেমে এসেছিলো। আশরাফুলের না পারার বেদন ছুঁয়ে গিয়েছিলো বঙ্গের সমস্ত বাসিন্দাদের। দেশের হয়ে ইতিহাসের পাতায় নতুন করে আর নাম লেখানো সম্ভব না হলেও আশরাফুল-ই প্রথম স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের দ্বি-শতকের। সেই স্বপ্ন কে একই ম্যাচে বাস্তবে রূপান্তর করেছিলেন মুশফিক। অনবদ্য এই ইনিংস কে তাই স্বপ্ন দেখানো ইনিংসের পাশাপাশি দ্বি-শতক না পাওয়ার আক্ষেপের গল্পও বলা চলে।
প্রাথমিক দলে না থাকা একজন আকষ্মিক দলে সুযোগ পেয়ে নিজের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কে কাজে লাগিয়ে করেছিলেন কিছু অবিশ্বাস্য৷ আর এই অবিশ্বাস্য ইনিংসগুলোই আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছে। সাদা পোশাকে আশরাফুল ও বাংলাদেশের নতুন উত্থানের আভাস দিচ্ছিলো। ‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি বাট ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট’ এই উক্তি তো আশরাফুলের সাথেই যায়। অথচ পরের গল্প শুধুই আক্ষেপ ও হতাশার। যতটুকু বাংলাদেশ ক্রিকেটের তারচেয়েও বেশী মোহাম্মদ আশরাফুলের।