ফাস্ট বোলিং সাধারণত কম বয়সী ক্রিকেটারদের বিচরণ ক্ষেত্র। স্বাভাবিক নিয়মেই যেমন বয়স বাড়তে থাকে, বলের গতির সঙ্গে সঙ্গে বোলারদের এফেক্টিভনেস কমতে থাকে। তবে এই নিয়মের ব্যতিক্রমও বেশ কিছু আছে। যেমন ইমরান খান বা রিচার্ড হ্যাডলি। এবং অবশ্যই জেমস অ্যান্ডারসন।
অ্যান্ডারসনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও বেশি চোখে পড়ে কারণ ৪৬ টেস্ট অব্দি তার বোলিং গড় ৩৫এর ওপর ছিল। ক্যারিয়ার শেষে সেটা দাঁড়াল ২৬.৪৬। তবুও এই গড় সর্বকালের সেরাদের মধ্যে পড়ে না। ইংল্যান্ডেরই সিডনি বার্নস বা ফ্রেডি ট্রুম্যানের গড় তার চেয়ে বেশ কিছুটা কম। তবে এদের কেউই অ্যান্ডারসনের মতো স্থায়িত্ব দাবী করতে পারেন না।
এবার একটা অত্যাশ্চর্য পরিসংখ্যান – ৩৫ বছর বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পর জিমি ২২০ উইকেট নিয়েছেন, ২২.৮৬ গড়ে। অর্থাৎ তার এই সময়ের পারফর্মেন্স সর্বকালের সেরাদের (পড়ুন হ্যাডলি, মার্শাল, স্টেইন, ম্যাকগ্রাদের সঙ্গে) পারফর্মেন্সের সঙ্গে তুলনীয়।
অ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ যে তার ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্স খুব বেশি নেই। ইনিংসে ৬ বা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন মাত্র ছয় বার। সংখ্যাটা তার জুড়িদার ব্রড এবং সিডনি বার্নসের ক্ষেত্রে ১২, বথাম বা আন্ডাউডের ক্ষেত্রে ১০। তবে তার মানে এই নয় যে জিমি টিমকে ধ্বংস করতে পারতেন না।
অন্তত ৪ উইকেট নিয়েছেন এমন ইনিংসের সংখ্যা অ্যান্ডারসনের ক্ষেত্রে ৬৪, তার অন্যান্য প্রতিযোগীদের তুলনায় বহু বহুবার বেশি। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই চার উইকেটের মধ্যে থাকত বিপক্ষ টিমের মেরুদণ্ড – শচীন থেকে বিরাট, স্মিথ থেকে উইলিয়ামসন। শচীনের ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়, তিনি তিন প্রজন্মের সেরা বোলারদের সামলেছেন, একই কথা বলা যেতে পারে এন্ডারসন সম্বন্ধেও।
এবং অনেকটা শচীনেরই মতো, তাঁর সাফল্যের মূলমন্ত্র ছিল অসাধারণ ধারাবাহিকতা। দিনের পর দিন, ম্যাচের পর ম্যাচ, সিরিজের পর সিরিজ, বছরের পর বছর। ইংল্যান্ডের জয়ে মোট ৩৮৪ উইকেট নিয়েছেন অ্যান্ডারসন, ১৯.৫৫ গড়ে। অথচ তিনি ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছেন মাত্র ৮ বার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি রয়ে গেছেন জয়ের নেপথ্য নায়ক। দলের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সেরা প্লেয়ার। এখানে তিনি হয়ত তুলনীয় দ্রাবিড়ের সঙ্গে।
ক্যারিয়রের শুরুতে অ্যান্ডারসনকে ডাকা হত ‘ক্লাউডারসন’ নামে – ইংল্যান্ডের মেঘলা আবহাওয়া না পেলে নাকি তিনি সাফল্য পান না। সেই অভিযোগ থেকে নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করেছেন অ্যান্ডারসন নিজের ক্রিকেট জীবনের দ্বিতীয়ার্ধে। এবং তার ক্রিকেট জীবনের শেষ ৫ বছর তার বিদেশের মাটিতে গড় ছিল মাত্র ২০, দেশের মাটিতে প্রায় ২৯। এবং এশিয়ার মাটিতেও তিনি যথেষ্ট সফল – মোট ৯২ উইকেট পেয়েছেন তিনি এখানে।
নিজের সময়ের গ্রেট ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একমাত্র স্টিভ স্মিথ এবং বিরাট কোহলি ছাড়া বাকিদের বিরুদ্ধে জয়ের দাবী করতে পারেন এন্ডারসন। স্মিথকে তিনি ৮ বার আউট করলেও স্মিথ তার বিরুদ্ধে ৫৯.৮৭ গড়ে রান করে গেছেন। তুলনায় অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল তার বিরাটের সঙ্গে দ্বৈরথ।
২০১৪ সিরিজে কোহলিকে প্রায় নাচিয়ে ছেড়েছিলেন অ্যান্ডারসন – ৪.৭৫ গড়ে ৪ বার আউট করেছিলেন তাকে। পরবর্তী অধ্যায়ে সেই লড়াইয়ে সাম্য ফিরিয়ে এনেছেন কোহলি। দু’জনের মুখোমুখি লড়াইয়ের মোট হিসেব – ৩০৭ রান, ৭ বার আউট, গড় ৪৩.৫৭। ড্র নাকি এডভান্টেজ কোহলি?
তার এই গড় শচীনের বিরুদ্ধে ২৩.১১, উইলিয়ামসনের বিরুদ্ধে ১৮.৪৪ এবং মাইকেল ক্লার্কের বিরুদ্ধে ৩৩। এখানে অ্যান্ডারসনকে এগিয়ে রাখতে কোনো দ্বিধা নেই।
বয়সের সাথে সাথে প্রত্যাশা মতোই অ্যান্ডারসনের বলের গতি কমলেও সেই খামতি তিনি পূরণ করেছেন নিখুঁত লাইন এবং লেন্থের মাধ্যমে। এবং অবশ্যই স্যুইংয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ। ক্যারিয়রের শেষের ৫ বছর তার ইকোনমি ছিল ২.৪২ রান প্রতি ওভার। এই সময়ে বিশ্বের আর কোনও বোলার তার মতো কার্পণ্যের সঙ্গে এতটা সাফল্য লাভ করেন নি।
তবে কোন ক্রিকেটারকেই নিছক সংখ্যার মাধ্যমে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। সুইং এবং সিম বোলিংয়ের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বোলারের কব্জির ব্যবহার। এবং এই ক্ষেত্রে জেমস অ্যান্ডারসনের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। স্যুইং সহায়ক উইকেটে জেমস এন্ডারসন বোলিং মার্কে দাঁড়িয়ে – বিশ্বের যে কোন ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে দৃশ্যটা আতংক সৃষ্টি করবে।
এবং যারা ক্রিকেট ভালোবাসেন তাদের কাছে উত্তেজনা। তারপর তার হাত থেকে বেরিয়ে আসবে একের পর এক প্রায় খেলা যায় না এমন ডেলিভারি। যেমন ‘ওয়েবল বল’ – ফাস্ট বোলারদের লেটেস্ট অস্ত্র। এক্ষেত্রে পিচ করার আগে বলটি কাঁপতে থাকে এবং পিচ করার পর সেটি কোন দিকে স্যুইং করবে সেটা বোঝা প্রায় অসম্ভব।