মহেন্দ্র সিং ধোনির সাহচর্য বেশ কয়েকটি ভূমিকাতেই পেয়েছেন মাইকেল হাসি। কখনো প্রতিপক্ষ, কখনো সতীর্থ কখনো বা কোচ-শীষ্য, বিভিন্ন রূপেই এই দু’জন এক হয়েছেন। ফলে বলা যায়, ধোনিকে আন্তর্জাতিক ময়দানে যাদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে – তাঁদের একজন হলেন অস্ট্রেলিয়ার এই সাবেক ক্রিকেটার। তিনি সম্প্রতি ধোনিকে নিয়ে বিরাট এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ক্রিকেট বিষয়ক গণমাধ্যম ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে।
আপনি যেসব ক্রিকেটারের সাথে বা বিপক্ষে খেলেছেন বা অধিনায়কের অধীনে খেলেছেন, তাদের মধ্যে মহেন্দ্র সিং ধোনি কি অনন্য?
মাইক হাসি: সম্ভবত, কেননা সে যতটা শান্ত বিশেষ করে ভারতের মতো জায়গায় যেখানে ভক্তরা ও মিডিয়া ক্রিকেটারদের সাথে খুব পাগলামি আচরণ করে থাকে। সাধারণত আমি যেসব অধিনায়কের বিপক্ষে খেলেছি তাঁরা খুব বেশি আক্রমণাত্মক ছিলেন না। তবে তাঁরা সোচ্চার ছিলেন এবং দুর্দান্ত নেতৃত্বগুণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁরা যেকোনো বিষয়কে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন যেখানে ধোনি খুব শান্ত ও শীতল থাকে। খেলোয়াড়দের বিশেষত তরুণ ভারতীয় খেলোয়াড়দের চাপমুক্ত রাখার দারুণ ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। বেশিরভাগ সময় সে তাঁদের চিন্তামুক্ত থাকতে বলে। মাঠে গিয়ে শুধু নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পরামর্শ দেয়। এতে কোনোদিন সফলতা মিলবে আবার কোনোদিন মিলবে ব্যর্থতা। তাতে চিন্তার কিছু নেই। অস্ট্রেলিয়ায় আমি এর আগে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তার থেকে ধোনির অধীনে খেলাটা খুব আলাদা ছিল।
মাঠে তিনি কি কখনও মেজাজ হারাননি?
মাইক হাসি: আমার মনে হয় আমি চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে যতদিন খেলেছি তার মধ্যে কেবল একদিন ধোনিকে মেজাজ হারাতে দেখেছি। কিছু সময় আছে যখন সেও হতাশ হয়ে পড়ে। দল যখন হারতে থাকে তখন প্রত্যেকেই হতাশ হন। কিন্তু ধোনি প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি নয়। সে সবসময় বড় পরিসরে চিন্তা করে থাকে। কয়েকটা ম্যাচ হারার জন্য বা নামেমাত্র পরিবর্তন করার জন্য দলে কোনো পরিবর্তন আনে না সে। এটি তাঁর নেতৃত্বের একটি শক্তি ছিল এবং এটি অবশ্যই অন্য খেলোয়াড়দের বিশ্বাস, আস্থা ও সমর্থন জুগিয়েছিল।
ধোনির মেজাজ হারানোর ম্যাচটি কি রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে ছিল যেখানে আম্পায়ারদের সাথে তর্ক করতে তিনি উইকেটে গিয়েছিলেন?
মাইক হাসি: মজার ব্যাপার হলো ওই ম্যাচের পরও সে খুব শান্ত ও শীতল ছিল। এমনকি ওই ঘটনা নিয়ে সে একটি কৌতুকও ফাঁদে যা ছিল তাঁর চরিত্রের বিপরীত। আমরা তাঁর পাশে বসেও এটা বিশ্বাস করতে পারিনি।
না, দুবছর আগে একটি খেলায় মেজাজ হারায় ধোনি। তখন সে রান পাচ্ছিল না এবং দলও খারাপ খেলছিল। মাঠে সতীর্থদের প্রচেষ্টায়ও সন্তুষ্ট ছিল না সে। তখন সবাইকে মাঠে আরও বেশি নিজেদের নিংড়ে দেওয়ার আহ্বান জানায় ধোনি। ফলাফল কী হবে তা নিয়ে না ভেবে বরং আমাদের চেষ্টা নিয়ে ভাবতে বলে।
সর্বদা শান্ত থাকার গুণটা কি শুরু থেকেই তাঁর নেতৃত্বের অংশ ছিল? না কি বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা বিকশিত হয়েছিল?
