মুরালি বিজয় ও তাঁর অদৃশ্য সুইচ

সামনের পায়ে ভর করে খেলাটাই তাঁর অভ্যাস, পরিচয়। এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। আবার এই সামনের পায়ে খেলার অভ্যাসটাই কখনও কখনও হয়ে উঠছে তাঁর দুর্বলতা। এই জন্য ক্যারিয়ারে অনেক বার ব্যর্থতাও দেখেছেন আবার তাঁর ব্যাট থেকেই ক্রিকেট দুনিয়া দেখেছে ডাউন দ্য উইকেটে অবিশ্বাস্য সব শট। আসলে মুরালি বিজয় ব্যাট হাতে কেমন করবেন সেটা নির্ভর করত একটা সুইচের উপর।

ব্যাট, প্যাড আর গ্লাভস হাতে মুরালি বিজয় ব্যাট করতে নামার দৃশ্য সবাই দেখত। তবে বিজয় একটা অদৃশ্য সুইচ নিয়ে মাঠে নামতেন বোধহয়। তিনি ভাল খেলবেন কী খেলবেন না সেটা নির্ভর করে শুধুমাত্র ওই সুইচের উপর। কোন কন্ডিশন, কোন উইকেট কিংবা কোন প্রতিপক্ষ কোন কিছুই তাঁর কাছে ভাবনার বিষয় না।

বিজয় যে দিন ব্যাট হাতে রান করার সেদিন বিশ্বের সেরা বোলিং লাইন আপের বিপক্ষে সবচেয়ে প্রতিকূল কন্ডিশনেও করতে পারেন। আবার অনেক ফ্ল্যাট উইকেটে কিংবা ব্যাটসম্যানদের স্বর্গে গিয়েও বিজয় খালি হাতে ফিরেছেন। একই টেকনিক দিয়ে কখনও বিশ্বজয় করেছেন আবার সেই টেকনিকেই নিজের উইকেট দিয়ে এসেছেন। বিজয় আসলে ক্রিকেটেরই এক রহস্য হয়ে উঠেছিলেন।

তামিল নাড়ুতে জন্ম নেয়া এই ক্রিকেটার আর দশ জনের মত ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলা শুরু করেননি। ক্রিকেটের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা তাঁর শুরু হয় অনেক পরে। সতেরো বছর বয়সে ক্রিকেট খেলাটা শুরু করেন। তবে এরপর তিন বছরের মধ্যেই চেন্নাইয়ে ক্লাব ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন।

২০০৫ সাল পর্যন্ত চেন্নাইয়ে ক্লাব ক্রিকেটই খেলেছেন। তাও অনূর্ধ্ব-২২ দলের হয়ে। এছাড়া ব্যাট হাতে যে খুব ভাল কিছু করে ফেলছিলেন তাও না। পুরো মৌসুমে মাত্র ২৬ এর কাছাকাছি গড়ে রান করেন। তবুও নির্বাচকরা তাঁর মধ্যে কি যেন একটা দেখে ফেলেছিলেন। সে বছরই তামিল নাড়ু মূল দলে ডাক আসলো তাঁর।

২০০৬ সালে প্রথম রঞ্জি ট্রফির দলেও ডাক পেলেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের অভিষেক বছরেই মুরালি বিজয় প্রমাণ করলেন কেন তাঁকে দলে ডাকা হয়েছিল। সে বছর বড় বড় সব ইনিংস খেলে পুরো ক্রিকেট পাড়ায় রীতিমত ঝড় তুলে ফেলেছিলেন। এক ম্যাচে অভিনব মুকুন্দের সাথে ৪৬২ রানের ওপেনিং জুটি গড়ে ফেলেছিলেন।

ক্রিকেটটা দেরিতে শুরু করলেও দ্রুতই এগোতে থাকেন তিনি। ব্যাট হাতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বিশাল বিশাল সব ইনিংস খেলার পুরষ্কারও পান। ২০০৮ সালে গৌতম গম্ভীরের জায়গায় ভারতের টেস্ট দলে ডাক আসে তাঁর। সতেরো বছর বয়সে ক্রিকেট শুরু করা মুরালি বিজয়ের জন্য স্বপ্নের মত এক ব্যাপার।

নাগপুরে বর্ডার গাভাস্কার ট্রফির চতুর্থ ও শেষ ম্যাচে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হলো বিজয়ের। গৌতম গম্ভীর এক টেস্টে নিষিদ্ধ হওয়াতেই কপাল খুলেছিল এই ওপেনারের। এমন কি দলে যখন তাঁর ডাক আসে সেদিনও তিনি রঞ্জি ট্রফ্রির এক ম্যাচ খেলছিলেন। আর যেদিন টেস্ট অভিষেক হল সেদিন রঞ্জির সেই ম্যাচে শেষ দিনের খেলা হচ্ছিল।

ফলে একেবারে হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ। তাঁর অভিষেক টেস্টেই অ্যালান বোর্ডার বলেছিলেন, ‘তাঁর ডিফেন্স নির্ভর করার মত। সামনের ও পেছনের পায়েও তাঁকে যথেষ্ট কমফোর্টেবল মনে হচ্ছে। সে যখন আক্রমণ করে তখনও জোর করে কিছু করতে চায় না, নিজের টেকনিকেই আস্থা রাখে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাঁকে কেন এই ম্যাচে খেলানো হচ্ছে।’

বীরেন্দ্র শেবাগের সাথে ওপেন করে দুই ইনিংসেই ভারতকে ভালো শুরু এনে দিয়েছিলেন। দুই ইনিংসে যথাক্রমে তাঁর স্কোর ৩৩ ও ৪১। তবে এরপরের ম্যাচেই শ্রীলঙ্কার সাথে ৮৭ রানের ইনিংস। সেই থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের হয়ে ওপেন করেছেন।

তবে মুরালি বিজয় নতুন করে ফিরে এসেছিলেন ২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। হায়দ্রাবাদ ও মোহালিতে টানা দুটি দেড়শো রানের ইনিংস। এরপর সব মিলিয়ে ভারতের হয়ে ৬১ টেস্ট ম্যাচের ক্যারিয়ার তাঁর। সেখানে ৩৮.২৮ গড়ে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ৩৯৮২ রান। ঝুলিতে ১২ টি সেঞ্চুরিও আছে এই ব্যাটসম্যানের। যদিও রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে তিনি কখনোই রঙটা ছড়াতে পারেননি।

সাদা পোশাকের শেষটাও রঙিন হয়নি তাঁর। চার হাজার টেস্ট রানের মালিক বিজয় অবসরের আগের শেষ চারটা-পাঁচটা বছর টেস্ট খেলতেই পারেননি। ঘরোয়া ক্রিকেটেও সুযোগ পেয়েছেন সামান্যই। তাই, বিরাট একরাশ আক্ষেপ নিয়ে বড় অবেলায় ক্যারিয়ারে ফুলস্টপ টেনে দিলেন তিনি।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link