হৃদয়ের দপ্তরে ‘নো ভ্যাকেন্সি’

স্বপ্ন বিলাসীদের কোনও নির্দিষ্ট পথ হয় না। আবার যেমন-তেমন ভাবে স্বপ্ন দেখাও যায় না। খেই হারিয়ে যায়। একটা স্বপ্ন তৈরি করতে অনেকটা বছর, অনেক ঘটনাকে সঙ্গী করে একটা পথে হেঁটে যেতে হয়। ছুন্নি চুড়ি আর আংটি বেচত কয়লাখনিতে। যে কয়লাখনিতে শ্রমিকদের জন্য লেখা ছিল মৃত্যু। এমন একটা কয়লাখনির শ্রমিকদের কাছে গিয়ে ছুন্নি সিঁদুর, চুড়ি আর আংটি বেচত যেখানে সেগুলো আজ পরলে কাল ভেঙে ফেলতে হয়, মুছে ফেলতে হয়।

দাম এক টাকা। ঐ এক টাকায় ছুন্নি স্বপ্ন বেচত। স্বপ্নের ফেরি করে বেড়ানোতে কয়লা খনির শ্রমিক আর জারার সাত তলা বিল্ডিং এক হয়ে যায়। সেখানে কোন ভুল নেই। বছরের পর বছর জ্বরের ঘোরের মত ভুল বকে যাওয়া – একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু ঠিক হয় না, পরের বার আবার সেই ‘নো ভ্যাকেন্সি’ দেখে চলে আসতে হয়। আর তারপর রাতে শুনশান সড়কের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ঐ বাঁধা লব্জটাই আওড়াতে হয় প্রতিদিন – একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

কোথায় ঠিক হল? আর্চ রাইভ্যাল কাপ নিয়ে চলে গেল এই ২০ বছরের মধ্যে, দু’বার। একটায় পরাজয়ের বোঝা কাঁধে নিয়ে নিতে হল। একটা ব্যাচ থেকে আরেকটা ব্যাচ, আরেকটা ব্যাচ হল কিন্তু রাজার ঘরে সোনার প্রদীপ জ্বলল না। এত এত রণকৌশল আয়ত্তে আনার পরেও নিষ্ফল, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হল অপরের সাফল্যে। কী আর ঠিক হল যে বিজেন্দর শর্মা। কাকে, নেহি হোনা থা ইয়ে সব!

এক লহমায় চুপ হয়ে গেল গোটা ব্রাজিল পাড়া। তার ঠিক কয়েক মিনিট আগেও নাচছিল তারা। নেইমার গোলকিপারকে কাটিয়ে গোল করেছে যে অবশেষে! উত্তাল পরিস্থিতিতে কেউ কেউ কেঁদে ফেলেছেন। তারপরেই ছন্দপতন। নিমেষে গোটা পাড়া নিস্তব্ধতার চাদরে ঢেকে গেল।

যে জয়টা দেখার জন্য সব মুলতুবি রাখা হয়েছিল, সেই কাঙ্ক্ষিত জয়ের মিনিট তিনেক আগেই – ২০০২। সেবারও গোলকিপারকে মাটি ধরিয়ে গোল এসেছিল। কিন্তু মাত দিয়ে দেওয়া চালটা সেবারে শোধ সমেত ফেরত আসেনি। এবার এলো, শুধু এলোই না স্বপ্ন আয়নার কাঁচে ইট ছোঁড়ার মত চুরমার করেই এলো।

ঘরের দেওয়ালে একটা ছবি জ্বলজ্বল করে। কাকার ছবি। শিল্পের দেশে হলুদ জার্সি পরা গুটি কয়েক স্বপ্নের ছবি। ঝুল পরা নেইমার, নোংরার পলেস্তরা খসে আসা কাকা, নিচের কোণ থেকে ছিঁড়ে যাওয়া রোনালদো – এই সব স্বপ্ন গুলোকে লালন করতে করতে আজ মিটিংয়ের তাড়া থাকে। ভাল করে কাঁদারও সময় থাকে না। জীবন এগিয়ে গেল, আরও একটা বিশ্বকাপের দিকে। সব ভুলে আবার মাতবে, আবার হাসবে, গাইবে, নাচবে।

তারপর সেই স্বপ্নের গাড়িটা ইউরোপীয়ান টিমের কাছে পৃথিবীর সেরা টিমটা কেমন করে যেন থেমে যাবে। যেন অনেক বছর পর থামবার জন্যই তাদের জন্ম হয়েছে। মুখ ঢেকে যাবে অধুনা ব্যঙ্গাত্মক চিত্রে। ইউরোপের লাল লাল মুখগুলো এসে সোল্লাসে চোখ বড় বড় করে বলবে— ‘এই যে, হ্যাঁ হ্যাঁ এদিকে দেখো, এদিকে, আমরাই শ্রেষ্ঠ! মেনে নিতে আপত্তি আছে কোনও?’

অ্যান্টনি, মার্টিনেলি, ভিনি, রড্রিগো – এক একটা মুখ ভেসে উঠছে। থিয়াগো সিলভা অদূরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। সেই ক্যাপ্টেনের মত কেউ ক্ষমা চাইছে। এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া স্বপ্ন। কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

বিশ্বকাপ শেষ। ক্লাব ফুটবল শুরু। চার বছরের দোনোমোনো বছরের শেষে হলুদ, নীল, সবুজে ভেসে উঠবে এরিনা। ভেঙ্গাবয়েসে নাচ হবে। পথে পথে না খেতে পাওয়া স্বপ্নগুলো ড্রিবল করবে। মাথায়, পায়ে, উরুতে বল নিয়ে স্বপ্নের প্রদর্শন করবে রাস্তায় রাস্তায়। দেওয়াল জুড়ে সবুজে সবুজে ঢেকে যাবে, আইডলদের মুখ আঁকা থাকবে।

আঁকা থাকবে একটা স্বপ্নও। চাকরি শেষে, অবিশ্রান্ত কলেবরে ভরা কলকাতা বরাবরের মত নগরপসারিণীর মত সেজে উঠবে বহু চেনা হলুদ-নীল জার্সিতে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েও হয় না। কেউ এসে চোখ রাঙিয়ে বলে যাবে, ‘৩৬ আর ২৪ এক হল?’ ওরা বুঝেও বোঝে না, অপেক্ষাদের কোনও সংখ্যা হয় না, বছর হয় না। অপেক্ষারা অপেক্ষাই হয়ে রয়ে যায়। সে রঙিন আলোর দীপ কোনওদিনও, নিভে যাবে না। লুটে কোই মন কা নগর।

আমার ব্রাজিল, ভালবাসা হয়ে রয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link