মাইক হাসি: আমি মনে করি এটা সবসময় ছিল। আমি সেই সময়টার কথা বলছি যখন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তাঁর বিপক্ষে আমি খেলতাম। সে সবসময় একধাপ এগিয়ে ছিল। সে এমন কিছু চেষ্টা চালাত যা কিছুটা অপ্রচলিত ছিল। তখন আমরা ভাবতাম সে এটি কেন করছে? প্রায়শই সে সফল হতো এবং আমরা ভাবতাম, ‘এটা করাটা অবিশ্বাস্য দূরদর্শিতা ছিল।’
ধোনি বলেছেন পরিসংখ্যানে তিনি বিশ্বাস করেন না। এ সম্পর্কে আপনার মতামত?
মাইক হাসি: আমার মতে সে খুব বুদ্ধিমান ও ভালো পর্যবেক্ষক। খেলায় কী ঘটছে তা খুব ভালো উপলব্ধি করতে পারে সে। ধোনি অত্যন্ত ভালোভাবে ম্যাচ পড়তে পারে এবং তা নিজে নিজে। সে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তবে তা পরিবর্তন করতে অনেক সময় লাগবে। তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে আপনাকে এমন একজন হতে হবে যাঁকে সে সত্যিকার অর্থে সম্মান ও বিশ্বাস করে।
তিনি ফিরে এসে কখনও কি স্বীকার করেছেন যে তাঁর কোনো চেষ্টা সফল হয়নি?
মাইক হাসি: এমএস ধোনি অত্যন্ত বিনয়ী একজন মানুষ। সে নিজেকে মোটেও বড় করে দেখে না। সে অহংকারী নয় যা তাঁর অনেকগুলো গুণের মধ্যে একটি। সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতার সময় সে নিজেকে যেভাবে পরিচালিত করে তা প্রশংসাযোগ্য। সে সবসময় অবিচলিত থাকে। যখন সবকিছু ভালো যায় তখন সে অতিরিক্ত আত্মতুষ্টিতে ভুগে না। আবার যখন সময় খারাপ
যায় তখন খুব বেশি হতাশায় আক্রান্ত হয় না। সে সর্বদা সবাইকে সমান চোখে দেখে। রুমে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে সে যেমন ব্যবহার করে, দিনশেষে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সাথে তার ব্যতিক্রম কিছু করে না।
কোনো বড় খেলা বা ফাইনালের আগে তিনি কি অন্যরকম থাকতেন?
মাইক হাসি: হোক ফাইনাল বা অন্য কোনো ম্যাচ, সে সবসময় একইরকম। এতটুকু আমি অনুভব করেছি যে, মাঝেমাঝে সে খুবই স্বস্তিতে থাকে (হাসি)। এমনকি ফাইনালের সময় সাইডলাইনে বসে সে ঠাণ্ডা মাথায় শুধু খেলা দেখে যায় আর আমরা ভাবি, ‘এই লোকটার কি কোনো আবেগ নেই!’
আমার মনে পড়ে চেন্নাইয়ে ব্যাঙ্গালুরু বিপক্ষে আমাদের একটি বড় খেলা ছিল। ওই ম্যাচে মাঠে নামার আগে আমরা সবাই একত্রিত হই এবং ধোনি আমাদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘আজ আরসিবির বিপক্ষে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ খেলা। তবে ফেয়ার প্লে অ্যাওয়ার্ডটিও আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে আমরা যথার্থ চেতনার সাথে খেলাটি খেলব যাতে ফেয়ার প্লের পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে পারি।’ আমার মনে আছে আমি তাঁর দিকে শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলা এবং এ খেলায় আমাদের জিততেই হবে। কিন্তু খেলাটি সঠিক উদ্দীপনায় খেলার ব্যাপারে ধোনি ছিল আপোষহীন। সে সবসময় চাইত আমাদের দল এমন একটা দল হিসেবে পরিচিতি পাক যা ফলাফলের পাশাপাশি ফেয়ার প্লেতেও অন্যদের চেয়ে ভালো।
দলের উদ্দেশ্যে ম্যাচ পূর্ববর্তী আলাপে তিনি সাধারণত কী বলে থাকতেন?
