নূর নাহিয়ান, হুইলচেয়ারের স্বপ্নসারথি

হঠাৎই একদিন ক্লাসরুমে অনূভব করলেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। নুয়ে পড়লেন মাটিতে। পরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা গেল স্পাইনাল কর্ডে রক্ত জমাট বেঁধেছে। অপারেশন করে জমাট বাঁধা রক্ত সরানো গেল ঠিকই তবে নিজের পায়ে আর কখনোই দাঁড়ানো হল না নূর নাহিয়ানের। দেহের নিচের অংশটুকু একেবারেই অবশ হয়ে গেল। শুরু হল জীবনের নতুন এক অধ্যায়, নতুন এক সংগ্রাম।

২০০৮ সালে সেই ঘটনার পর ঘরে বসেই সময় কাটতে থাকে নাহিয়ানের। পড়াশোনা করেই দিন যাচ্ছিল। নিজের লেখালেখির অভ্যাসটা নতুন করে চর্চা করতে শুরু করলেন। নিজের কবিতার বইও বের হল। এভাবেই হয়ত একটা ঘরবন্দী জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। তবে নাহিয়ানের আসল পরিচয় তো খেলার মাঠে, যেখানে তাঁর মন পড়ে থাকে, যেখানে তিনি নিজেকে খুঁজে পান। জীবনের সবকিছু ভুলে যেখানে তিনি বেঁচে থাকার তাগিদ অনুভব করেন। নাহিয়ান আবার সেখানেই ফিরে গেলেন। এবার নিজের পায়ে না পারলেও, হুইলচেয়ারে ভর করে।

এরপর শুরু হল ক্রিকেট মাঠে তাঁর দাপিয়ে বেড়ান। হুইলচেয়ারে বসেই তারপর কী খেলেননি তিনি। ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিসের মত প্যারা স্পোর্টসগুলোতে নিজের ছাপ রেখেছেন। এরপর নিজের দায়িত্বটা আরেকটু বাড়িয়ে নিলেন। বাংলাদেশে প্যারা স্পোর্টসকে একটা কাঠামোতে আনার জন্য গড়ে তুললেন বাংলাদেশ হুইলচেয়ার স্পোর্টস ফাউন্ডেশন।

২০০৮ সাল থেকেই হুইলচেয়ার জীবন শুরু হয় নূর নাহিয়ানের। আর হুইলচেয়ার ক্রিকেট খেলা শুরু করেন ২০১১ সাল থেকে। এরপর দীর্ঘদিন বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের হয়ে খেলেছেন। পাশাপাশি ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিসও খেলেছেন।

হুইলচেয়ারে বসেও মাঠে আসার স্বপ্নটা কীভাবে দেখেছিলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে  তিনি বলছিলেন, ‘আমার যখন নিচের অংশটুকু অবশ হয়ে যায় তখন আমি একটা নতুন জগতে প্রবেশ করলাম। এখানের সবকিছু আলাদা। আমার পাশে আমার পরিবার ছিল, তবুও নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মানসিক শান্তি পাচ্ছিলাম না। সেটার জন্যই আমি খেলাটাকে বেঁছে নেই। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম হুইলচেয়ারে বসেও ব্যাটিং করা যায়, বোলিং করা যায়। খেলার মাধ্যমেই আমি আবার নিজেকে খুঁজে পেতে শুরু করি।’

দীর্ঘদিন খেলার সাথে জড়িত থাকার পর এবার প্যারা স্পোর্টসকে আলাদা উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান নাহিয়ান। এখন তাই মনোযোগ দিচ্ছেন সাংগঠনিক কাজেই। ২০১৮ সালে নিজ হাতে গড়ে তুলেন বাংলাদেশ হুইলচেয়ার স্পোর্টস ফাউন্ডেশন। এখন এই ফাউন্ডেশনকে ঘিরেই তাঁর যত ব্যস্ততা। বছরব্যাপী নানা রকম টুর্নামেন্ট আয়োজন করে যাচ্ছে সংগঠনটি। যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অংশ নিচ্ছেন অনেক হুইলচেয়ার খেলোয়াড়রা।

এই বিষয়ে নূর নাহিয়ান বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি নিয়মিত টুর্নামেন্ট আয়োজন করার। যদিও আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন আরো অনেক। আমাদের আরো অর্থায়নের প্রয়োজন। তবুও যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছেলেরা খেলতে আসে এটাই তাঁদের জন্য অনেক বড় কিছু। যে তাঁরা কোথাও খেলতে পারছে। তাঁরা একসাথে হতে পারছে। তবে আমরা চাই এটাকে আরো পেশাদার কাঠামোতে নিয়ে আসতে। যেন সব খেলোয়াড়কে একটা বেতনের আওয়তায় নিয়ে আসা যায়।’

প্যারা স্পোর্টসকে আরো জনপ্রিয় করে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নূর নাহিয়ান। নিজে ইঞ্জিনিয়ার হলেও চাকরি ছেড়ে খেলাটাকেই আঁকড়ে ধরে আছেন। প্যারা স্পোর্টসকে যেমন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান তেমনি সব খেলোয়াড়কে একটা রোজগারের ব্যবস্থা করে দেয়াও তাঁর স্বপ্ন। আর নাহিয়ানের এই স্বপ্ন পূরণ হলে দেশের অনেক শারীরিক প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়দের জীবনটাই পাল্টে যেতে পারে।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link