১.
পাশাপাশি দু’জন বসে আছেন। কঠিন পরিস্থিতিতে ঝুলছে ওয়ানডে ম্যাচের ভাগ্য। ডাগআউট থেকে দুজনেরই চিন্তামগ্ন নজর মাঠের দিকে।
‘কী মনে হচ্ছে? এখান থেকে পারবে জেতাতে?’
‘প্রথম ১৩ টা বল যদি ঠিকঠাক খেলতে পারি জিতিয়ে দেব…’
চমকে ওঠেন প্রথম ব্যাক্তি। বিশ্ব ক্রিকেটের তাবড় তাবড় ক্রিকেটার যাঁর হাত থেকে বেড়িয়েছেন তিনি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন পাশের তরুণ তুর্কি ছেলেটার দিকে। এত সংখ্যা থাকতে খামোকা ১৩ কেন?
দুই গোলার্ধের দুই মহাদেশ। দুই প্রজন্মের দুই ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক। অথচ কি অদ্ভুত মিল!
প্রথমজন গুরু গ্রেগ, দ্বিতীয় জন মহেন্দ্র সিং ধোনি। অজি মিডিয়া গ্রেগের প্রতি চিরকাল দূর্বল। গ্রেগের মানসিকতাই হল বেপরোয়া, সিনিয়র-জুনিয়র মানার কোনো গল্প নেই, কড়া রাফ অ্যান্ড টাফ ক্যাপ্টেন, তেমনই অধিনায়ক, জিততে হবে, এর চেয়ে বড় আর কিছু নেই। পন্টিং-এর মধ্যে খুব ছোটো থেকেই এই মন্ত্র ইঞ্জেক্ট করেছেন গ্রেগ। খেলতে পারলে থাকবে, নইলে আউট!
আর অদ্ভুতভাবে আসমুদ্রহিমাচলের বুকে যেন একফোঁটা অজি রক্ত নিয়ে জন্মেছিলেন এক ক্রিকেট জিনিয়াস, যিনি অজি ক্রিকেট সাম্রাজ্যের হলদে পৃথিবীকে শুধু এই একটি মানসিকতা দিয়েই কিছুদিনের জন্য আড়াআড়ি চিরে দিয়ে তার ভেতর ভরে দেন অবহেলিত-নিপীড়িত তৃতীয়বিশ্বের এক ক্রিকেটপাগল জাতির নীল নকশা!
শুধুই কি অজি মানসিকতা? ঐ যে ১৩-কেন তাঁর রহস্য গ্রেগও বুঝলেন না- ১৭ বছর ধরে বুঝলো না কেউ, শুধু বিস্ময় লেগে রইল পরতে পরতে।
কে? কী? কেন? – এই তিন প্রশ্নের ওপর দাঁড়িয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের আজন্ম বিস্ময়, এই তিনপ্রশ্নের আদিম রহস্য নিয়ে তিনি শান্ত চাকুর মতো মস্তিষ্কে যেমন একটার পর একটা ম্যাচ প্রতিপক্ষের হাত থেকে বের করেছেন- আর বিদায়লগ্নেও যে তার ব্যতিক্রম হবে না সে ললাটলিখন পড়ে ফেলেছে ইতিহাস।
২.
বিশ্বকাপ চলছে। ২০১৯। স্বয়ং শচীন টেন্ডুলকার সেভাবে প্রকাশ্যে বলেন না কোনো ব্যাটসম্যানের খারাপ ফর্ম প্রসঙ্গে। তবু এজবাস্টন থেকে প্রেসের সামনে বলেই ফেললেন ধোনির মন্থর ব্যাটিং-এর কথা। এদিকে ব্রিটিশ মিডিয়া থেকে খাস কলকাতায় ক্রীড়া সাংবাদিকদের কলমের কালি প্রায় শেষ, ধোনি যেন শরশয্যায় শুয়ে থাকা ভীষ্ম, স্বেচ্ছামৃত্যুর বরদানের পরেও যাঁকে নিয়েই যাবতীয় আলোচনা।
ফিটনেস-মেন্টালিটি-পারফরমেন্স এই তিনটি ছুরির ফলায় আজন্ম শাণ দিয়েছেন ধোনি। ডানাকাটা পড়েছে বহু সিনিয়র ক্রিকেটারের। সে বিতর্ক থাকবে। তবু প্রেস মিটে অবলীলায় যিনি বলেন – ‘আমার টিম আমি ঠিক করব, বাকি কে কী ভাবল কিস্যু যায় আসে না’, তাঁকে নিজের ক্যারিয়ারের শেষে এমন আক্রমণ করা হবে সেটা কি খুব অস্বাভাবিক?