মাইক হাসি: ম্যাচের আগে আমাদের প্রস্তুতিমূলক সভা বা এরকম কিছু খুব একটা হতো না। তবে মাঠে নামার ঠিক আগমুহূর্তে কয়েক মিনিট কথা হতো। সে মূলত কয়েকটা দিকনির্দেশনা দিত তবে বেশিরভাগক্ষেত্রেই সেটা খেলোয়াড়দের চাপমুক্ত রাখার জন্য। কোনো একটি ম্যাচের আগে একটি কথপোকথনের কথা আমি মনে করতে পারি এবং সেটি ছিল এরকম, ‘তোমরা শুধু মাঠে যাও, খেলো আর দর্শকদের দিকে হাসিমুখ করে তাকাও। কোনোদিন তুমি জিতবে, কোনোদিন তুমি হারবে। সাধ্যমতো শুধু নিজের দক্ষতার সেরাটুকু মাঠে প্রয়োগ কোরো।’ এর পর আমি বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের ওপর থেকে চাপ প্রশমিত হতে দেখতে পাই।
ধোনিকে এমন কিছু সম্পর্কে আপনি কীভাবে বুঝাতেন যা তিনি বিশ্বাস করতেন না?
মাইক হাসি: আমার একটি উপলক্ষ্য মনে আছে। সেটা ছিল কোচ হিসেবে সিএসকেতে আমার প্রথম বছর। প্লে অফের কোয়ালিফায়ারে আমরা সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিপক্ষে খেলতে যাচ্ছিলাম। আমাদের বিশ্লেষক রশিদ খানের দুটো দুর্দান্ত ছবি পেয়েছিলেন। তিনি কম্পিউটারের পর্দা দুই ভাগ করে ছবি দুটো স্থাপন করেন। তারপর ছবি দুটোতে দেখান, রশিদ খান যখন লেগস্পিন করেন তখন তাঁর গ্রিপ কেমন থাকে আর যখন গুগলি ছাড়েন তখন তাঁর গ্রিপ কেমন হয়। আমি এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ভাবছিলাম কী করব! আমি কি এই বড় ম্যাচের আগের রাতে ব্যাটসম্যানদের কাছে উক্ত তথ্য পাঠিয়ে দিব না কি তা এড়িয়ে যাব?
অতঃপর তথ্যটি আমি পাঠিয়ে দিই এবং একটি বার্তায় বলে দিই যে, কারো ইচ্ছা হলে সে তথ্যটি ব্যবহার করতে পারে৷ আমি ধোনির কাছ থেকে কোনো ফিরতি বার্তা পাইনি যা তাঁর কাছ থেকে খুব কমই পেয়ে থাকি।
হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে ওই ম্যাচে রান তাড়া করার সময় বেশ কয়েকটি উইকেট হারিয়ে আমরা চাপে পড়ে যাই। প্রয়োজনীয় রান রেটও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল। তখন ধোনি ব্যাট করতে নামে এবং রশিদ খানের মুখোমুখি হয়। রশিদের একটি রংওয়ান ধোনি কাভার ড্রাইভ করতে গেলে তা ব্যাট ও প্যাডের ফাঁকা দিয়ে ঢুকে উইকেট ভেঙ্গে ফেলে। সে মাঠ ছাড়ার পর সরাসরি আমার কাছে আসে এবং বলে, ‘আমি নিজের মতো করেই ব্যাট করব। ধন্যবাদ।’
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের মাঝভাগে এটা শুনে আমি কিছুটা উদ্বিগ্ন হই। তবে তাঁর সাথে পরে কথা বলে বেশ স্বস্তি পাই। সে বলেছিল, ‘না, তথ্যটি সঠিক ছিল৷ কিন্তু তা অনুশীলনের জন্য যথেষ্ট সুযোগ আমি পাইনি। যদি আবারও আমি সময় পাই তখন অবশ্যই এই তথ্যটি আমাকে দিবে। রশিদ দৌড়ে আসার সময় আমি তাঁর গ্রিপ দেখে নিয়েছিলাম। তারপর আর বলটি দেখার বিষয়ে মাথা ঘামাইনি। যদি নেটে এটি অনুশীলন করার সুযোগ পেতাম তাহলে আমি জানতাম যে, বলটি হাত থেকে ছোড়ার সময়ও আমাকে নজর রাখতে হবে এবং সে অনুসারে খেলতে হবে।’
ধোনি যখন ব্যাটিংয়ে নামে তখন উইকেটে থিতু হতে একটু সময় নিয়ে থাকে। আমরা প্রায়ই তাকে উৎসাহিত করতাম আরও তাড়াতাড়ি বোলারদের ওপর চড়াও হতে। সে তা করতে চাইত। কিন্তু যেহেতু তাঁর খেলার নিজস্ব একটি ধরন আছে এবং তাতে সে অভ্যস্ত সেহেতু শুরুতেই চড়াও হয়ে না খেলে বরং দায়িত্ব নিয়ে শেষ পর্যন্ত উইকেটে থেকে ম্যাচটি জিতিয়ে মাঠ ছাড়তে চাইত সে। এটাই হচ্ছে ধোনি।
ক্যারিয়ারের শেষের দিকে উইকেটে থিতু হতে ধোনির বেশি সময় নেওয়া বা মেরে খেলার সক্ষমতা নিয়ে যে কথাগুলো ওঠেছিল সেগুলো সম্পর্কে কি তাঁর সাথে আলোচনা হয়েছে?
