দুই ছেলে, এক স্বপ্ন

কোনো রকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা – এর মধ্যে ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্নটা যেন স্রেফ এক বিলাসিতা। দুই ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবেন বলে পণ করেছিলেন নওশাদ খান। দারিদ্র্যতা তাঁকে আটকাতে পারেনি। কঠোর পরিশ্রম আর চেষ্টায় তিনি সফল হয়েছেন। দারিদ্র্যতার সাথে লড়তে লড়তে কষ্ট করেই দুই ছেলেকে বানিয়েছেন ক্রিকেটার। বস্তি থেকে উঠে এসে দুই ছেলে সুযোগ পেয়েছেন রঞ্জি ট্রফিতে।

সরফরাজ খান অবশ্য ভারতীয় ক্রিকেটে বেশ পরিচিত মুখ। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) সহ ঘরোয়া ক্রিকেটের তিনি নিয়মিত এক মুখ। মুম্বাইয়ের হয়ে রঞ্জি ট্রফি খেলতেন। স্বপ্ন ছিল ছোট ভাই মুশির খানও একসময় মুম্বাইয়ের হয়ে খেলবে। বাবা নওশাদ আর ভাই সরফরাজের সেই স্বপ্ন এখন পূরণ হতে চলেছে। মুম্বাইয়ের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে খেলার সুযোগ পেয়েছেন ১৮ বছর বয়সী মুশির খান। পৃথ্বী শ’য়ের নেতৃত্বে রঞ্জি ট্রফিতে নকআউট পর্বে মুম্বাইয়ের জার্সি গায়ে খেলবেন দুই ভাই সরফরাজ ও মুশির খান।

অনূর্ধ্ব-১৯ কুচবিহার ট্রফিতে দিন কয়েক আগে ৬৭ গড়ে ৬৭০ রান করেছেন ওপেনার ও বাঁ-হাতি স্পিনার মুশির খান। দুই সেঞ্চুরি আর পাঁচ ফিফটি করেছেন তিনি। বছরখানেক আগেই পুলিশ শিল্ড ও মাধব মন্ত্রী টুর্নামেন্টে তিনি জিতেছিলেন টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার।

সরফরাজ ও মুশিরের বাবা নওশাদ কোচিং করান। দুই ছেলেকে নিজেই কোচিং করিয়ে পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে তৈরি করেছেন। তবে দুই ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর ঝোঁকটা হয়েছিল ভিন্ন কারণে। একবার এক ক্রিকেটারের সাথে কথা কাটাকাটি হয়; যাকে নওশাদ নিজেই কোচিং করেছিলেন। সেই ক্রিকেটার নওশাদকে উদ্দেশ্যে করে বলেছিল, ‘ আমার মধ্যে সামর্থ্য আছে আমি খেলেছি। তোমার মধ্যে প্রতিভা থাকলে তোমার দুই ছেলেকে ক্রিকেটার বানিয়ে দেখাও। ‘

সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানো। দুই ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর একপ্রকার পণ করে ফেললেন। অদম্য চেষ্টা আর পরিশ্রমে নিজের লক্ষ্যটা পূরণ করে ফেলেছেন নওশাদ খান।

ভাইয়ের জন্য ক্যাপ চেয়ে ম্যানেজারকে আগেই অনুরোধ জানিয়েছিলেন সরফরাজ খান। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি ম্যানেজারকে অনুরোধ করেছিলাম আমার ভাই মুশিরের জন্য অতিরিক্ত একটি ক্যাপ দেওয়ার জন্য যখন আমার ভাই ভবিষ্যতে মুম্বাইয়ের হয়ে খেলবে। ঈশ্বরের দয়া এবং আমার ভাই ও বাবার কঠোর পরিশ্রম ছিল। আমাদেরকে ক্রিকেটার বানাতে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে।’

মুম্বাইয়ের হয়ে ডাক পাওয়ায় বেশ খুশি মুশির খান। বাবার আর ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে এই তরুণ ক্রিকেটার যেন নিজের স্বপ্নই পূরণ করে ফেলেছেন। মুম্বাইয়ের হয়ে ডাক পাওয়া নিয়ে মুশির খান বলেন, ‘আমার ভাই ও আমার মাত্র একটি স্বপ্ন ছিল যে ভারতের হয়ে জাতীয় দলে খেলা এবং আমার বাবাকে খুশি দেখা। এই খবরটা আমাকে বেশ খুশি করেছে এবং আমি কৃতজ্ঞ মুম্বাই ক্রিকেট অ্যাকাডেমির প্রতি (এমসিএ)। আমাকে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এবং এখনও অনেক কিছু করার বাকি আছে।’

দিল্লী ক্যাপিটালসের হয়ে আইপিএলে খেলছেন সরফরাজ। লাল বলের ক্রিকেটে অবশ্য তিনি মুম্বাইয়ের হয়ে নিয়মিত এক মুখ। তবে নওশাদ খান মনে করেন সরফরাজের ক্ষেত্রে যে ভুল তিনি করেছিলেন সেটা মুশিরের ক্ষেত্রে শুধরে ফেলেছেন।

নওশাদ খান বলেছেন, ‘এটার শুরুটা হয়েছিল যখন ১৫ বছর বয়সে তার ক্লাস পেইয়েড এসসি সিনিয়র দলের বিপক্ষে ওপেনিংয়ে সুযোগ দেয়। তার আত্মবিশ্বাসটা সেখান থেকে বেড়েছে। আমি চেয়েছিলাম সরফরাজের ক্ষেত্রে যে ভুলটা হয়েছে মুশেরের ক্ষেত্রে সেটা না হোক, অনুশীলনের সময়। সরফরাজকে আমরা সন্ধ্যার দিকে অনুশীলন করাতাম। কিন্তু যখন সে মুম্বাইয়ের হয়ে খেলা শুরু করলো তখন দেখলাম সকালের সমত লাল বলে খেলতে সে কিছুটা সমস্যায় পড়ছে। আমি ভুল বুঝতে পারলাম। এখন আমরা সকালে অনুশীলন করি, যখন উইকেটে শিশির থাকে; যার কারণে মুশির পেসারদের সহজেই খেলতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বস্তি থেকে এসেছিলাম। টয়লেটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। সেখানে আমার ছেলেদের থাপ্পড় মেরে তাদের আগে অন্যরা চলে যেত। আমরা শূন্য হাতে এসেছি, শূন্য হাতেই যাব। সরফরাজ একবার আমাকে বলেছিল, সমস্যা কি আব্বু এটা যদি না হয় আমরা আবার ট্র‍্যাক-প্যান্ট বিক্রি করব।’

দুই ছেলেকে ক্রিকেটার বানিয়েছেন, স্বপ্ন পূরণ করেছেন; প্রমাণ করেছেন অদম্য চেষ্টা আর ইচ্ছাশক্তি থাকলে সবকিছুই সম্ভব। দুই ছেলেকে জাতীয় দলে খেলতে দেখাই হয়ত এখন নওশাদের স্বপ্ন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link