আশাময় জয়ভেরীর জাগরণ

শীতের পাতাঝড়া বৃক্ষ যেমন অপেক্ষায় থাকে বসন্তের! খড়ায় চৌচির মাঠ যেমন অপেক্ষা করে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানির। বৃক্ষ-মাঠের এই হাহাকার গুলো একটা সময় প্রকৃতি নিজ নিয়মে পূরণ করে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটে একটা জায়গা কি কখনো পূরণ হয়েছে?

সময়টা ২০১৪ সালের দিকে। বাংলাদেশের খেলা, সাধারণত বাংলাদেশের খেলা হলে মিস দেওয়া হয়না তখন। সেদিন খুব সকালে রহিম ফোন করে বললো, ‘রুপক আজ বাংলাদেশের খেলা,জলদি আয়!’ আমিও চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে খেলা দেখার উদ্দ্যেশে মতিন মামার দোকানের দিকে রওনা হলাম। মতিন মামার দোকানে পৌঁছাতেই রহিম বলে উঠলো আমাদের দলটা মোটামুটি ব্যালেন্সড। কিন্তু দলে কোথাও একটা ঘাটতি রয়ে যায়! আমি খুঁজতে থাকলাম, কিন্তু সেই ঘাটতির জায়গাটি খুঁজে পেলাম না।

প্রতিক্ষার পর খেলা শুরু হলো। দারুণ উত্তেজনা পূর্ণ ম্যাচটি দেখতে দেখতে সূর্য তখন মাথার উপরে। আর কিছুক্ষণ বাদেই ম্যাচেই ফলাফল নির্ধারিত হবে। জয়ের পাল্লাটি তখন বাংলাদেশের দিকেই হেলে আছে। কিন্তু বিপক্ষে দলের একজন পেস অলরাউন্ডার ব্যাটিংয়ে এসে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিলো; যেই ম্যাচটি আমাদের জেতার কথা সেটি হেরে বসলাম। এবার দীর্ঘশ্বাসে মতিন মামার দোকান থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলতে থাকলাম। ইস! আজ যদি তাদের মতো আমাদের একজন পেস অলরাউন্ডার থাকতো!

‘পেস অলরাউন্ডার’ – এই টার্মটা বাংলাদেশ ক্রিকেটে বরাবরই এক হতাশার নাম। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্মলগ্ন থেকেই পেস অলরাউন্ডার হয়ে উঠেছে সোনার হরিণের মতো। অনেক প্রতিভাবান পেস অলরাউন্ডার জাতীয় দলে আসলেও নিজেদের প্রমান করতে পারেননি সেইভাবে, তাই বাদ পড়েছেন দল থেকে! আর বাংলাদেশ ক্রিকেটেও ঐ জায়গাটি হয়না পূরণ। অবশেষে এক তরুণের হাত ধরে সেই শূন্য স্থানটি পূরণ হতে চলছে!

সময়টা ১৯৯৬ সালের এক নভেম্বর। বাংলাদেশের ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন একটি ছেলে। নাম রাখা হয় মোহাম্মদ সাইফউদ্দীন। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাই স্বপ্ন দেখতেন ছেলেকে মস্ত বড়ো অফিসার বানাবেন! কিন্তু সাইফউদ্দীনের পড়াশোনার প্রতি ছিলো না তেমন আগ্রহ। যেই সময়ে বই খাতা হাতে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই সময় ব্যাট বল নিয়েই সময় কাটাতেন বেশিরভাগ সময়। টিফিনের খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে মেতে উঠতেন ক্রিকেট নিয়ে। ছেলেটির স্বপ্ন ছিলো একদিন লাল-সবুজের জার্সিতে মাঠ মাতাবেন! শুধু তাই নয় রাজত্ব চালাবেন ক্রিকেটের ২২ গজে।

এভাবেই নিজের স্বপ্নকে লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সাইফউদ্দীন। পড়াশোনার থেকে ক্রিকেটেই সময় কাটাতেন তিনি। এরই মাঝে অনেকটা পথ পেরিয়ে গেলো। ছেলেটি নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। লক্ষ্য একটাই হতে হবে সেরাদের একজন; হতে হবে পেস অলরাউন্ডার; শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের। এমন লক্ষ্যে নিজেকে ঠিকই গুছিয়ে নিচ্ছিলেন ছেলেটি। কিন্তু এমন সময় হঠাৎ করেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো তার; ঠিক মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা!