মাইক হাসি: না। আসলেই না এবং আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করিনি। কারণ আইপিএলে গত দুবছরে সে সম্ভবত তাঁর সেরা সময় পার করেছে। সমালোচনাগুলো মূলত ভারতের হয়ে তাঁর ওয়ানডে খেলার সময় বেশি হয়েছে যেখানে উইকেটে থিতু হতে সম্ভবত বেশি সময় নিত সে।
তাঁকে একজন বিরোধী খেলোয়াড় হিসেবে আপনি কীভাবে দেখতেন এবং তাঁকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জানার পর সে দৃষ্টিভঙ্গিতে কীরূপ পরিবর্তন হয়েছিল?
মাইক হাসি: ধোনি যতটা শান্ত ও স্বাচ্ছন্দ্যময় তা আমি বিশ্বাসই করতে পারি না। একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে আমি মনে করি সবসময় খেলোয়াড়দের ওপর মানসিক চাপ থাকে বিশেষত ভারতের মতো জায়গায় যেখানে সবাই ক্রিকেটপাগল। সত্যি বলতে আমি বিশ্বাস করি একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে খেলাটি তাঁর কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। খেলা নিয়ে সে খুব বেশি সতর্ক ও যত্নশীল তাও মনে হয়নি। এটা ছিল অনেকটা এরকম- চলো মাঠে যাই এবং খেলাটা খেলি। আমরা খেলাটি ভালোবাসি এবং সেজন্য খেলি৷ সে নিজে অনেক চাপ নিয়ে ফেলে এমনটি কখনও মনে হয়নি। তাঁর সাথে একই সাজঘরে সময় কাটানোর আগ পর্যন্ত আমি তা বুঝতে পারিনি। আসলে এভাবেই সে জীবনধারণ করত এবং এগুলাই ছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি।
আপনি কি মনে করেন তিনি জেতা বা হারার ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন না?
মাইক হাসি: এটা বলাটা খুব কঠিন। প্রকৃতপক্ষে আমি মনে করি সে ভিতরে ভিতরে এ বিষয়ে অবিশ্বাস্য রকমের যত্নশীল ছিল কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করত না। আমি আসলে জানি না। এটা ধোনিকে জিজ্ঞেস করতে হবে। তবে একজন শীর্ষ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে সে যেভাবে মানসিক চাপ সামলেছে বিশেষত ভারতে তা এককথায় বিস্ময়কর।
ধোনি যদি সেরা দল নাও পান, তিনি এমন কিছু খেলোয়াড় পান যাঁরা তাঁর জন্য ভালো পারফর্ম করেন। এটা এমন একটা ব্যাপার যা পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আপনি কী মনে করেন?
মাইক হাসি: আমি মনে করি একটি বিজয়ী দল কীভাবে কাজ করে এবং একটি দলকে বিজয়ী করতে কীভাবে দলের সবাইকে একত্রিত করে রাখতে হয় সে সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। এর একটি দিক হলো সে খেলোয়াড়দের অনেক বিশ্বাস করে এবং তাদেরকে প্রচুর সমর্থন দেয়। এমনকি আপনি যদি বেশ কয়েকটা ইনিংসে খারাপ খেলেন তারপরেও সে আপনাকে একাদশে রাখবে এবং আপনার প্রতি আস্থাশীল থাকবে। এটি আপনার নিজের ওপর বিশ্বাস অটুট রাখতে সাহায্য করবে। আপনি তখন বিশ্বাস করবেন যে, আপনাকে মাঠে যেতে হবে এবং তাঁর জন্য খেলতে হবে কারণ সে আপনাকে প্রচুর সমর্থন জুগিয়েছে।
এর অন্য দিকটি হলো সে খেলোয়াড়দের খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। কীভাবে একজন ভালো খেলোয়াড়কে বেছে নিতে হয় সে তা জানে। একজন ভালো খেলোয়াড়কে সে খুব দ্রুত সনাক্ত করতে পারে এবং দলে ভিড়িয়ে আনে।
মাঠের বাইরে ক্রিকেট নিয়ে তিনি কতটা কথা বলেন?
