মাথায় কালো টুপি আর গাল ভর্তি দাঁড়ি। স্বাভাবিকের চেয়ে আঙ্গুলগুলোও একটু বড়। যার কারণে সহজেই বলকে নিজের ইশারায় নাচাতে পারতেন। হাতও ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে খানিকটা বড়। কব্জির সাহায্যে ৩৬০° অ্যাঙ্গেলে হাত ঘুরাতে পারতেন এই স্পিনার। ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল একজন মিডিয়াম পেসার হিসেবে। সেখান থেকে কোচের পরামর্শে বনে গেলেন স্পিনার।
পরামর্শ না বলে সফল হবার মন্ত্র বললেই ভাল। এই মন্ত্রতেই তিনি বনে গিয়েছিলেন সে সময়ের অন্যতম সেরা স্পিনার হিসেবে। হতে পারতেন ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরাদের একজন। কিন্তু খামখেয়ালিপনা, আত্মবিশ্বাসের অভাব আর আচরণগত সমস্যার কারণে নিজেকে নিয়ে যেতে পারেননি সেরাদের কাতারে।
ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটার ও সাবেক ইংলিশ কোচ ডানকান ফ্লেচারের কাছে পেয়েছিলেন, ‘বিশ্বসেরা ফিঙ্গার স্পিনারের তকমা।’ তবে ক্রিকেট পাড়ায় দ্য টার্বুনেটর, মন্টি, দ্য পাইথন নামগুলোতেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি।
১৯৭৯ সালে পানেসারের বাবা পরমজিত সিং ও মা গুরশরণ কৌর ভারত ছেড়ে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। সেখানেই জন্ম নেন পানেসার। এরপর স্কুল থেকেই ক্রিকেট শুরু। স্কুল ক্রিকেটে ছিলেন একজন মিডিয়াম পেসার। পরবর্তীতে নর্দাম্পটনশায়ারের কোচিং স্টাফ পল টেলরের পরামর্শে পরবর্তীতে মিডিয়াম পেস থেকে স্পিনার বনে যান পানেসার। ১৬ বছর বয়স থেকে শুরু করেন স্পিনার হিসেবে যাত্রা।
২০০১ সালে লিস্টারশায়ারের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। অভিষেক ম্যাচেই নেন ৮ উইকেট। ওই বছর ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলেন পানেসার। ওই দলের অধিনায়ক ছিলেন ইয়ান বেল।
প্রথম শেণির ক্রিকেটে লিস্টারশায়ারের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে ২০০৫ সালে পানেসারকে জাতীয় দলে নিতে অনেকেই আওয়াজ তোলেন। তবে ব্যাটিংয়ে নড়বড়তা আর বাজে ফিল্ডিংয়ের কারণে বাদ পড়ার সম্ভাবনা ছিল পানেসারের। ব্যাটিংয়ের অবস্থা এতটাই বাজে ছিল যে পানেসারকে এক বলের জন্য স্ট্রাইক দেওয়া মানেও বিপদ। ওই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে তিনি ড্যারেন লেহম্যান অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। তবে আদতে সেটা যে লাভ হয়নি তার প্রমাণ তাঁর হতশ্রী ব্যাটিং পরিসংখ্যান। সেখান থেকে ইয়ান ব্ল্যাকওয়েল, শন উডল, অ্যালেক্স লুডনদের সাথে প্রতিযোগিতা করে জাতীয় দলের স্কোয়াডে সুযোগ পেয়ে গেলেন তিনি।
এরপর ২০০৬ সালে ভারতের বিপক্ষে সিরিজে সুযোগ পান। সেখানেই প্রথম টেস্টে অভিষেক হয় পানেসারের। শচীন টেন্ডুলকারের উইকেট দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা। ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকে প্রথম উইকেটটা ছিল ক্রিকেটটা ছিল ক্রিকেট ঈশ্বর খ্যাত শচীনের। ক্যারিয়ারের শুরুতে ফিল্ডিংয়ের জন্য ছিলেন বেশ সমালোচিত।