সময়টা ২০০৮ সাল! দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে বিদায় নিলো বাবা। তবে কি এখানেই শেষ হবে ছেলেটির স্বপ্ন? আবারো কি বাংলাদেশ ক্রিকেটের শূন্যস্থানটি অপূরনীয় রয়ে যাবে?

না; যেই ছেলে নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার প্রতিযোগীতায় নেমেছে, যেই ছেলে দেশের সেরা পেস অলরাউন্ডার হবার স্বপ্ন দেখে সে তো এতো সহজে হেরে যাবার পাত্র নন; কিন্তু মাথার উপর থেকে ছায়া সরে গেলে নিজেকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়! ঠিক তেমনটাই হয়েছিলো ছেলেটির। তবে, এমন সময় পাশে পেলো পরিবার; পাশে পেলো প্রিয় ভাই এবং ভালোবাসার ফ্রেন্ডশিপ ক্লাবকে। নিজেকে আবারো গুছিয়ে নিতে থাকলেন ক্রিকেটের ২২ গজে।

এরপরের গল্পটা ছিলো ছেলেটির উত্থানের। সময়টা ২০০৯ সাল, তথা বাবার মৃত্যুর প্রায় ১ বছর পর প্রথমবারের মতো জায়গা হলো বয়সভিত্তিক দল তথা বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৪ দলে। এই শুরু, এরপর ২০১০ এ অনূর্ধ্ব ১৫ দলের হয়ে ভারত সফরে খেলার সুযোগ হয় তার। ২০১১-১২ মৌসুমে জায়গা হয় অনূর্ধ্ব ১৭ দলে। সেখানে নিজেকে দারুণ ভাবে মেলে ধরেন ছেলেটি। জায়গা হয়ে যায় অনূর্ধ্ব ১৯ দলে।

অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে নিজেকে মেলে ধরেন তিনি। বল হাতে মাত্র ৭ ম্যাচে উইকেট শিকার করেন ১৩ টি, এবং ব্যাট হাতে করেন ৭৫! মূলত পেস অলরাউন্ডার এবং ফিনিশিংয়েই দেখা যেতো তাঁকে।

এভাবেই চলতে থাকে ছেলেটির পথচলা। সময়ের সাথে সাথে জায়গা করে নেন বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে। যেখানে নিজের অলরাউন্ডারিং পারফর্ম করে নজরে আসেন নির্বাচকদের। মূলত বিপিএল দিয়েই নিজের জাত চিনিয়েছে তিনি। এরই মাঝে বাংলাদেশ ক্রিকেট এগিয়েছে বহুদূর। কিন্তু আফসোস জাতীয় দলে একটা ভালো পেস অলরাউন্ডার নেই।

একদিন বিকেলে আমি আর রহিম বসে বাংলাদেশের খেলা দেখছিলাম। বিপক্ষ দলে পেস অলরাউন্ডারের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম। তবে সেদিন জয়ের হাসিটি আমরাই হেসেছিলাম। কিন্তু একজন পেস অলরাউন্ডারের সেই আগুনে পারফরম্যান্স দেখে আফসোস করেই বলছিলাম আমাদের দেশে এমন অলরাউন্ডার কবে পাবো?

হয়তো আমাদের এই কথাটি বাতাসের সাথে কানে গিয়েছিলো সেই তরুণ টগবগে যুবকের। তাইতো বাংলাদেশ ক্রিকেটের শূন্যস্থানটি পূরণেই চেষ্টায় মেতে উঠলেন ক্রিকেটের ২২ গজে। ২০১৬ বিপিএলে নিজেকে দারুণ ভাবে মেলে ধরলেন তিনি। তবে, তখনো তিনি একজন পেসার; পেস অলরাউন্ডার নন।