মাইক হাসি: মোটামুটি। সারাদিন সারারাত ক্রিকেট নিয়ে কথা বলে এমন নয়। তাঁর রুম প্রায় ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকত। সেখানে আপনি দেখতে পাবেন খেলোয়াড়রা খাবার ভাগ করে খাচ্ছে অথবা গোল হয়ে বসে সবাই আড্ডা মারছে। তাঁর টেলিভিশনে সবসময় ক্রিকেট চলত। সে খেলাটি দেখতে খুব পছন্দ করত। সেখান থেকে কিছু ছোট ছোট জিনিস সে গ্রহণ করত এবং সেগুলো সম্পর্কে কথা বলত। সে কীভাবে খেলাটি দেখছে এবং এটি সম্পর্কে কী বলছে তা খুব উপলব্ধিযোগ্য ছিল।
ডাগআউটে বসে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করতেন কি?
মাইক হাসি: আসলে তা না। তবে মাঠের মধ্যে করত। তাঁর সাথে আমার বেশ কয়েকবার ব্যাটিং করা হয়েছে৷ আমি উইকেটে একটু আতঙ্কিত থাকি। কিন্তু দিনশেষে একটুও আতঙ্কিত না হওয়ার শক্তিটা ধোনির মধ্যে ছিল বলে আমার ধারণা। সে প্রায়শই বলত, যে আতঙ্কিত থাকবে শেষ পর্যন্ত সে-ই ম্যাচ জিতবে।
কোন সময়ে কোন বোলার কীভাবে বোলিং করবে তা খুব ভালো বুঝতে পারত ধোনি এবং বলত, ‘তাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না৷ আমি তাঁর মুখোমুখি হব যেহেতু সে জানে না আমার বিপক্ষে কোথায় বল করতে হবে। তুমি অমুককে লক্ষ্য বানিয়ে মেরে খেলতে পারো।’ এভাবে সে সব ছক কষে ফেলত।
ধোনি না কি রিকি পন্টিং? আপনি তো দুজনের অধীনেই খেলেছেন।
মাইক হাসি: তাদেরকে এক, দুইয়ের র্যাঙ্কে ফেলা খুব কঠিন। আমি যাদের অধিনায়কত্বে খেলেছি তাঁদের মধ্যে এ দুজন অবশ্যই সেরা। বিভিন্ন দিক দিয়ে তাঁরা দুজনই ভিন্ন। তবে কিছু দিক আছে যেখানে তাঁদের খুব মিল রয়েছে। তাঁরা উভয়ই খেলাটি খুব ভালো বুঝে এবং খুব ভালো করে ম্যাচ পড়তে পারে৷ তাঁরা যেভাবে খেলোয়াড়দের বিশ্বাস ও সমর্থন করে তাতে আপনি ভাববেন তাঁরা আপনার পাশে আছে এবং আপনার জন্য লড়াই করছে। পার্থক্যটা হচ্ছে রিকির মনোভাব খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং সে জয় ছাড়া ভিন্ন কিছু ভাবতে পারে না৷ সেইসাথে মাঝেমাঝে সে সম্পূর্ণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে যেখানে ধোনি খুবই শান্ত।
ধোনির কি খুব ভালো ‘সেন্স অব হিউমার’ আছে?
মাইক হাসি: হ্যাঁ, বেশ উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সে।
তিনি কি প্র্যাঙ্কস্টার?
মাইক হাসি: সত্যিকার অর্থে প্র্যাঙ্কস্টার না। তবে তাঁর ও সাক্ষীর (ধোনির স্ত্রী) মধ্যকার সম্পর্কটি বেশ মজার। তাঁদের দুজনের খুনসুটি আমি খুব পছন্দ করি। দুষ্টুমির ক্ষেত্রে সাক্ষী তাকে ছেড়ে কথা বলে না। ধোনির দুষ্টুমির পালটা জবাবও দেয় সাক্ষী যা খুবই মজার। তাদের সম্পর্কটা দুর্দান্ত। এটা দেখতেও আকর্ষণীয়।
দলের তরুণ খেলোয়াড়েরা কি প্রথম থেকেই তাকে পছন্দ করতে শুরু করে?