ওই বছরের শেষে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ সিরিজে স্কোয়াডে থাকলেও প্রথম দুই টেস্টের একাদশে সুযোগ হচ্ছিল না পানেসারের। এরপর এই স্পিনারকে একাদশে নিতে বিবিসি রেডিও ফাইভ থেকে লাইভে একটি পিটিশন করা হয়! এরপর পার্থে তৃতীয় টেস্টে সুযোগ পান তিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট। প্রথম ইনিংসেই সবার আস্থার মূল্য দিয়ে শিকার করেন পাঁচ উইকেট।
প্রথম ইংলিশ স্পিনার হিসেবে পার্থে পাঁচ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েন পানেসার। ওই সিরিজে যৌথভাবে তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন তিনি।
ক্যারিয়ারের প্রথম ১৯ টেস্টে ২৮ গড়ে ৭১ উইকেট নেন এই বাঁ-হাতি স্পিনার। বোলিং প্রতিভা দিয়েই নজর কাঁড়েন সবার। মিডিয়া থেকে শুরু করে সমর্থকরাও তখন মন্টির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পানেসারের ক্যারিয়ার সামনে এগোলেও নিজের সমস্যা কিংবা ভুল থেকে তিনি শিখতে পারেননি। কিংবদন্তি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন বলেছিলেন, ‘ পানেসার ৩৩ টেস্ট খেলেনি, এক ম্যাচই ৩৩ বার খেলেছে। ‘
এরপর ২০০৭ সালে কমওয়েলথ ব্যাংক সিরিজে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় পানেসারের। সেবার অ্যাশেজ সিরিজের পারফরম্যান্স দিয়ে সুযোগ পেয়ে যান ২০০৭ বিশ্বকাপে। ৪০.৪২ গড়ে শিকার করেন মোটে সাত উইকেট। তবে ওই বছর ওভারঅল পারফরম্যান্সটা নজর কাঁড়া হওয়ায় উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ারের পুরষ্কার জেতেন তিনি। তবে ওয়ানডে ক্যারিয়ারটা সীমাবদ্ধ ছিল ওই এক বছরেই! ২৬ ওয়ানডেতে ৪.৫ ইকোনমিতে ২৪ উইকেট নেওয়ার পর বাদ পড়েন দল থেকে। আর রঙিন পোশাকে ফিরতে পারেননি তিনি।
ওই বছরই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি অভিষেক হলেও ৪ ওভারে ৪০ রানে ২ উইকেট শিকারের পর বাদ পড়েন দল থেকে। টি-টোয়েন্টিতে আর নিজের জায়গা খুঁজে পাননি পানেসার। তবে টেস্টে ছিলেন নিয়মিত মুখ, দলের অন্যতম এক আস্থা।
২০০৯ সালের লর্ডস টেস্টের পর ব্যক্তিগত কারণে সিরিজের মাঝ পথেই বাড়ি ফেরেন পানেসার। এরপর প্রায় তিন বছর আর দলেই জায়গা মেলাতে পারেননি তিনি। আচরণগত সমস্যা, ব্যক্তিগত বিভিন্ন সমস্যার কারণে নর্দাম্পটনশায়ারের সাথেও চুক্তি ভঙ্গ হয় পানেসারের। এরপর ওই বছরের শেষে যোগ দেন সাসেক্সে।
২০১২ সালে সমারসেটের বিপক্ষে ম্যাচে ১৩৭ রানে ক্যারিয়ার সেরা ১৩ উইকেট শিকার করেন তিনি। ফিল টাফনেলের পর প্রথম ইংলিশ স্পিনার হিসেবে শিকার করেন দশ উইকেট। এরপর আবার জাতীয় দলে সাদা পোশাকে সুযোগ পান পানেসার। প্রত্যাবর্তনটাও ছিল দেখার মত। ওই বছর ৬ টেস্টে চারবার শিকার করেন পাঁচ উইকেট, একবার দশ উইকেট। ছয় টেস্টে ৩৩ উইকেট নিয়ে দুর্দান্ত এক প্রত্যাবর্তন করেন পানেসার।
তবে হুট করেই পরের বছর আবার গড়পড়তা। ৭৬ গড়ে মাত্র আট উইকেট নেওয়ার পরই বাদ পড়লেন দল থেকে। গ্রায়েম সোয়ান থাকায় আর দলে সুযোগ পাননি তিনি।
খেলেছেন ৫০ টেস্ট এই ৫০ টেস্টে ২০ বার তিনি ফিরেছেন শূন্য রানে! ৪.৮৯ গড়ে রান মাত্র ২২০। এই পরিসংখ্যানই যথেষ্ট ব্যাট হাতে পানেসার লোয়ার অর্ডারে কতটুক অবদান রাখতে পারতেন। ৫০ টেস্টে শিকার করেন ১৬৭ উইকেট। সাদা পোশাকে বল হাতে তিনি অনেকটাই দুর্দান্ত ছিলেন সে নিয়ে সংশয় থাকার কথা না। তবে হতশ্রী ব্যাটিং আর ফিল্ডিংয়ের জন্য তিনি বরাবরই সমালোচিত ছিলেন।