এভাবে কিছুদিন কেটে গেলো। ছেলেটি এবার নিজের অলরাউন্ডারিং পারফরম্যান্স দিয়ে নজক কাড়লেন নির্বাচকদের। জায়গা করে নিলেন লাল-সবুজের ওয়ানডে স্কোয়াডে! সময়টা ছিলো ২০১৭ সাল, আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের ১২৫ তম ওয়ানডে ক্রিকেটার হিসেবে ক্যাপ মাথায় দিলেন ছেলেটি। এর কিছুদিন আগেই জায়গা হয়েছিলো টি-টোয়েন্টি দলে।

ঘরোয়া ক্রিকেট আর বয়স ভিত্তিক দলে দুর্দান্ত পারফর্ম করা সাইফউদ্দীনের জাতীয় দলের জার্সিতে শুরুটা মোটেও ভালো হলো না। যেখানে সবাই পেস অলরাউন্ডার নামক সোনার হরিণের দেখা পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলো ঠিক কয়েকদিনের ব্যবধানে ছেলেটিকে নিয়ে হতাশার গল্প শোনাতে লাগলো। ক্রিকেট পাড়ায় আবারো গুঞ্জন, তাহলে কি বাংলাদেশ ক্রিকেটে সোনার হরিণ নামক পেস অলরাউন্ডারের দেখা মিলবেই না?

এভাবে কিছুদিন কেটে গেলো। ছেলেটিও কেমন জানি আড়ায়ে চলে গেলো, বাংলাদেশ ক্রিকেটে যেনো ছেলেটিকে এখন চেনেই না। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের লিডার পাপন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেই দিলেন ছেলেটি বোলিং ভুলে গেছে!

পাপনের এমন কথা হয়তো শুনে নিয়েছিলো ছেলেটি। তাইতো নিজেকে নিয়ে কাজ করতে থাকলেন আড়ালে। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে এমন ভাবে গুছিয়ে নিলেন, তাতে করে ২০১৯ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে নিজের নামটি রাখতে বাধ্য করলেন নির্বাচকদের।

 

এরপরের গল্পটা শুধুই উত্থানের। ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে বলেন আর বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্ম বলেন! সবখানেই নিজেকে প্রমান করেছেন সাইফউদ্দীন। শুধু তাই নয় আগুনে গতিতে ইয়র্কার দিয়ে তুলে নিয়েছেন বিপক্ষের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের উইকেট। দিন শেষে বাংলাদেশ পেয়েছে সোনার হরিণ নামক পেস অলরাউন্ডারের দিশা।

১৯ এর বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স! স্টার্ক, বোল্ট, রাবদাদের পেছনে ফেলে দ্বিতীয় সেরা ইয়র্কার দেওয়া বোলার বনে গিয়েছিলো বোলিং ভুলে যাওয়া সেই বোলারটি! বড় দলের বিপক্ষে ব্যাটিং না পারা ছেলেটি সেদিন ভারতের সেরা বোলিং লাইনআপের বিরুদ্ধে ক্রিজে ব্যাটিং তাণ্ডব চালিয়ে তুলে নিয়েছিলেন হাফ সেঞ্চুরি।

দিনশেষে নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত; দেশকে দেখাচ্ছে আশার আলো। স্বপ্ন দেখাচ্ছে বিশ্বজয়ের! এখন আমি আর রহিম টিভির সামনে গিয়ে বসে বাংলাদেশের খেলা দেখলে সেদিনের সেই আফসোস গুলো মনে করি বলি রহিম! আমরাও একজন পেস অলরাউন্ডার পেয়েছি! পেয়েছি হেরে না যাওয়া একজন মানবকে! যিনি তার ইয়র্কার বিষে বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের দাবিয়ে রেখে লাল-সবুজের দেশকে জয় এনে দিতে পারবে!

আসলে, ইচ্ছে, নিজের প্রতি বিশ্বাস আর সাধনা থাকলে সবকিছুই সম্ভব! সম্ভব টানা ৫ বলে ৫ ছক্কা হজম করে বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে দ্বিতীয় সেরা ইয়র্কার বোলার হওয়া – বোঝা যাচ্ছে মোহাম্মদ সাইফউদ্দীন নিজের মান আরো বাড়ানোয় চেষ্টার কমতি রাখছেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link