তবে ভুলটা করলেন এক ক্রিকেট লিখিয়ে। ধোনিকে প্রকাশ্যে লিখে দিলেন স্বার্থপর। এ প্রসঙ্গে দুটো ছোট্ট পরিসংখ্যান। ধোনির টেস্ট অবসরের সময়ে টেস্ট খেলার সংখ্যা ৯০, জাতীয় দলের হয়ে ১০০ টেস্টের বিরল রেকর্ড থেকে দশম্যাচ দূরে ছেড়ে দিলেন টেস্ট। ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন্সি ছাড়লেন যখন সংখ্যাটা ১৯৯!
স্বার্থপর? বিতর্ক থাকুক!
৩.
সেদিন রাতে ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ। বিশ্বকাপের মাঝে কেউ যেন ধাক্কা দিল মাঝরাতে। যে ধোনি চিরকাল বেপরোয়া তাঁর অবসর নিয়ে এত জল্পনা কেন?
মনে হল এ ভয় যেন ঘিরে ধরছে একটা জাতিকে। ধোনির অবসর মানে কি একটা ঊনচল্লিশের বুড়োর বাইশগজ থেকে সরে যাওয়া? নাকি ভারতীয় ক্রিকেটের সৌভাগ্যরেখাটাই বিলীন হয়ে যাওয়া? কীসের এত আঁকড়ে থাকা লোকটার? ধোনির ক্যাপ্টেন হওয়া প্রসঙ্গে বলা হয় ‘অ্যান অ্যাক্সিডেন্টাল ক্যাপ্টেন’, যুবরাজ বা শেবাগের ওপরে তাঁকে ক্রিকেট ঈশ্বর তুলে দিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে ভারি ব্যাটন।
সৌরভ যদি কর্ণ হন, যদি শ্রেষ্ঠতম হওয়ার শেষধাপে বারেবারে বসে যায় তাঁর রথের চাকা, তবে ধোনি সেই সৌরভের আত্মার ওপর বসানো এক রক্তমাংসের মানুষ যাঁর হাতে বিধাতা তুলে দিয়েছিলেন অব্যর্থ গাণ্ডীব!
সেই লক্ষ্য ভেদের পরতে পরতে ধন্য হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট, সৌরভের বুকে করে বয়ে আনা পলি,তাঁর লড়াই-এর শেষ রক্তবিন্দুর ওপরই ভারতীয় ক্রিকেটের ইমারত গড়েছেন মাহি, ২০০৭-এর পর বেপরোয়া অজিদের দৌরাত্ম থামিয়ে তিনটে আইসিসি টুর্নামেন্ট জিতে ভারতীয় ক্রিকেটের সাজানো প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি!
আজও যখন একটার পর একটা আইসিসি টুর্ণামেন্ট থেকে খালি হাতে ফিরতে হয় ভারতকে তখন যেন আরও মৌন হয়ে যান ভারতীয় ক্রিকেটের জীবন্ত বিস্ময়, পুরোনো ইতিহাসের দলিলে বাঁচার লোক নন তিনি, এখনো একটা সিক্সথ সেন্স ট্রিগার করলে ডানা ঝাপটে ওঠেন বৃদ্ধ জটায়ু, একটা হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া ম্যাচ দেখলেই হাতটা শক্ত করে ফেলে মুঠি।
ভারতীয় ক্রিকেটের সেই অক্ষয় মালবেরি গাছের ছায়া থেকে যেন একযুগ ধরে ভেসে আসছিল একটার পর একটা সুখবর, অনেকদিনের সুর জমা গীটারে যেন প্লেকট্রাম ছোঁয়ালেন মাহি, ভারতের অন্ধকার আকাশ আলো হয়ে উঠল অচিরেই।
মাহি কোনোদিন বলবেন না কোন বিধাতা লেখেন তাঁর ললাটলিখন, তবু তিনি দিনশেষে যেন এক মুহূর্তের কবি, যেন সেই শেষ ওভারে যোগিন্দর শর্মার হাতে বল তুলে দেওয়ার মতো বেপরোয়া, যেন নিজেকে বিশ্বকাপ ফাইনালে ওপরে তুলে আনার মতো স্থিতধী, যেন মুশফিকুরের উচ্ছ্বাসের পাশে শান্ত হয়ে বসে থাকা মাসাইমারার সিংহ – আর এই মুহূর্তগুলোই তিনি কবিতার মতো ভরেছেন, ভরেছেন দেবযান লেখা কোনো অদৃশ্য খামে, যার সুধাস্তন্যে ধন্য, ধন্য হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট সভ্যতা।