মাইক হাসি: আমি মনে করি তাঁরা শুরুর দিকে একটু লজ্জা ও ভয়ে থাকে। তবে দলের সবার সাথে ধোনিকে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যময় হিসেবে যখন দেখতে পায় তাঁরা তখন তাঁদের সব ভয় ভেঙ্গে যায়।
প্রতি আইপিএলে ম্যাচের পর বিপক্ষ দলের একজন বা দুজন তরুণ ক্রিকেটার সাজঘরে এসে নিজেদের পারফরম্যান্স এবং খেলার উন্নতিতে কী করণীয় তা নিয়ে ধোনির সাথে কথা বলতে চাইত। ধোনিও উৎসাহের সাথে তাদের বেশ সময় দিত। সে সবসময় তরুণদের তাঁর পাশে বসে কথা বলতে উৎসাহিত করত।
ধোনি কি স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের কাছ থেকে সম্মান পেতেন? তিনি কি সেসব অধিনায়কদের মধ্যে একজন যাঁর সাথে খুব সহজেই অন্যান্যরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন?
মাইক হাসি: সন্দেহাতীতভাবে। এটার কারণ মাঠ ও মাঠের বাইরে ধোনির চালচলন। সে নিজের অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে মনে হয়।
এর আরেকটি দিক হলো ভারত দলের অন্যান্য সিনিয়রদের বাইরে থেকে দেখে বুঝা যায় তাঁরা ধোনিকে বেশ সম্মান করেন। শচীন, দ্রাবিড়, ভিভিএস, জহির খান ও হরভজনের মতো সিনিয়ররা। তাঁরা প্রত্যেকেই ধোনির প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল বলে মনে হয়েছিল। ধোনির নেতৃত্বে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার পাশাপাশি টেস্টে বিশ্বের এক নম্বর দলে পরিণত হয় ভারত। এই ফলাফলগুলোও সিনিয়রদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে সাহায্য করেছে তাঁকে।
আপনি কি ভাবেন যে, ধোনি তাঁর উত্তরাধিকার রেখে গেছেন?
মাইক হাসি: আমার মনে হয় সে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার ধরনটি বদলে দিয়ে গেছে। সে নিজের মতো করে দলকে নেতৃত্ব দিত৷ শুধু ক্রিকেট ইতিহাসের নয় বরং গ্ল্যাডিয়েটর সময়ের নেতাদের থেকেও ভিন্নভাবে নেতৃত্ব দিত সে। আপনি সেই আবেগি নেতাদের কথা ভাবেন যারা নেতৃত্বের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। আর ধোনি নেতৃত্বের নতুন উদাহরণ তৈরি করেছে নিজেকে শান্ত ও শীতল রেখে। এটা দেখতেও খুব ভালো লাগে যে, একজন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এ কাজটি করে সফল হয়েছে।
তিনি কি কখনও নিজেকে ভাগ্যবান বলে স্বীকার করেছিলেন?
মাইক হাসি: হ্যাঁ। এ বিষয়ে সে খুব সৎ ও খোলামেলা ছিল যে, কোনোদিন সে ভাগ্যকে সঙ্গে পাবে তো কোনোদিন পাবে না। সে জানে এ খেলায় সফল হতে হলে কিছুটা ভাগ্যেরও সহায়তা লাগবে।
আরেকটি উদাহরণ সে রেখে যাচ্ছে যেটা হলো ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির শেষদিকে প্রচণ্ড মেরে খেলার প্রবণতা৷ আপনি যদি ২৫০-২৮০ রান পেয়ে যান তবে সেটা জয় পাওয়ার মতো সংগ্রহ। কিন্তু যখন আমরা ভারতের বিপক্ষে খেলতাম এবং উইকেটে ধোনি থাকত তখন কোনো সংগ্রহই নিরাপদ মনে হতো না। এর কারণ তাঁর গায়ের জোরে মেরে খেলার ক্ষমতা যার মাধ্যমে ম্যাচের শেষদিকে যেকোনো বোলারের বল সীমানার বাইরে সে আছড়ে ফেলতে পারত। একসময় অন্যান্য দল ধোনির সাফল্য দেখে নিজেদের খেলোয়াড়দের তাঁর মতো করে গড়ে তুলতে শুরু করে। আমি মনে করি ক্রিকেটে সম্ভবত সে হচ্ছে পাওয়ার হিটিংয়ের পথিকৃৎ।